X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের ‘রাজা’ বা ‘রানি’ কবে আসবে?

চিররঞ্জন সরকার
২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:২৬আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৭:০৩

চিররঞ্জন সরকার গত কয়েক দশকে নির্বাচিত-অনির্বাচিত অনেক শাসক দেখেছি। জিয়া, সাত্তার, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, ফখরুদ্দিন। কিন্তু কোনও শাসকই আমাদের মন ভরাতে পারেননি বলে আমি মনে করি। জনপ্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে কেউই অবদান রাখতে পারেনি।
আমাদের প্রত্যাশার মিনারগুলো কেবলই জিজ্ঞাসার চিহ্নে পরিণত হয়েছে। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা ছাড়া আমাদের প্রাপ্তির ঝুলিতে কেবলই হতাশা। তারপরও আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখি। আশা করি এবার হয়তো কিছু হবে। আমাদের স্বপ্ন পূরণের শাসক নিশ্চয়ই আসবেন। এবার না হোক, আসছে বার নিশ্চয়ই আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি গল্প। সুকুমার রায়ের ‘ব্যাঙের রাজা’। রাজবাড়িতে যাওয়ার যে পথ সেই পথের ধারে দেয়ালের পাশেই ব্যাঙদের পুকুর। একদিন সর্দার ব্যাঙ ফুর্তির চোটে লাফ দিলো। পড়বি তো পড়, একেবারে দেয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে। সিপাই সান্ত্রি লোকলস্কর দলবল নিয়ে রাজা তখন সভায় চলেছেন। মাথায় মুকুট। রঙিন পোশাক। আলো ঝলমল। চতুর্দোলায় চড়ে রাজা সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা ‘রাজা-রাজা’ বলে নমস্কার করছে। সর্দার ব্যাঙের মনে হলো, কী সুন্দর আহা। আমাদের যদি একটা রাজা থাকতো। ফিরে এসে সর্দার ব্যাঙদের সভা ডেকে বললো, আমাদেরও রাজা চাই। ব্যাঙ দেবতা আকাশের মেঘের কাছে সমবেত আর্জি জানানো হলো। তখন দেবতা মরা গাছের ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, এই তোমাদের রাজা। পুকুর পাড়ে সেই ভাঙা ডালের ওপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছনায় চকচক করতে লাগলো। তা দেখে ব্যাঙের ফুর্তি তো আর ধরে না। কিন্তু একদিন সর্দার ব্যাঙের গিন্নি বললেন, ছাই রাজা। এ রাজা তো নড়েও না চড়েও না। আবার ব্যাঙ দেবতার কাছে সমবেত আর্জি, নতুন রাজা দাও। তখন মেঘ দেবতা একটা সাদা সুন্দর বককে পুকুরের ধারে নামিয়ে বললেন, এই নে তোদের নতুন রাজা।
চকচকে ঝকঝকে ধবধবে রাজা। ভালো রাজা। সুন্দর রাজা। কিন্তু পরদিন ঘুম ভেঙে বক দেখলো এ তো দারুণ পুকুর। এখানে অনেক ব্যাঙ। সে তখন এদিক-ওদিক তাকায়, আর টুপ টুপ করে ব্যাঙ খায়। সবাই এলো সর্দারের কাছে। বিহিত চাই। সর্দার গিন্নি গেলো বক রাজার কাছে। শামুক আছে, শামুক খা না, রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস। বকটা তখন সর্দার গিন্নিকেও খেয়ে ফেললো। কান্নার রোল ব্যাঙ সমাজে। এবার দেবতার কাছে গিয়ে সর্দার ব্যাঙ বললো, পাজি রাজা, লক্ষ্মীছাড়া রাজা, দুষ্টু রাজা চাই না। রাজাটাজা আর কখনও চাইবো না।
এই গল্পের মতো অভিজ্ঞতা আমাদেরও। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমরা শিক্ষালাভ করি। ইতিহাসের পটে দেখি আমাদের সাম্প্রতিককে। রাজনেতা ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়নও বদলায়। রাজনেতারাও বদলান।
২০১৪ সালে দেশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করুন। নির্বাচন আসছে। অথচ দেশব্যাপী শুরু হলো সীমাহীন নৈরাজ্য ও আগুন সন্ত্রাস। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন প্রতিরোধের ঘোষণা দিলো। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেকোনও মূল্যে নির্বাচন করার পণ করলো। দেশজুড়ে চললো এক ভয়াল পরিস্থিতি। তখন ত্যক্তবিরক্ত মানুষ। তারপরও অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ।  নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় এলো। শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দলের সন্ত্রাস দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করলো। লক্ষ্যহীন সন্ত্রাসনির্ভর বিরোধী দলের কর্মসূচি একসময় থিতিয়ে গেলো।  পুলিশ-মামলা-আইন-আদালত দিয়ে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার নীতিতে তারা যথেষ্ট সক্ষমতাও দেখালো। সময়ের ফেরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রী জেলেও গেলেন। ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে সব প্রতিবাদ-সমালোচনাকে দমন করতে থাকলো। শাসক দলের প্রতি সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হতাশ। কিন্তু যোগ্য বিকল্প তৈরি হলো না। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শেখ হাসিনাই হয়ে উঠলেন অবিকল্প নেতা।
বর্তমান সরকারের প্রায় পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ হতে চলেছে। নির্বাচন আবার দরজায় কড়া নাড়ছে। আবার আমরা হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছি। গোটা দেশজুড়ে অর্থনীতির কান্না। বিদেশি বিনিয়োগ বাজারে আসা তো দূরের কথা, দেশীয় বাজার থেকে কোটি কোটি টাকার লগ্নি প্রত্যাহার হচ্ছে। প্রতিকারহীন অব্যাহত লুটপাটের কারণে আর্থিক-প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। শিক্ষাব্যবস্থায় যারপরনাই নৈরাজ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব মাত্রা ছাড়িয়েছে। সুশাসনের অভাব, শক্তি দিয়ে বিরোধী মত দমন, ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন দাপটে ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সব গোষ্ঠীই ত্যক্তবিরক্ত।  চাকরিবাকরি নেই।  বেকার যুবকদের হাহাকার, আবার অন্যদিকে কৃষকদের কৃষি-উপকরণের দাম কমছে না।
দেশের কলমজীবীরা সরকারের সব ধরনের অপকর্মের সমালোচনায় সোচ্চার। অনেকের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়। সে সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখেও প্রশাসন ও দলের তীব্র সমালোচনায় মুখর হতেই হয়। ‘প্রজার’ স্বার্থে কাজ করা যেমন রাজধর্ম, কলমজীবীদের ধর্ম তেমন চুপ থাকা নয়, সত্য উপলব্ধিকে ব্যক্ত করা।
ক্ষমতাসীনরা তাদের কোনও ব্যর্থতা-সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে রাজি নন। তারা কেবলই নিজেদের কাজের প্রশংসা করেন। ‘যা করেছি ঠিক করেছি, এর চেয়ে ভালো আর হতেই পারে না’-এই নীতিতে অনড় পথ চলেন। তারা নিরলসভাবে নানা জয়গাথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। তখন সেই ব্যাঙের সর্দারের মতোই মনে হয়, আহা কী সুন্দর।
দেশের কোনও উন্নতি হয়নি তা কখনোই বলবো না। নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে যা হয়েছে তাতে দেশের কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। আমরা যে পরিবর্তিত দিনের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্নভঙ্গই হলো বাস্তব সত্য।
আর উন্নয়নের বদলে ভোটে জেতার কৌশল হিসেবে দেখছি দেশজুড়ে মেরুকরণের রাজনীতি। সত্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে কেবল প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের ঘাড়ে সব দোষ অর্পণ করে আবারও ক্ষমতায় আসার কৌশল লক্ষ করা যাচ্ছে। ষড়যন্ত্র যে বিরোধী পক্ষ করছে না, তা বলবো না। কিন্তু কেউ কি ধোয়া তুলসি পাতা? নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখতে তারাও কি নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন না? ভোটের ফল যা-ই হোক, যা দেখছি তাতে মুখে কুলুপ আঁটতে পারছি না। কিন্তু সম্মিলিত উদাসীনতা আর বিবেকহীনতা দেখে মাঝে মাঝে খুবই হতাশা জাগে। কেবলই ভাবি, আমাদের সেই স্বপ্নের রাজা বা রানি কবে আসবে? কবে?
লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ