X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

হেলমেট এবং একটি ব্যাড নিউজ!

রেজানুর রহমান
১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:১১আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:২১

রেজানুর রহমান অনেক দিন আগের কথা। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনের অংশটা ফাঁকা ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রায় প্রতিদিনই সেখানে সভা-সমাবেশের আয়োজন করতো। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টার। বিকেলে একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য হাজির হয়েছি। সমাবেশ চলছে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন একজন নেতা। মসজিদ থেকে আসরের নামাজের আজানের শব্দ ভেসে এলো। তখনও ওই নেতা বক্তৃতা করেই যাচ্ছিলেন। আমার পাশে দাঁড়ানো একজন সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘দেখছেন ব্যাটা কেমন নাস্তিক! নামাজের জন্য আজান হচ্ছে। অথচ সে বক্তৃতা দিয়েই যাচ্ছে!’
তার কথা শেষ হতে না হতেই সমাবেশ মঞ্চের ওই নেতা বক্তৃতা শেষ না করেই বললেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা... নামাজের জন্য আমাদের সমাবেশের কার্যক্রম পাঁচ মিনিটের জন্য স্থগিত রাখা হলো। নামাজ শেষে আমরা আবার সমাবেশের কার্যক্রম শুরু করবো। এ কথা বলেই ওই নেতাসহ আরও কয়েকজন সমাবেশ মঞ্চেই নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন আমার পাশেই দাঁড়ানো আরেকজনের মন্তব্য শুনে যারপরনাই অবাক হলাম। সমাবেশ মঞ্চে নেতাদের নামাজে দাঁড়াতে দেখে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, দেখছেন ব্যাটারা কেমন অভিনয় জানে! পাবলিকের সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য সমাবেশ মঞ্চেই নামাজ পড়তে শুরু করেছে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের দুইজন শ্রদ্ধাভাজন একজন মন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রীর পৃথক দুটি ছবি দেখে কেন যেন বায়তুল মোকাররমের সামনে সমাবেশস্থলে শোনা দুই ব্যক্তির মন্তব্য আমার কানের পর্দায় ধাক্কা দিলো। একই ঘটনায় পৃথক মন্তব্য। সমাবেশ চলছে। মসজিদে আজান হচ্ছে। তখনও সমাবেশে বক্তৃতা হচ্ছে দেখে 'নাস্তিক' বলে নেতার সমালোচনা করা হলো। আবার পরক্ষণেই সমাবেশ মঞ্চেই যখন নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন ওই নেতা, তখন বলা হলো–ওই যে দেখেন লোকের সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য কেমন অভিনয় করা হচ্ছে! তাহলে করণীয় কী? আজানের সময় বক্তৃতা হচ্ছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ঠিক নয়। কাজেই আপনি এজন্য মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু সমাবেশ মঞ্চে নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম, এখানে দোষের কী দেখলেন? দোষ না দেখে প্রশংসাও তো করা যায়, নাকি?

মাননীয় একজন প্রতিমন্ত্রীর মাথায় হেলমেটবিহীন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই তিনি রাস্তায় যানজটের কারণে সময় বাঁচাতে সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করে মোটরসাইকেলে চেপে অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী চালকের পাশাপাশি তার মাথায়ও হেলমেট থাকা উচিত। অথচ মাথায় হেলমেট ছিল না। হ্যাঁ, এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। যারা আইন প্রণয়ন করেন তারাই যদি আইন ভঙ্গ করেন তাহলে তো নিয়মনীতি বলে কিছুই থাকে না। কাজেই এ নিয়ে সমালোচনা ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘ভুল’ বলে একটা শব্দ আছে। ভুল কিন্তু মানুষেরই হয়। কাজেই ভুল করে কেউ যদি পরক্ষণেই তা শোধরানোর চেষ্টা করেন সে ব্যাপারেও বোধ করি সমালোচনার পাশাপাশি কিছুটা প্রশংসাও থাকা উচিত।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেলে চড়েছিলেন। আবার ফিরতি পথে মাথায় হেলমেট পরেই ফিরেছেন। তার মানে তিনি তার ভুল ধরতে পেরেছিলেন। মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্যে তা বেশ স্পষ্ট। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেছেন, আমি আমার প্রিয় সহকর্মীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কেন হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেলে চড়লেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, সরি, আমার ভুল হয়েছে।

এই যে ভুল স্বীকার করার সংস্কৃতি চালু হলো এটাই বোধকরি ভবিষ্যতের জন্য শুভ সংবাদ। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ‘ভুল’ স্বীকার করেছেন। তার মানে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন।

আচ্ছা, ব্যাপারটা কি পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা যায়? মন্ত্রীর তো গাড়িতে চলাচল করার কথা। তিনি কেন মোটরসাইকেলে চড়ে বসলেন। তার মানে তিনি কি মোটরসাইকেলে চড়ে কোনও অন্যায় করেছেন?

নিশ্চয়ই না। বরং তিনি একটা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছেন। হ্যাঁ, তিনি এক্ষেত্রে সামান্য ভুল করেছিলেন। কিন্তু সেটা বোধকরি তার উদারতার তুলনায় খুবই সামান্য। আর তাই তার ভুলের চেয়ে তার উদারতার দিকটিই বোধকরি বেশি আলোচিত হতে পারতো। কিন্তু সংবাদের ক্ষেত্রে একটি কথা বেশ জনপ্রিয়। তা হলো ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ! মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেলে উঠেছেন এটা হলো ব্যাড নিউজ। কাজেই এই নিউজ বাতাসের আগেই ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে মন্ত্রী যে ফিরতি পথে হেলমেট পরেই এলেন সে ব্যাপারে কোনও পজিটিভ আলোচনা হবে না?

এবার মন্ত্রী পরিষদের সব সদস্য বাসে চড়ে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে গিয়েছিলেন। টুঙ্গীপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের জন্য যাওয়া ও আসার ক্ষেত্রেও মাননীয় মন্ত্রীবর্গ বাস ব্যবহার করেছেন। এটাই হলো পজিটিভ অর্থে পরিবর্তনের গল্প। সরকারের এই উদ্যোগে দেশের সাধারণ মানুষ খুবই খুশি হয়েছে। বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত, বাসে লঞ্চে, গ্রামের রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডায় পরিবর্তনের এই গল্পগুলোই অহংকারের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। তবে একটি পক্ষ বোধকরি পজিটিভ এসব পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা ক্ষেত্রে পজিটিভ বিষয়কেই নেগেটিভভাবে প্রকাশ ও প্রচারের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা ওই প্রবাদবাক্যের মতো– যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।

বর্তমান সময়ের একজন মন্ত্রীর মোটরসাইকেলে চড়ে অফিসে যাওয়ার ছবির সঙ্গে অনেকে অনেক বছর আগে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাইকেলে চেপে অফিসে যাওয়ার ছবি তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করছেন অনেকে। ভাবটা এমন– এরকম কত কিছুই তো দেখলাম। ক্ষমতা গ্রহণের পর শুরুতে অনেকেই এভাবে চমক দেখায়। শেষে আর চমক বলে কিছু থাকে না।

রাজধানীর ব্যস্ত এলাকার একটি চায়ের দোকানে একদিনের আড্ডার চিত্র তুলে ধরি। বলা বাহুল্য, শুধু রাজধানীই নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চায়ের দোকানে আপনি যদি ১০ মিনিট বসে থাকেন তাহলে দেশ-বিদেশের তাবৎ খবর জানতে পারবেন। রাজধানীর ওই চায়ের দোকানের আড্ডায় বিভিন্ন বয়সের ১০/১২ জন মানুষ বসে আছেন। তিনজনের হাতে চায়ের কাপ। মূলত তারাই বক্তা। আর সবাই শ্রোতা। মনে হলো অনেকক্ষণ ধরেই আড্ডা চলছে। একজন ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, আচ্ছা ভাই আমাকে একটা কথার জবাব দেন তো...। ‘এই যে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ঘর ঝাড়ু দেওয়ার ছবিটা ভাইরাল হইলো, এই ছবির মানে কী? তিনি ঘর ঝাড়ু দিতেছেন। দূরে দাঁড়ায়া লোকজন তা দেখতেছে। এই ছবির মাধ্যমে মন্ত্রী কী বুঝাইতে চাইলেন? তিনি কি এইটা বুঝাইতে চাইলেন যে তিনি খুবই সাধারণ। নিজের ঘর নিজেই ঝাড়ু দেন? যদি তা-ই হয় তাহলে এইভাবে ছবি তুললেন কেন? এই ছবিটা কি ভাই তাকে খুব বেশি সম্মানিত করেছে?’ প্রথমজনের কথা শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয়জন কথা টেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘পলক সাহেবের ছবিটাকে আপনি কি বলবেন? তিনি তো ভাই মন্ত্রী। তার তো জানার কথা হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলে ওঠা নিষেধ আছে। তবুও কেন উঠলেন?’ তৃতীয়জন এবার দ্বিতীয়জনের কথা টেনে নিয়ে বললেন–‘ভাই আপনারা যে যেই কথাই বলেন না কেন, এবারের মন্ত্রীরা কিন্তু অন্য যে কোনোবারের মন্ত্রীদের চেয়ে আলাদা। সবাই দেশভক্ত মন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ দিনে দিনে আরও সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবে। কেউ আর আমাদেরকে দাবায়া রাখতে পারবে না...।’

তৃতীয় লোকটিকে মনে হলো স্থানীয় পর্যায়ের কোনও রাজনৈতিক নেতা। তার বক্তব্য শুনে বেশ ভালোই লাগছিল। কথা তো ভালোই মনে হচ্ছে। এখন কাজ ভালো হলেই হয়...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ