X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিজার্ভ চুরি প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:১৩আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:১৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হ্যাকাররা চুরি করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল নিউ ইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকায়। দুই কোটি ডলার গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। নামের বানান অশুদ্ধ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার ব্যাংক সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ না করে নিউ ইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকে ফেরত পাঠায়। ভাগ্যের ফেরে এই দুই কোটি ডলার আত্মসাতের হাত থেকে রক্ষা পায়। অবশিষ্ট ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপাইনে।
ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার জমা হয়। তড়িঘড়ি করে রিজাল ব্যাংকের ডলার ক্যাশ হয়ে কেসিনোতে চলে যায়। ১ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ফিলিপাইন সরকার রিজাল ব্যাংক থেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশকে ফেরত পাঠায়। এখনও ৬ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার অনাদায়ী রয়েছে।
৮২ টাকাপ্রতি ডলারের মূল্য ধরলে বাংলাদেশি টাকায় ৫৩৬ কোটি ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা হয়। এ টাকাটা অনাদায়ী রয়ে গেছে। ফিলিপাইন সরকার তথা তাদের সিনেট ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এ অর্থ হ্যাক করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তা উদ্ধারের ব্যাপারে ফিলিপাইনের সিনেট আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। আমরা প্রদত্ত সহযোগিতার জন্য ফিলিপাইনের সিনেটকে ধন্যবাদ জানাই। তারা রেজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের সেই শাখাপ্রধানকে জেরার সম্মুখীন করেছে এবং সম্পূর্ণ তথ্য উদ্ধার করেছে আর রেজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের সেই শাখাপ্রধানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।

গত বৃহস্পতিবার ১০ জানুয়ারি মামলার রায়ে আদালত শাখাপ্রধান মায়া সেগুইতোকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড প্রদান করেছে, আবার অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করেছে। ফিলিপাইনের প্রচেষ্টায় কোনও ফাঁকফোকর আছে বলে মনে হয় না। রেজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে আদালত ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেছে আর শাখাপ্রধান মায়া দেগুইতোকে ৫৬ বছরের জেল দিয়েছে। সেই সঙ্গে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়েছে। শাখাপ্রধান নিজের অপরাধ স্বীকারও করেছে। এই সবই ফিলিপাইন একতরফা নিজেরাই করেছে। এখানে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও প্রকাশ্য তৎপরতা আমরা লক্ষ করিনি।

রেজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের আরও ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, যা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ফিলিপাইনে অনুরূপ ঘটনা আরও ঘটেছে, যে কারণে ফিলিপাইনকে অর্থপাচারের দায়ে জাতিসংঘ কালো তালিকাভুক্ত করেছিল।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ দুর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনটি তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার পর বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দীনকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ফরাস উদ্দীন কমিটি তদন্ত করে তার রিপোর্ট সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে হস্তান্তর করেছিলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এ রিপোর্ট কখনও প্রকাশ করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে এ রিপোর্টটি মিডিয়ায় এসেছে, তা নিয়ে পরে আলোচনা করবো। দ্বিতীয় তদন্ত বাংলাদেশের সিআইডি সম্পন্ন করেছে। কিন্তু তাদের তদন্ত রিপোর্টের কোনও তথ্য আমাদের হাতে পৌঁছেনি। তৃতীয় তদন্ত করেছে আমেরিকার এফবিআই। তারা বলেছে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারেরা এ কর্মটি করেছে এবং চাইনিজ (হংকংভিত্তিক) হ্যাকারেরাও জড়িত বলে তারা অনুমান করছে।

বাংলাদেশের অর্থ দফতর বা বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টি নিয়ে সীমাহীন গাফেলতি করেছে। দীর্ঘ তিন বছর অতীত হতে যাচ্ছে, তারা এখনও বিষয়টি নিয়ে কোনও মামলা করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব নিশ্চিত একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদ কিন্তু অতিরিক্ত আবেগের কারণে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। আর তিনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট লোক। ব্রিলিয়ান্ট লোক বেশিরভাগই অহংকারী হয়। সে দোষও তার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানও ব্রিলিয়ান্ট লোক ছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই অর্থমন্ত্রী মুহিত ও আতিউর রহমানের মাঝে সুসম্পর্ক ছিল না।

আতিউর রহমানের সঙ্গে নাকি ফিলিপাইনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। আর এ দুর্ঘটনার পর ফিলিপাইনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানকে অনুরোধ করেছিলেন বিষয়টা প্রকাশ্যে না বলার জন্য। কারণ, তারা হ্যাকারদের ধরার চেষ্টা করছে, বিষয়টি প্রকাশ পেলে হয়তো বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। এ কারণে আতিউর রহমান বিষয়টা প্রকাশ করতে ২২/২৩ দিন বিলম্ব করেছিলেন বলে শুনেছি। এ বিলম্বের জন্য আতিউর রহমানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। যতদূর মনে পড়ে, অনুরূপ কারণে রাগ করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আতিউর রহমান গভর্নর থাকলে তিনি অর্থমন্ত্রী থাকবেন না। অথচ উভয়ে রাগারাগি না করে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালালে হয়তোবা অবশিষ্ট টাকাটা এতদিনে উদ্ধার করা সম্ভব হতো।

বাংলাদেশের কর্মকর্তা গেছেন নিউ ইয়র্কে মামলা করার জন্য। তারা ফিরে এসে বলেছেন সবকিছু গোপনীয়তার স্বার্থে বলা যাবে না, মামলা হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। অথচ আমেরিকায় আইন আছে ঘটনার তিন বছর অতিক্রম হলে মামলা শুদ্ধ হবে না। এ বিষয়টার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি অনুরোধ জানাবো। ৪ ফেব্রুয়ারি অতিক্রম করলে বিষয়টা বার্ড বাই লিমিটেশনের মাঝে পড়ে যাবে। তখন মামলা নিষ্ফলা হয়ে যাবে। এখন ফিলিপাইনের রেজাল ব্যাংকিং করপোরেশনকে ফিলিপাইনের আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং এখন মামলা করলে রেজাল ব্যাংক টাকা দিতে বাধ্য হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারো অবহেলার কারণে বাংলাদেশের স্বার্থ যেন বিনাশ না হয়।

এবার ফরাস উদ্দীন কমিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পর্যালোচনা করবো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুজন কর্মকর্তার যোগসাজশ সম্পর্কে গভীর সন্দেহ রয়েছে। উপ-পরিচালক জিএম আব্দুল্লাহ্ ছালেহীন ও মুখলেসুর রহমানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ দুই কর্মকতার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন করা জরুরি। আবার অপারেশন বিভাগের জিএম রাহাত উদ্দীন, যুগ্ম-পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা, মিজানুর রহমান ভুঁইয়া, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দীন ও রফিক আহাম্মদ মজুমদারের বিরুদ্ধে কর্তব্যে মারাত্মক অবহেলা, অদক্ষতা, অসতর্কতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা বলা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার ডিলিং রুমের ব্যাক অফিস (যে অফিস থেকে বিদেশের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন করা হয়) ছিল একটা আড্ডাখানা। এখানে গানশোনা, জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা, ফেসবুকে চ্যাটিং করার মতো গর্হিত কাজ করা হতো। অথচ এ রুমটার এতই গোপনীয়তা রক্ষা করার কথা, যাতে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ কোনোক্রমে প্রবেশ করতে না পারে।

অনুরূপভাবে আর একটি অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ব্যবহৃত আরটিজিএস-এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সুইফট সিস্টেমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কম্পিউটারসহ তিনটি স্থানীয় ব্যাংকের কয়েক হাজার কম্পিউটারের লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক সংযোগ দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় কোনও বিশেষজ্ঞের মতামত না নিয়ে সংযোগ দেওয়া মোটেই ঠিক হয়নি। এ প্রক্রিয়ায় সুইফট-এর ফায়ারওয়াল বা নিরাপত্তা বেষ্টনী সরিয়ে ফেলা হয়। এর মাধ্যমে ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকেই সাইবার অপরাধীদের রিজার্ভের অর্থ চুরির সুযোগ করে দেওয়া হয়।

উপরের তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু কথা উল্লেখ করেছি। আরও বহু কথা উল্লেখ করলাম না। তবে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর হাতে নিশ্চয়ই ফরাস উদ্দীন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি পৌঁছেছে। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, আগের অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে কোনও কার্যকর পদক্ষেপই নাকি গ্রহণ করেননি। শুধু কয়েকজন অফিসারের ডেস্ক  পরিবর্তন করেছিলেন। অথচ অভিযোগের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই শাখাটার পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন ছিল। আশা করবো মোস্তফা কামাল সাহেব তদন্তে উল্লেখিত ডিফেক্টগুলো সরানোর ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবেন এবং প্রয়োজনে সন্দেহজনক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ