X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বাংলাদেশ

বিনয় দত্ত
১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪১আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৫৭

বিনয় দত্ত নতুন বছর, নতুন সরকার, নতুন প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা। ২০১৮ সাল অনেক আলোচিত বছর হলেও ২০১৯ যে আলোচনার বাইরে থেকে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। গত বছর আমি মুক্তিযুদ্ধ, নারী ও শিশু অধিকার, মানবাধিকার, তরুণদের সমস্যা ও সুবিধা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছিলাম। আশা করি নতুন সরকার সেইসব বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেবেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন। ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে তরুণ ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লাখ। এসব তরুণের বড় অংশ, প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ এবারই প্রথম ভোট দিয়েছেন। নতুন সরকার এই বিশাল তরুণদের মনস্তত্ব ও তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। যদিও সারা দেশে প্রায় ২৭ লাখ তরুণ এখনও বেকার। এই বিশাল সংখ্যক তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি হয়তো বিশেষভাবে জোর দেওয়া হবে বা তাদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে নতুন সরকার আলাদাভাবে ভাববেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তারা পারিশ্রমিক হিসেবে ২০০ কোটি ডলারের বেশি নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছেন। টাকার অংকে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এই সব বিদেশি কর্মকর্তার বেশিরভাগই চীন দেশের। আমাদের দেশে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি হচ্ছে না দেখে বাইরের দেশ আমাদের টাকা নিয়ে যেতে পারছে। নতুন বছরে সরকার এই বিষয়ে আরও জোর পদক্ষেপ নেবেন আশা করি।

বছরের শুরুর দিকে যশোর রোডের শতবর্ষী গাছ কাটা নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হলেও তা সমাধান হবে বলে আশা করি। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো হয়। এইসব নারী শ্রমিকদের ওপর কী পরিমাণ অত্যাচার, নিপীড়ন হয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেইসব শ্রমিকদের কেউ কেউ বলেছেন, সৌদি আরবে যেন কোনও নারী শ্রমিক পাঠানো না হয়। এই কথা থেকেই বোঝা যায় নারীরা কতটা অসহায় সেখানে। শুধু নারী শ্রমিক নয়, মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশে আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশের বিষয়ে নতুন সরকার খুব জোরালোভাবে কাজ করবেন আশা করি।

ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতনের শিকার, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা সহ অনেক মর্মস্পর্শী খবর আমাদের জানতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে। এই সংবাদটি আমাকে খুব পীড়িত করে। আমি ধর্ষণের খবর শুনে খুব অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যাই। আমার কাছে মনে হয়, আমরা এতবছরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিরোধ গড়তে পারলাম না। ধর্ষণের খবর শুনে বা পড়ে আমি রাতে স্বস্তিতে ঘুমাতে পারি না। বার বার মনে হয়, আমার তো একটা মেয়ে আছে। সে কি আগামী দিনে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে?

২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ত্রিশোর্ধ্ব এক নারীকে ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় কারণে চরজব্বার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন তার দলবল নিয়ে গণধর্ষণ করে। আমি জানি না এই ধর্ষণের বিচার কখনও হবে কিনা।

আমাদের পাশের দেশ ভারতে ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। এই একটি ঘটনা যেমন ভারতকে নারী বা শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে সতর্ক করে তোলে, তেমনি গোটা বিশ্বের কাছে তা আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা এইরকম কোনও দৃষ্টান্তের জায়গায় যেতে পারিনি। হয়তো নতুন বছরে যেতে পারবো আশা করি।

২০১৯ সালের ১ জানুয়ারিতে রাজধানীর মালিবাগে বাসচাপায় নাহিদ পারভীন পলি ও মিম নামের দুইজন তরুণী মারা গিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের দৌরাত্ম সারা বছর ঢাকা সহ গোটা দেশবাসী ভয়ংকর ভোগান্তিতে ফেলেছে। এখনও পর্যন্ত কোনও পরিবহন শ্রমিকদের বিচার হয়নি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরও সেই পরিবহন শ্রমিককে আদালত থেকে শাস্তি দেওয়ার পরে সারা দেশের মানুষ কী ভোগান্তিতে পড়েছিল তা নিশ্চয় আর কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। শুধু সিটিং বাসের দৌরাত্মের কারণে ঢাকার জনগণকে দফায় দফায় ভোগান্তি ফেলেছে এই পরিবহন শ্রমিকরা। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল আমাদের কোমলমতি শিশুরা। যেই পরিবহন শ্রমিক নিয়ে এতো অসন্তোষ সেই পরিবহন শ্রমিক সহ গোটা সড়ক, যোগাযোগ ও পরিবহন খাত নিয়ে আশা করি সরকার নতুন কিছু ভাববেন।

২.

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন এটা একটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে আমাদের দেশে। রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী নেতারা কারণে অকারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর যখন তখন যেকোনও অজুহাতে নির্যাতন, অত্যাচার চালায়। ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর সিঙ্গিয়া শাহপাড়ায় মটা সাহার বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগও আছে।

নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, আগুন দেওয়া এ যেন একটা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই একটি ব্যাপারে বাংলাদেশের গোটা ইতিহাসে কেউই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। নতুন সরকার এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন আশা করি।

আমাদের দেশে চিকিৎসা খাত নিয়ে নতুন করে ভাবার আছে। শিশু রাইফার মৃত্যু বা গর্ভবতী পারভীনের নবজাতক সন্তানের অর্থাভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা আমাদের খুব পীড়িত করেছে। দেশের অলিতে, গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট মেডিক্যাল ও ক্লিনিক গড়ে ওঠা কোনও ভালো লক্ষণ নয়। প্রথমত এইসব প্রাইভেট মেডিক্যাল ও ক্লিনিকে কোনও সুনির্দিষ্ট তদারকি করা হয় না। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যসেবা দিনকে দিন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, এসব বিষয় সরকার নতুন কিছু ভাববেন আশা করছি।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানো নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। তথ্যপ্রযুক্তিতে সার্বিক উন্নয়ন যেমন জরুরি তেমনি জরুরি গবেষণায় প্রচুর বিনিয়োগের। শুধুমাত্র গবেষণায় অর্থের বরাদ্দ না পেয়ে দেশে মেধাবী শিক্ষকরা বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আর দেশে ফিরছেন না। এই বিষয় নিয়ে সরকার নতুন করে ভাববেন আশা করি।

শিক্ষাক্ষেত্রে নারী শিশুদের বিদ্যালয়ে আনা এবং বছরের প্রথমদিন বিনামূল্যে বই বিতরণ করা এইটা নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন বা হেফাজতের দাবির মুখে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবইয়ে প্রগতিশীল এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী লেখকদের লেখা তুলে ফেলা– এটা ভয়ানক আত্মঘাতীমূলক কাজ। তাছাড়া শিক্ষকদের কারণে অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা আমাদের জানান দেয় যে, আমাদের শিক্ষাখাত কতটুকু নাজুক অবস্থায় আছে। শিক্ষাখাত নিয়ে নতুন সরকারের সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে। শিক্ষাখাত দুর্বল হলে দেশে দক্ষ মেধাশক্তি তৈরি হবে না।

এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সরকারের কিছু উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয় তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করা, যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক তালিকা তৈরি করা বা যুদ্ধদিনের বিভিন্ন ছবি বাইরের দেশ থেকে এনে আর্কাইভ করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরি করে তা সকল পাঠ্যবইয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। এতে করে নতুন প্রজন্ম তাদের চিনবে, জানবে এবং ঘৃণা করবে।

বহুল প্রত্যাশিত সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। দস্যুমুক্ত হওয়ার জন্য বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের নিরলস চেষ্টা বৃথা যেতে পারে না। এখন সময় এসেছে সুন্দরবনকে আরো আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তোলার। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষা করার তথা সুন্দরবনের সার্বিক কল্যাণে নতুন যুগপোযগী পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার। নতুন সরকার আশা করি এইদিকে সুদৃষ্টি দিবেন।

৩.

এই লেখার অর্থ পাঠকদের হতাশায় ফেলে দেওয়া নয়, এই লেখার অর্থ পাঠক সহ সচেতন নাগরিকদের আরও সচেতন করে তোলা। আমাদের দেশে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই এগিয়ে যাওয়াকে অক্ষুণ্ন রাখতে নতুন সরকারের উচিত গঠনমূলক ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা নেওয়া। যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি দেশের এগিয়ে যাওয়াকে রোধ করতে না পারে, যাতে যুদ্ধাপরাধীরা দিনের আলোয় জেগে ওঠে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানকে কলুষিত করতে না পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমিও বলতে চাই,

 

“আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।।”

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ