X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:০১আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ২১:১০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন, ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি আর তা গত সেপ্টেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। আর দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা ঋণ ব্যাংক অবলোপন করেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পত্রিকাগুলো বলেছে, খেলাপি ঋণ হচ্ছে দেড় লক্ষ কোটি টাকা আর অবলোপন করা ঋণ হলো ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
আমরা অর্থমন্ত্রীর প্রদত্ত অংকটাকেই গ্রহণ করেছি। ৫০/৬০টা ব্যাংক, লাখ লাখ কোটি টাকা লেনদেন, তাতে কামাল সাহেবের প্রদত্ত টাকার অংকটা যদি খেলাপি হয়ে থাকে তবে তা সীমা অতিক্রম করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সময় ব্যাংকে সুশাসন বিঘ্নিত হয়েছিল। কামাল সাহেব যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তবে খেলাপি ঋণ আদায় হওয়া কঠিন হবে না। যেকোনও প্রতিষ্ঠান নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চললে আবর্জনার স্তূপ হতে পারে না। আমাদের দেশে নিয়ম-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা করে না বলে বিপদ এসে উপস্থিত হয়।

বেসিক ব্যাংকটি খুবই ভালো ব্যাংক ছিল। ব্যাংকটার ব্যবসা বিদেশি ব্যাংকদের থেকেও ভালো চলছিলো। হঠাৎ করে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পরিবর্তন করে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু নামক এক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করা হয়। বেনামে অ্যাকাউন্ট করে এই শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু ব্যাংকটিকে ফতুর করে দেন। ৮০% মূলধন সরিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার পরও তাকে স্বপদে অব্যাহত রাখা হয়। তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার মাত্র একদিন আগে সেই আব্দুল হাই বাচ্চু পদত্যাগ করেন। এখন নাকি সে ওয়াটার ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করেন। এখনও তার কাছ থেকে ৬০%  টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনও মামলাও হয়নি। এই টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে মন্ত্রণালয় কেন অপসারণ করেনি তার রহস্য উদঘাটন হওয়া উচিত। ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরে মন্ত্রণালয় কোনও কথা বলে না। ক’দিন আগে নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরে ছড়ি ঘুরাতে গিয়েছিলেন। গভর্নর পদত্যাগ করে চলে গেছেন। আমরা অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেবের কাছে অনুরোধ জানাবো এই আব্দুল হাই বাচ্চুকে যেন আইনের আওতায় আনা হয়।

দুদক যদি আব্দুল হাই বাচ্চুর মতো ‘ক্রিমিন্যালকে’ আইনের আওতায় আনতে না পারে তবে দুদক অবলুপ্ত হওয়া উচিত। আর প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো আপনার আগামী পাঁচ বছর হোক অন্যায়ের মূল উৎপাটনের বছর। ব্যাংক সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বেসিক ব্যাংকের আব্দুল হাই গংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব অনেক কিছুকেই ‘মাই সে, মাই অর্ডার’ মনে করতেন। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বৈঠকের আয়োজন করিয়েছিলেন। এটা ছিল সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত, যা আগে কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। তাতে তিনি ব্যাংক মালিকদের দাবি অনুসারে বেসরকারি ব্যাংকের নিয়মে ধার্য করা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও হ্রাস করার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। তিনি তখন আমানতকারীদের স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন।

সিলেটে এক অনুষ্ঠানে তিনি ফার্মারস ব্যাংকের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনও ব্যাংক দেউলিয়া হয় না’– অর্থাৎ আমরা ব্যাংকের অনিয়মের গর্ত ভর্তি করার জন্য বস্তা বস্তা রাষ্ট্রীয় অর্থ নিয়ে বসে আছি। আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। অ্যাকাউন্টেসের লোক সাধারণত কনজারভেটিভ হয়ে থাকেন। আশা করি অর্থ খরচের ব্যাপারে তিনি বেহিসাবি হবেন না। কামাল সাহেব অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ঋণখেলাপি আর ব্যাংকের অনিয়ম প্রতিরোধের বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন তাতে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি তিনি দৃঢ়হস্তে সব জঞ্জাল পরিষ্কারে উদ্যোগী হবেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো যেন অর্থ মন্ত্রণালয়কে শতভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করেন।

আমি আগেও আমার লেখায় দ্বৈত শাসনের বিরোধিতা করেছি। মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে তফসিলি ব্যাংক সরকারি হোক বেসরকারি হোক সম্পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করার কথা সুপারিশ করেছিলাম। পাকিস্তানের সময়ে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের কন্ট্রোলার অব সিডিউল ব্যাংক নামে একটা ডিভিশন ছিল। তারাই তফসিলি ব্যাংকের ভালোমন্দ দেখাশুনা করতো। এখন দেখা যায় ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় গুরুতর অভিযোগের কারণে তফসিলি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। অথচ রাষ্ট্রীয় খাতের তফসিলি ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। ৪৭ ধারায় এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মন্ত্রণালয়।

বেসরকারি তফসিলি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ৬% আর সরকারি তফসিলি ব্যাংকে এ হার ৩০%। সর্বোপরি ব্যাংকিং ডিভিশনের কারণে কখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সুসম্পর্ক থাকে না। কঠোর নিয়ন্ত্রণ নেই বলে প্রত্যেক বার্ষিক বাজেট সরকারি তফসিলি ব্যাংকগুলোকে মূলধন সরবরাহ করতে হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং নতুন অর্থমন্ত্রীকে ওপরের বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাবো। ৪৬ ও ৪৭ ধারার বিলুপ্তির কথাও বলবো এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সোপর্দ করার অনুরোধ জানাবো।

অনেক সময় মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা বা পরামর্শ উপেক্ষা করে চলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে কান না দিয়ে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাইকে ব্যাংককে ফতুর করে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষও এখন সচেতন। এক রিকশাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে যে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো টিকবে কিনা? মিডিয়াগুলো যখন হৈ চৈ ফেলে দেয় তখন ভয় হয় সাধারণ মানুষের কাছে কোন ফাঁকে কোনও ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে কিনা?

যাক, এবার চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ব্যবসাটা নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দর ওঠানামার কারণে ব্যবসাটা খুব মার খেয়েছে। ৩০ বছরের পুরনো ব্যবসায়ীও এখন এলসি খুলতে পারছেন না। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, তাদের বিষয়টা যেন সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেন। না হয় এ ব্যবসাটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ব্যবসার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের উভয় পাশে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জন্ম নিয়েছে। ব্যবসাটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ব্যবসা চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণ সঞ্চালন করে রেখে ছিল।

শিপ ব্রেকারদের অনাদায়ী ঋণ ব্লক করে সুদ স্থগিত করে পরিশোধের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এ ব্যবসাটা বিশাল ব্যবসা, অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করবো তিনি যেন এ ব্যবসার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং দুর্যোগ উত্তরণে ব্যবসায়ীদের সাহায্য করেন। এ সেক্টরের ব্যবসায়ীদেরও অনুরোধ করবো তারা যেন বিষয়গুলো মিডিয়ার কাছে খোলামেলাভাবে তুলে ধরেন। ব্যবসায়ীরা ‘লুটেপুটে’ খাচ্ছে অনুরূপ সস্তা স্লোগানে বিভ্রান্ত হলে চলবে না, অর্থনীতির ৮২% হলো ব্যবসায়ীরা। সুতরাং তাদের অবহেলা করলে অর্থনীতি মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনীতির ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিলো শিপ ব্রেকিং ব্যবসা। শিপ ব্রেকিং ব্যবসাটাকে যদি যথাযথ পরিচর্যা করা না হয় তবে বিরাট অংকের লগ্নি খেলাপি হতে পারে।

দেশে অনেক ব্যাংক আছে। পুনরায় নাকি ৪টা ব্যাংকে নতুন অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এ দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের পরিমাণের চেয়ে ব্যাংক বেশি বলে মনে হয়। ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করতে গিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নাকি ভেঙে গিয়েছিল তার বিশালত্বের কারণে। প্রতিটি ব্যাপারে আনম্যানেজেবল সাইজ পরিহার করা উচিত।

সরকারি ব্যাংকগুলোতে বোর্ড গঠনের সময় বা চেয়ারম্যান নিয়োগের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রদান করে। একটা রাজনৈতিক দল নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনায় দেবে তা তো বিচিত্র কিছু নয়। যেহেতু অনুরূপ বিবেচনায় শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর মতো লোক নিয়োগ পায়, তাহলে এবার নিয়োগের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ