X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জমি খাস করি চাষ

আনিস আলমগীর
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩২আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৪

আনিস আলমগীর নদীর ধারে রাস্তার পাশে সরকারি খাস জমিতে যেসব ঘরবাড়ি উঠেছে, সরকার নির্বিচারে তা ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেখলাম বহুতল ভবন ভেঙে ফেলতেও সরকার কোনও মায়া দেখাচ্ছে না। আইন যখন কাজ করে তখন তা নির্মম হলেও সাধারণ মানুষ খুশি হয়। নির্মম না হলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। তাই আইন প্রয়োগে শীতলতা দেখাতে নেই।
অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে নদীগুলো ভরাট করে ভূমিদস্যুরা জমি দখল করছে। সরকার যদি আর কিছু দিন অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে তবে তুরাগ নদী, বালু নদী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী সবই হারিয়ে যাবে। হাইকোর্ট গত তিন ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এক নির্দেশে নদী দখলদারিত্বকে ক্রাইম হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন এবং সাজা নির্ধারণের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দখলদাররা যাতে কোনও ব্যাংক লোন এবং যেকোনও নির্বাচন করার সুযোগ না পায় তাও দেখার নির্দেশ দিয়েছেন সরকারকে।  

শহরের পাশে নদীগুলোর মূল সমস্যা দূষণ। প্রতিদিন শহরের বর্জ্য, কলকারখানার বর্জ্য নিকাশী নর্দমার বিপুল পরিমাণ বর্জ্য এ নদীগুলোতে পড়ছে। এমন নর্দমার সংখ্যা বহু। নদীর জলের নিরাপদ মাত্রা যা হওয়া উচিত বুড়িগঙ্গার জল তারচেয়ে কোথাও কোথাও ৮ লক্ষগুণের বেশি দূষিত (এ হিসাবটা দিয়েছি কলকাতার গঙ্গা নদীর হিসাব থেকে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা থেকে বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গার দূষণ বেশি)।

পান বা গৃহস্থালির কাছে ব্যবহার করা তো দূরের ব্যাপার, এ পানিতে গোসল করাও মারাত্মক ক্ষতিকর। কামরাঙ্গীরচরের আশপাশে তো বুড়িগঙ্গা নদী প্রায় ভরাট করে ফেলেছে। সদরঘাট, সোয়ারিঘাটের বরাবরে নদীর ধারে যেসব আড়ত গড়ে উঠেছে তার বর্জ্য অহরহ ফেলছে নদীতে। এখন বুড়িগঙ্গার তলদেশে এসব বর্জ্যে ৭ ফুট পুরু স্তর পড়ে গেছে। এ স্তরটা তুলতে ড্রেজারের সময় ক্ষয় হচ্ছে প্রচুর, তাতে ড্রেজিংও ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। যে কারণে একবার ড্রেজিং আরম্ভ করেও বন্ধ করে দিয়েছে।

পলিথিন তো ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় করছে। শাজাহান সিরাজ মন্ত্রী থাকার সময় পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। কার নিষেধ কে মানে। এখন পলিথিনের উৎপাদন সমানে চলছে। পলিথিন শত বছরেও পচে মাটির সঙ্গে মিশে না। অথচ ক’দিন পর পর যিনি পাট মন্ত্রী হন তিনি আশার বাণী শুনিয়ে বলেন পাটের বাজার চাঙা হবে, পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা হবে। এ কথা শুনে আসছি কয়েক দশক ধরে।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ, গবেষকরা এরই মাঝে অধিক ফলনশীল ধান বীজ আবিষ্কার করেছেন, লবণাক্ত জায়গায় ধান উৎপাদনের জন্য লবণ পানি সহনীয় ধান বীজ আবিষ্কার করেছেন কিন্তু পাট গবেষণার এবং পাট দিয়ে মসৃণ সুতা তৈরি করে ব্যাগ তৈরির কোনও ব্যবস্থা এখনও চোখে পড়ে না। এসব বিষয়ের পেছনে সময় ব্যয় করতে হবে। এসব বিষয়ে যত্নবান না হলে পলিথিনের হাত থেকে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

ইউরোপের পলিথিন সামগ্রী ও বর্জ্য ভূমধ্যসাগরে ফেলে ফেলে সাগরটিকেই পলিথিনের সাগরে রূপান্তরিত করেছে। পলিথিন সামগ্রী সারা সাগরময় হয়েছে। এখন সুইপার মেশিন দিয়ে সাগর পরিষ্কার করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। ইউরোপের মতো সভ্য মানুষগুলোও সাগরে বর্জ্য ফেলার পরিণতিটা উপলব্ধি করেনি এটা অনুতাপের বিষয়। সাধারণ মানুষের কথা কী বলবো, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে উপহাস করেন। আমেরিকা প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল অথচ ট্রাম্প আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৮০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির স্তর উঁচু হয়ে কয়েকটা মহাদেশ ডুবে যেতে আরম্ভ করবে। বাংলাদেশের অবস্থাটা তো খুবই নাজুক। উপকূলীয় অঞ্চলটা তো ২০৫০ সারের মাঝে ডুবতে আরম্ভ করবে। এখনই উপকূলীয় মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে। ভারতে দেখেছি বর্জ্য পরিশোধন প্রকল্প তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশেও তা হওয়া উচিত। নয়তো দূষণের কারণে নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক জায়গায় ভূমিদস্যুরা বর্জ্য ইচ্ছাকৃতভাবে নদীতে ফেলে যেন নদী ভরাট হয়ে যায়।

ঢাকা শহরের আশপাশে বহু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে, যার মধ্য দিয়ে পানি সরে যাওয়ার বহু নালা রয়েছে, যা সরকারি জমি। আবাসন প্রকল্পের মালিকেরা এসব নালা পরিচর্যা না করে ভরাট করে ফেলছে। অথচ অদূর ভবিষ্যতে এ আবাসন প্রকল্পগুলোতে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা উদ্ভব হবে। সরকারের অমনোযোগিতাই এর প্রধান কারণ। খাস জমিতে নালা, তা ভরাট করে ফেলছে, সরকারি কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখছেন না।

ক’দিন ধরে দেখছি হকার উচ্ছেদও চলছে। এটা একটা রুটিন কাজের মতো হয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের। ক’দিন পর পর করতে হয়। না হয় শহরের তিলোত্তমাগিরি ঠিক থাকে না। দুর্ভাগ্য যে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে না বা বাড়ছে না। গত ২০১৬ এবং ২০১৭ সাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান টার্গেট ছিল ৩৯ লাখ চাকরির, কিন্তু অর্জিত হয়েছে ১৭ লাখ ৮ হাজার (ডেইলি স্টার, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না কর্মসংস্থান। আমি অর্থনীতিবিদ নই তাই জানি না প্রবৃদ্ধি কখনও কখনও প্রতিবন্ধী হয় কিনা? আমাদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক কোনও নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে না। তাই মানুষ জীবিকার অন্বেষণে হকারগিরি না করে উপায় কী! ভারতেও একই অবস্থা।

ঢাকার লোকসংখ্যা বেশি। সুতরাং হকারের জন্য ভালো মার্কেট। যে যা নিয়ে বসে তা বিক্রি করে সংসার চালাতে পারে। আমার চেনাজানা এক  পান-সিগারেটের হকার আছে, তার দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ছেলেরাও মাঝে মাঝে এসে বাবাকে সাহায্য করে। ডা. বিধান কৃষ্ণ সেন যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন তিনি হকার পুনর্বাসনের জন্য বিধান হকার মার্কেট করেছিলেন। কলকাতায় এটাই এখন পর্যন্ত হকারদের জন্য বড় পুনর্বাসন প্রকল্প।

ডা. বিধান কৃষ্ণ সেন এ হকার মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেওয়ায় পর যেসব হকারকে দোকান দিতে পারেননি তিনি তাদের ফুটপাতের রেলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে মালামাল বিক্রি করার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। কলকাতাও বড় শহর। অল্প পুঁজির হকারিতেও সংসার চলে। কর্মসংস্থান করতে না পারলে মানুষকে তো স্ব-উদ্যোগে কিছু করে খাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এখানেও আবার নিরুপদ্রব নয়, সরকারি দলের লোকদেরও কিছু দিতে হয়। আবার পুলিশের তোলাবাজি তো আছেই।

সত্য মিথ্যা জানি না, শুধু ঢাকা শহরেই নাকি পুলিশের দশ কোটি টাকার তোলা বাণিজ্য হয় মাসে। ঢাকা থেকে আসলে হকার উচ্ছেদ কখনও সম্ভব নয়। রুজি রোজগারের পথ বন্ধ না করে কীভাবে হকার সমস্যা সমাধান করা যায় সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। এক হকারকে বলেছিলাম রাজত্ব পাওয়ার মতো ফুটপাত দখল করে চলার চেষ্টা করো কেন, একটু তো রাখঢাক রেখে চলতে পারো। হকার উত্তরে জানিয়েছে, দল ও পুলিশকে রীতিমতো টাকা দিয়ে জায়গা নিয়েছে। আবার ডেইলি চাঁদা দেই। বিনা পয়সায় পসরা সাজাইনি। সরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। হকারদের এ স্বীকারোক্তিকে হিসাবের মধ্যে ধরলে হকারমুক্ত ঢাকা কখনো সম্ভব নয়। পরিস্থিতিও বলে বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া হকার সরানো সম্ভব হবে কীভাবে?

বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেরি হয়নি। মাদক, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি নিয়ে এখন সরকারের মাতামাতি করা উচিতের বাইরে নয়। জনস্বার্থবিরোধী কোনও পদক্ষেপ নেওয়া ভালো হবে না। কোনোখানে যেন অতিশাসন চাপিয়ে দেওয়া না হয়। অতিশাসন চাপালে তা অপশাসনে রূপান্তর হবে। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতির বয়স আর মানব সভ্যতার বয়স সমান। চানক্য তার লিখিত ‘অর্থনীতি’ নামক বইতে লিখেছেন, মাছ যেমন পানিতে পানি খেলে বোঝা যায় না তেমনি রাজকর্মচারীরা দুর্নীতি করলে সহজে টের পাওয়া যায় না। চানক্য সমুদ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। কয়েক হাজার বছর আগের মানুষ।

জুটমিল শ্রমিক জাহালমকে আরেকটি জজ মিয়া সাজিয়ে দুদক এবার যা করলো তাতে সংস্থাটির প্রতি মানুষের বিশ্বাসে ভাটা পড়বে। দুর্নীতি দমন করার জন্য সবার আগে দরকার সরকারের সদিচ্ছা, দুদকে দক্ষ এবং সৎ কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেওয়া। রাতারাতি কিছু করে লোক দেখানো এবং চুনুপুঁটি ধরা বাদ দিয়ে সমাজ থেকে দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ