X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাসদের হঠাৎ বিপ্লব!

প্রভাষ আমিন
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:০১আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:০৮

প্রভাষ আমিন দু’দিন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘বহুদিন হয়ে গেলো, ইনু ভাই বিএনপির বিরুদ্ধে কিছু বলেন না!’ স্ট্যাটাসটা দেখে মনে হলো, তাই তো, বহুদিন হলো, ইনু ভাই শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে নয়, আসলে তেমন কিছুই বলছেন না। মাসখানেক আগেও যিনি প্রায় প্রতিদিন কথা বলতেন, খালেদা জিয়াকে নানা উপাধিতে ভূষিত করতেন, তিনি এখন একেবারে চুপ মেরে গেছেন। তার কি ঠোঁট চুলকায়? জানি না। হয়তো তিনি এখনও বলেন। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী নেই বলে, সেগুলো মিডিয়ার নজর কাড়তে পারে না। মিডিয়ার সার্বক্ষণিক নজরে থাকা একজন মানুষ হঠাৎ এমন আড়ালে চলে গেলে কেমন লাগে? জানি না। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়ার পর হাসানুল হক ইনু বিভিন্ন টিভির টকশো’তে অংশ নিয়ে সরব থাকার চেষ্টা করেছেন। ইদানীং তাও দেখা যাচ্ছে না।

তবে দুদিন আগে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘কে বিরোধী দলের আসনে বসবে আর কে বিরোধী দলের আসনে বসবে না, এটা নির্ধারণ করার এখতিয়ার বা মালিক আওয়ামী লীগ এবং অন্য কেউ নয়। এই সিদ্ধান্ত স্ব-স্ব দল গ্রহণ করবে। এছাড়া কেউ যদি সরকারের নির্দেশে বিরোধী দল হয়, তাকে আমি এককথায় বলবো ফরমায়েশি বিরোধী দল। ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে ছিলাম, এখনও আছি। আমি রাজনৈতিক কারণে ১৪ দলীয় জোট থাকার প্রয়োজনীয়তা মনে করছি। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদ ও রাজাকাররা এখনও আত্মসমর্পণ করেনি, তওবা করেনি। তারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হলেও চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করেনি। সুতরাং জোটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা জোটগতভাবে ভোট করেছি এবং সংসদে জোটবদ্ধ থাকবো। এর বাইরে আওয়ামী লীগ যদি অন্য কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা জোটের শরিকরা বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।’

হায় হায় একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। খালেদা জিয়াকে অগ্নিসন্ত্রাসী আর বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বলতে বলতে যার মুখে ফেনা উঠে যেতো, এখন তার মুখেই কিনা আওয়ামী লীগের সমালোচনা। এটা ঠিক, ১৪ দল এখন বেশ বেকায়দায় আছে। মন্ত্রিসভায় তাদের কারও ঠাঁই হয়নি। সংসদে তাদের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৪ দলের শরিকদের বিরোধী দলের আসনে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু নৌকা মার্কায় ভোট করে, উন্নয়নের কথা বলে ভোট চেয়ে এখন সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসাটা তাদের জন্য বিব্রতকর। তারচেয়ে বড় কথা, একাদশ সংসদে বিরোধী দলের আসন ইতোমধ্যেই পূর্ণ। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল, এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা। এরশাদের পেছনে বিরোধী দলের আসনে বসা ইনু-মেননদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। এতদিন আওয়ামী লীগকে সার্ভিস দিয়ে এখন এভাবে ‘নোবডি’ হয়ে যাওয়াটা ১৪ দলের শরিকদের জন্য অবমাননারও। এবার কিছু না পাওয়ায় তাদের একটু অভিমান হতেই পারে। আমি নিশ্চিত, মন্ত্রিত্ব পেয়ে গেলে হাসানুল হক ইনু আবার খালেদা জিয়া আর বিএনপির বিষোদগারে মনোযোগী হবেন; আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না।

তবে মূল জাসদের চেয়েও বড় বিপ্লবী বাংলাদেশ জাসদ। আদর্শের প্রশ্নে নয়, নেতৃত্বের প্রশ্নে সম্প্রতি আবারও ভেঙেছে জাসদ। ৭২ সালে জন্মের পর ৪৭ বছরে জাসদ কতবার ভেঙেছে সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। সর্বশেষ ভাঙনে শরিফ নুরুল আম্বিয়া, নাজমুল হক প্রধানরা হাসানুল হক ইনু আর শিরিন আক্তারদের ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। তারা বাংলাদেশ জাসদ নামে আলাদা দল করে নিবন্ধনও চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। তবে নির্বাচনে ভাগবাটোয়ারায় বাংলাদেশ জাসদ একটি আসনও পেয়েছে। নিবন্ধন না পাওয়ায় বাংলাদেশ জাসদের প্রার্থীকে নৌকা মার্কায় নির্বাচন তো করতে হয়েছেই, কাগজে-কলমে তিনি আওয়ামী লীগের সাংসদ হিসেবে পরিচিত হবেন। এখন আওয়ামী লীগের সাংসদ মাইনউদ্দিন খান বাদল কীভাবে বিরোধী দল হবেন। না পাওয়ার বেদনায় নীল বাংলাদেশ জাসদও।

গত ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাসদের জাতীয় কমিটির সাধারণ সভায় ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের অতি উৎসাহী অংশ এই নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে’। সভা শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণ উদ্দীপনা ও আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের পরে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছে গোটা জাতি। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রশাসনের একশ্রেণির অতি উৎসাহী অংশ ভোটের পূর্ব রাত্রেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে ১৪ দল তথা মহাজোটের নিশ্চিত বিজয় জেনেও যে মহল বিশেষ এ অপকর্ম সংঘটিত করেছে, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, এ কলঙ্কিত ঘটনার মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এ কলঙ্কের দাগ মুছতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

বিবৃতিতে কোন দলের নাম না থাকলে সবাই ভাবতো এটা বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান। অভিযোগ সত্য-মিথ্যা যাই হোক, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করা কোনও দলের এ অবস্থান অবিশ্বাস্য। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশ জাসদের কাউকে সিকি বা আধুলি মন্ত্রী করে দিলেই তারা এ বিবৃতি গিলে ফেলবেন। জাসদের এ হঠাৎ বিপ্লব কোনও আদর্শিক অবস্থান থেকে নয়, আমার ধারণা, এটা নিছক দরকষাকষি।

অবশ্য জাসদের বিপ্লব নতুন নয়। তারা আজন্ম বিপ্লবী। সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রত্যয় নিয়ে জাসদের জন্ম। তবে তাদের আসল লক্ষ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিব্রত ও উৎখাত করা। মুখে সামাজিক বিপ্লবের কথা বললেও সুযোগ পেয়ে ৭৫’র ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সশস্ত্র বিপ্লবের ব্যর্থ চেষ্টাও জাসদ করেছে। প্রকাশ্য জাসদের সশস্ত্র সংগঠন ছিল গণবাহিনী, ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাও। গণবাহিনীর অন্যতম সংগঠক হাসানুল হক ইনু যে ভাষায় বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সসালোচনা করেন, শুনলে আমার হাসি পায়। হঠকারিতার রাজনীতিতে জাসদের কাছে বিএনপি শিশু। ৭২ থেকে ৭৫ সময়ে জাসদ থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, ঈদের জামায়াতে এমপি খুন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণের চেষ্টা– হেন অপকর্ম নেই করেনি। ১৪ দলে থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ এখনও বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য জাসদকে দায়ী করেন। ৭৫’র ১৫ আগস্ট সকালে জাসদ নেতারাই স্বেচ্ছায় রেডিও স্টেশনে গিয়ে ডালিমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

তাই বলছিলাম, বিপ্লবীপনা জাসদের অনেক পুরনো রোগ। তবে আমি অন্তত কখনও সেই বিপ্লবের চেষ্টায় কোনও আদর্শ খুঁজে পাইনি। যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম গিলিয়ে রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খান হাজারও মেধাবী তরুণের জীবন ধ্বংস করেছিলেন, সেটা যে ভুয়া ছিল; তা তো ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। এখন জাসদ সেই আফিম থেকেও অনেক দূরে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন জাসদের দুই অংশ তো এখন ১৪ দলে বসে বিপ্লব করছে। আর জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আ স ম আব্দুর রব জেএসডি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে বিএনপির পাশে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিপ্লবের চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের আগে তার অনেক হুঙ্কার শুনেছে জাতি। অবশ্য নির্বাচনের আগে সরব থাকলেও আ স ম রব এখন অনেকটাই নীরব। ১৪ দলের শরিক দুই জাসদ এখন বিপ্লবী হলেও ঐক্যফ্রন্টের জাসদ অনেকটাই ম্রিয়মাণ।

তবুও বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা
সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ