X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

খেলনা ফেলনা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫৫আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বাংলাদেশে বিমানের উড়োজাহাজ ‘ময়ূরপঙ্খি’ ছিনতাই চেষ্টার খবর ফলাও করে প্রকাশ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম। এ সময় যাত্রীদের নিরাপদে বের করে আনা এবং ছিনতাইকারীকে হত্যা করে সফলভাবে অভিযান শেষ করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রশংসা করা হয়। এই প্রশংসা আমরাও করতে চাই। পাইলট, কো-পাইলট আর তার ক্রুদের বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তায় বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে বিমানটি। সেনা ও নৌসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে ধন্যবাদ দিতে হয় এই ছিনতাই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বা সিভিল এভিয়েশন থেকে একটি অফিসিয়াল বক্তব্য পাওয়া গেল না যে ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন।

কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর খুব প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করা প্রয়োজন। রোববার এই ঘটনা যখন ঘটে, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মূল নির্মাণকাজ ও লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারপাইলিং প্রকল্প উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন অভ্যন্তরীণ রুটে যাতায়াত করেন তখন এমনিতেই বাড়তি সতর্কতা থাকে। যে রুট তিনি ব্যবহার করেন, সেসব রুটেও শিডিউল কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। আর সেদিনই যদি খোদ চট্টগ্রামগামী বিমানে এমন ঘটনা ঘটে যে, একজন অস্ত্রধারী (খেলনা পিস্তল হলেও) বিমানে প্রবেশ করতে পারে, তবে মানতেই হবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল এবং এতে ত্রুটি রয়েছে।

বিমান প্রতিমন্ত্রী নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি একবার বললেন খেলনা পিস্তল, আবার বলেছেন তদন্ত করে বলা হবে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বলা হলো এটি খেলনা পিস্তল ছিল। একজন পুলিশ বা সেনা সদস্য হাতে নিয়েই বুঝতে পারবেন এটি কি ধরনের বস্তু, এর জন্য তদন্ত করা লাগে কেন, এত সময় লাগে কেন সেটি বিস্ময়কর।

চলচ্চিত্র নায়িকা শিমলার সাথে তার প্রেম, বিয়ে আর ছাড়াছাড়ি নিয়ে যত রসালো আলোচনাই হোক না কেন, মানতেই হবে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় অসুখ গভীরতর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী এই ফ্লাইটের সব যাত্রী, ক্রু ও পাইলট অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পাওয়ার ঘটনাটি বড় স্বস্তির বিষয়। কিন্তু অস্বস্তিও কম নয়। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু র‌্যাব বলছে নিহত ব্যক্তির নাম ক্রিমিনাল ডাটা বেইজে ছিল, সেহেতু তার মোটিভ নিয়ে বড় তদন্তের দাবি রাখে। সিনেমা জগতের বাইরে অন্য কোনও সংযোগ তার শুরু হয়েছিল কিনা, তার ভেতর কোন র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তন লক্ষণীয় ছিল কিনা, সেই অনুসন্ধান প্রয়োজন।

বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিমানবন্দরে যে তল্লাশির ব্যবস্থা আছে, তাতে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে ঘটনাটি ঘটলো কীভাবে? একই কথা বলেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানও। তাহলে যুবকটি কি করে বিমান পর্যন্ত চলে গেল?

আমাদের মনে আছে ২০১৫-১৬ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বিমানবন্দরের টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময়সীমাভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দিয়েছিল যুক্তরাজ্য সরকার। এটি না হলে ঢাকা-লন্ডন রুটে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। দুই দফা ঢাকা সফরের সময় এই অভিমত দেয় যুক্তরাজ্যের বিমান নিরাপত্তাবিষয়ক দফতরের প্রতিনিধিদল।

সে সময় রাশিয়ার একটি বিমান সিনাই উপত্যকায় বিধ্বস্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের তাগিদ দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা বোমায় রাশিয়ার বিমানটি মিসরের শারম আল শেখ বিমানবন্দর থেকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে সিনাই উপত্যকায় বিধ্বস্ত হয়। এরপর থেকে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে তাগাদা দিচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে যুক্তরাজ্যের বিমান নিরাপত্তা বিষয়ক দফতর বিশ্বের ২০টি দেশের নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে থাকা ৩৮টি বিমানবন্দরের যে তালিকা তৈরি করে, তাতে নাম ছিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের।

রোববারের এই উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির বিষয়টিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ছিনতাই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ায় প্রশংসা করলেও এরাই আবার বাংলাদেশকে চাপের মুখে ফেলতে পারে।

আমাদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার একটি বড় সমস্যা ভিআইপি হ্যান্ডলিং। সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তারা তো বটেই, মাঝ পদবীর বহু লোকও বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে ছাড়েন। আরও আছেন রাজনীতিক, কিছু বড় ব্যবসায়ী। এরা নিরাপত্তা তল্লাশি পুরোটা মানতে চান না, এমনকি এদের অনেকেই, বিশেষ করে আমলারা নিজেরা বিমানবন্দরে একাধিক সহযোগী নিয়ে হাজির হন, তাদের লাগেজ নিজেরা না চেক-ইন করে করান অন্য লোক দিয়ে। এরা বুঝতেও পারেন না এই সামন্ত ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজেরাই পড়তে পারেন বড় বিপদে। যে কেউ নিষিদ্ধ কোন কিছু তাদের লাগেজে ঢুকিয়ে দিয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারেন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শৈথিল্যের কিছু ঘটলে সন্ত্রাসীদের বড় টার্গেটও এই ভিআইপিরাই হবেন। এদের প্রতি অতিরিক্ত দৃষ্টি দিতে গিয়ে বিমানবন্দর কর্মীদের অন্য সবখানে নজরে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, বাংলাদেশের মতো, পৃথিবীর আর কোন দেশে এত ভিআইপি প্রটোকল ম্যানেজ করতে হয় না বিমানবন্দর কর্মীদের।

বিমানবন্দরের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা বা ঘাটতির বিষয়গুলো চিহ্নিত করার কাজটি ভালোভাবে চিন্তা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেই বিবেচনায় বিমানবন্দরসমূহে প্রযুক্তির বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। পাইলটদের সঠিক দৃশ্যমানতা বজায় রাখার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন। প্রায়ই শুনি কুয়াশার কারণে বিমান উঠানামায় সমস্যা হচ্ছে। সেরকম প্রযুক্তি চাই, যেন কুয়াশা বা অন্ধকারে, খুব ভোরে বা রাতের যেকোনও সময়ে অনায়াসে বিমান উঠানামা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক পরিসরে ও বিদেশি উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর আস্থা যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা



/আইএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ