X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘তবু যেন তা মধুতে মাখা...’

প্রভাষ আমিন
২৯ মার্চ ২০১৯, ১৪:০০আপডেট : ২৯ মার্চ ২০১৯, ১৪:০৩




প্রভাষ আমিন ফোন করে আটকে পড়ার কথা জানাচ্ছেন, কেউ কেউ স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছেন, কেউ ফেসবুকে বিদায় জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, কেউ ভয়ে লাফিয়ে পড়েছেন, কেউবা পুড়ে, কেউবা শ্বাস নিতে না পেরে মরে গেছেন। এ বড় অদ্ভুত অসহায়ত্ব। প্রযুক্তির বিকাশের এই সময়েও সবার চোখের সামনে এভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মানুষ হাত নাড়ছে, সাহায্য চাইছে, মরে যাচ্ছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, মরে যাচ্ছি, অনেক কষ্ট, সিঁড়ি পাঠান। সন্তানের খোঁজে বাবা, ভাইয়ের খোঁজে ভাই, স্বামীর খোঁজে স্ত্রীর আহাজারি। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে যেন নরক নেমে এসেছিল।

পুরোনো ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘা এখনও শুকায়নি। সেখানে ৭১ জনের মৃত্যুর শোক ভোলার আগেই বনানীর এফ আর টাওয়ারে ১৯ জনের মৃত্যু। মাত্র ৩৭ দিনের ব্যবধানে নতুন ঢাকা-পুরোনো ঢাকা একাকার করে দেওয়া আগুন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। আগুন বুঝিয়ে দিয়েছে, তার কাছে নতুন ঢাকা-পুরোনো ঢাকার কোনও পার্থক্য নেই। তার লেলিহান শিখার সামনে সবাই সমান। চুড়িহাট্টার আগুনের পর বলা হচ্ছিল, এখানে কেমিক্যালের গোডাউন ছিল বলে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। পুরান ঢাকার সরু গলির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারে না। পানি নেই। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা পুরান ঢাকা আসলে বাসের অযোগ্য। কিন্তু বনানীর ক্ষেত্রেতো এটা সত্য হওয়ার কথা নয়। ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা বনানীতো বাসের অযোগ্য হওয়ার কথা নয়। বনানীতো আমাদের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। এখানে নিশ্চয়ই অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়নি।

বাস্তবে দেখা গেলো, রাস্তা চওড়া হলেও আশপাশে কোথাও পানি নেই। আর অভিশপ্ত এফ আর টাওয়ারটির নকশা ১৮ তলার। কিন্তু একতলা আন্ডারগ্রাউন্ডসহ বানিয়েছে ২৩ তলা। অন্তত ৩৩ শতাংশ জায়গা ছাড়ার কথা থাকলেও আসলে এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়া হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। যারা ভবনটি বানিয়েছে, তারা অবশ্যই অপরাধ করেছে। তারা লোভে পড়ে কোনও জায়গা না ছেড়ে ১৮ তলার নকশায় ২৩ তলা বানিয়েছেন। কিন্তু যাদের এটা দেখার কথা, সেই রাজউক দেখেনি কেন? এমন তো নয় ভবনটি আড়ালে। সবার চোখের সামনে একযুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে এফ আর টাওয়ার। নকশা ১৮ তলা না ২৩ তলার, সেটা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এক ইঞ্চি জায়গাও যে ছাড়েনি, সেটা বুঝতে তো রাজউকের চেয়ারম্যান হতে হয় না। শুধু এফ আর টাওয়ার নয়, বনানীর সেই রাস্তার সবগুলো ভবনই তো গায়ে গা লাগানো। তাহলে রাজউক এতদিন ভবনটির অননুমোদিত অংশ ভেঙে দেয়নি কেন? এখন রাজউক চেয়ারম্যান নির্মাতার দোষ দিলে কি পার পাবেন? ভবন নির্মাতাকে যতটা দোষ দেবেন, ততটা দায় কিন্তু আপনাকেও নিতে হবে।

এফ আর টাওয়ারের আগুনের পর একটা বিষয় পরিষ্কার, ১৮ তলার নকশায় ২৩ তলা বানানো সম্ভব এবং সেটি আগুনে না পোড়া পর্যন্ত কেউ জানতেও পারে না। নকশা এখন নিছক কাগজমাত্র। তারচেয়ে বড় কথা পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়া এমন একটি ভবন অনুমোদন পেলো কী করে? তার মানে নতুন ঢাকায়, পুরোনো ঢাকায়, বনানীতে, চুড়িহাট্টায় কোনও পার্থক্য নেই। আমরা অপরিকল্পিতভাবে, অনুমোদনহীনভাবে এই নগরীকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছি। চুড়িহাট্টার পর আমি লিখেছিলাম, আগুনের আসল কারণ লোভ। বনানীতেও তাই। চুড়িহাট্টায় ভবন মালিকরা বাড়তি ভাড়া পাওয়ার লোভে কেমিক্যালের গোডাউন বানায়। আর বনানীর ভবন মালিক বাড়তি ভাড়ার লোভে ভবন উঁচু করে বানায়। বাস্তবের আগুনের চেয়ে লোভের আগুন বেশি ভয়াবহ।

সর্বগ্রাসী লোভ অনেক আগেই গিলে খেয়েছে ঢাকার শত শত খাল। জলাধার, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে আমরা উঁচু উঁচু মৃত্যুফাঁদ বানাচ্ছি। এখন আগুন লাগলে পানি পাবো কই? পানির উৎস তো লোভের আগুন খেয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। সেই খাল, সেই জলাধার আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই এখন ঢাকায় জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপন করতে হবে।

মাঝে মাঝে পত্রিকায় বিশ্বে বাসযোগ্য নগরীর তালিকা ছাপা হয়। ঢাকার নাম থাকে নিচের দিকে। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, নিরাপত্তা বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান তলানিতেই থাকার কথা। বুড়িগঙ্গায় লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবে মানুষ মারা যায়, জেব্রা ক্রসিঙে পড়ে থাকে আবরারের লাশ, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। নিমতলির আগুনে ১২৪ জন, চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, বনানীতে ১৯ জন মারা যায়। এই শহরের গলিতে গলিতে মৃত্যুফাঁদ পাতা। যে কেউ, যে কোনও সময় ধরা পড়তে পারে সেই ফাঁদে। কার মৃত্যু কিভাবে হবে কেউ জানে না। স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনও গ্যারান্টি নেই এই শহরে।

তবু এই বাসের অযোগ্য ঢাকাই আমার প্রিয়। গত তিন দশক আমার সবকিছু জুড়ে আছে ঢাকা। এত বিপদ, এত শঙ্কা, এত নিরাপত্তাহীনতা তবু ঢাকাই আমাদের প্রিয়। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই শহর ছেড়ে পালাইনি, পালাবোও না। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘এত শঠতা, এত যে ব্যথা; তবু যেন তা মধুতে মাখা...।’ আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে বসে লিখছি বলে ঢাকার প্রতি ভালোবাসাটা আরো বেশি অনুভব করছি যেন। কিন্তু মুখে মুখে ভালোবাসি বললেই হবে না। এই শহরকে বাসযোগ্য করতে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। যার যার কাজটুকু তাকে তাকে করতে হবে। এই শহরকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব যেমন সরকারের, যেমন পুলিশের, যেমন রাজউকের, যেমন চালকের; তেমনি আপনার, আমার, আমাদের। রাজউককে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। কিন্তু আমরা যেন ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা বিল্ডিং না বানাই। চালককে সাবধান হতে হবে, কিন্তু আমরাও যেন নিয়ম মেনে চলি।

ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে হামলার পরের সপ্তাহে আল নূর মসজিদে জুমার নামাজের আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ড তার কাছে একটা দেহের মতো। এর কোথাও আঘাত লাগলেই তিনি ব্যথা অনুভব করেন। আমার কাছে ঢাকা বা বাংলাদেশ একটা দেহের মতো। এর কোথাও আঘাত লাগলে ব্যথা অনুভব করি। বনানীর ঘটনায় আমার পরিচিতদের মধ্যে অন্তত পাঁচ জনের স্বজন মারা গেছে। জেনেশুনে এমন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া কী যে ভয়ঙ্কর বেদনার, স্বজনদের বাঁচাতে না পারার এই অক্ষমতা কী যে ভয়ঙ্কর কষ্টের তা অনুভব করা আসলেই কঠিন। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সে কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

/টিটি/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ