X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা মেয়েটাকে মেরেই ফেললো!

চিররঞ্জন সরকার
১২ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:১২আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৪৪

চিত্তরঞ্জন সরকার নুসরাত জাহান রাফি। ফেনীর সোনাগাজী পৌর এলাকায় বাড়ি তার। ‘রাফি’ নামটা বোধহয় এরইমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে। প্রকাশ্য দিনের আলোয় ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো তাকে। আশিভাগ পোড়া শরীর নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ পাঞ্জা লড়ে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে সে! কী তার অপরাধ? যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দেওয়া হচ্ছিলো। এতে রাজি না হওয়ায় জন্যই এমন পৈশাচিকতা।

রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। বারবার ভয় দেখানোর পরও তারা মামলা তুলে নেননি। রাফি পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে বোরকা পরা এক ছাত্রী তাকে ‘অপর এক বন্ধুকে মাদ্রাসার ছাদে মারা হচ্ছে’ বলে ব্ল্যাকমেইল করে ছাদে নিয়ে যায় এবং সেখানে অবস্থান করা বোরকা পরা কয়েকজন দ্রুতগতিতে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। সমাজের বিকলাঙ্গতার কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়! একদল নারী রাফির শরীরে আগুন জ্বেলে দিলো! কী করে সম্ভব এমন নির্মম ঘটনা ঘটানো? কতটা অসুস্থ আমাদের এই সমাজ আর সেই সমাজের বিকলাঙ্গ প্রাণীরা!
ভাবতে কষ্ট হয়- এই ঘটনার জন্যেও একটি পরিকল্পনা করতে হয়েছে। কে কেরোসিন ঢালবে, কে আগুন লাগিয়ে দেবে এবং এই দলে কে কে থাকবে- সবই ঠিক হয়েছিল আগে। ঠিক করা ছিল ঘটনার দিনক্ষণ। শুধু রাফি বা অন্য কেউ সেটা জানতো না। ওরা ছিল মুখোশধারী। বোরকা পরা। তবে ওরা সবাই যে মেয়ে, এটা নিশ্চিত। কী করে কয়েকজন মেয়ে মিলে আরেকটা মেয়েকে দুনিয়া থেকে বিদায় দেওয়ার পরিকল্পনায় অংশ নিতে পারে? ভাবতে পারি না!

যৌন হয়রানির ঘটনা গোপন করেনি রাফি। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অধ্যক্ষ গ্রেফতার হয়েছে। আমরা তো মেয়েদের বলি যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদ করতে। চুপ করে না থেকে মুখ খুলতে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে, বিচার চাইতে গিয়ে মাশুল তো দিতে হলো রাফিকেই। এই আগুনে পুড়ে মরা মেয়েটির বাবাকে এখন আমরা কী বলবো? কীভাবে মুখ দেখাবো?

রাফির ঘটনাটিতে কোনও সান্ত্বনা খুঁজে পাই না। কোথায় মানুষ, মনুষত্ব, সংবেদনশীলতা? অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার অপরাধমূলক একটি ঘটনায় শিক্ষার্থীদের যেখানে প্রতিবাদ করার কথা, উল্টো তারা ওই নরপিশাচের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাফিকে পুড়িয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে! একদল ছাত্রী কী করে আরেকজন ছাত্রীর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সাহস পায়? মাদ্রাসা অধ্যক্ষ নামের পিশাচটি নিজের ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়ে অনুগত কয়েকজনকে দিয়ে একটি মেয়েকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করবে, এ কেমন সমাজে আমরা বাস করছি?

আমাদের সমাজটা এতটাই অধঃপতিত হয়েছে যে, ওই পিশাচের পক্ষে একদল দাঁড়িয়ে গেছে সেখানে, ওই যৌন নিপীড়কের পক্ষে মানববন্ধন করেছে আরও কিছু পিশাচের দল। সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয়ের রূপটা কী ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, ভাবলে মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। এই সামাজিক অসুখ আমরা কীভাবে সারাবো?

এখন প্রশ্ন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী এই হত্যাকারীকে ধরবে? সঠিক তদন্ত ও বিচার হবে? নাকি কুমিল্লার তনুর ঘটনার মতো এটাও অন্ধকার গর্ভে হারিয়ে যাবে? নুসরাত জাহান রাফির ঘটনাটি কে বা কারা ঘটিয়েছে তা দিবালোকের মতো স্বচ্ছ। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। এই কাজটি প্রশাসন করবে কিনা, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, এমনকি খুনের ঘটনাগুলোরও তেমন কোনও বিচার হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নারী নির্যাতনকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। আর একের পর ঘটে চলেছে নৃশংস সব ঘটনা। ২০১৫ সালে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ থাকার পরও অপরাধীদের কিছু হয়নি। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলনের পরেও ঘটনার কোনও কূলকিনারা হয়নি।

প্রশাসনিক এই গাফিলতি আর কতকাল চলবে? নারীর প্রতি আমাদের সমাজের মানুষগুলোইবা কবে সংবেদনশীল হবে? এখানে অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখার মানসিকতা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেই একদল মানুষ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। নারীকেই অভিযুক্ত করে। এই মানসিকতার কারণে ক্রমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি পরিণত হচ্ছে এক বর্বরের দেশে, যেখানে নারী মর্যাদা নিয়ে চলাফেরা করতে পারে না। কোনও পুরুষের লালসার সঙ্গী হতে অস্বীকার করলেই ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে! এই অবিমৃষ্যকারী ভূমিকা আমাদের সমাজকে এক কঠিন পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো, কিন্তু খুনি-ধর্ষকদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাবো- সেটা কোনও সুস্থ প্রবণতা নয়। আর তাহলে শুধু তনু, আফসানা, রাফি নয়, বাংলাদেশে কোনও মেয়েসন্তানই নিরাপদ থাকবে না। কারণ, অপরাধীর বিচার না হলে অপরাধ কেবলই বিস্তৃত হয়, একসময় সেই ‘পাপ’ ‘বাপ’কেও ছাড়ে না!

নারীর নিরাপত্তা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচার ইত্যাদি ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের গাফিলতি আছে। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। একই সঙ্গে নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদের ভূমিকাটাও মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। আমরা ক্রমেই যেন প্রতিবাদহীন নিথর আত্মকেন্দ্রিক এক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হচ্ছি। এতটাই অধম যে, ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সরব হতে পারি না। হই না। কোথায় যেন আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমাদের মনন বাঁধা। আমরা যে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি, মনটা যে আর নেই, থাকলেও যে পুরোপুরি ভারসাম্যে নেই, তা কিন্তু আমাদের দেখে বোঝা যায় না। রোজ সকালে নিয়ম মতো আমরা হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, কোটিতে কোটিতে কর্মস্থলে যাই। কাজ সেরে নিয়ম মতোই বাড়ি ফিরি। জীবন নিয়ে নানা স্বপ্ন দেখি। সপ্তাহান্তে পরিজনদের নিয়ে, ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বিলাসী সময়ে ডুব দিতে চাই। আমাদের চালচলন, কথাবার্তা, সাজপোশাক, আচার-আচরণ দেখে সবাই ভাবেন আমরা স্বাভাবিক, সুস্থ। কেউ বোঝেন না, ভেতরে সাংঘাতিক একটা জিনিস নেই- মনটা আর নেই!

এরকমই কী চলতে থাকবে? আশপাশের জগৎটা কী এমনই নির্মম, নিষ্ঠুর, উদাসীন হয়ে উঠবে ক্রমে? কেউ কারও বিপদে এগিয়ে যাবো না আর? খোলা চোখেও চোখ বুজে থাকবো? এর নাম সভ্যতা? এর নাম অগ্রগতি? নিজের জীবনে এত মগ্ন আমরা, এতই আত্মকেন্দ্রিক যে জীবন-মরণের সীমান্তে পড়ে কাতরাতে থাকা সহ-নাগরিকের দিকেও সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেবো না?

তবু আশা ছাড়ছি না। মনুষ্যত্ব মুছে গিয়েছে এই সভ্যতা থেকে, এমনটা ভাবছি না। মনুষ্যত্বের একটা দারুণ নমুনা শিগগিরই কোথাও চোখে পড়বে, আশায় আশায় থাকছি!

লেখক: কলামিস্ট

/এএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ