X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতামুখী সংবাদমাধ্যম, পতনমুখী সাংবাদিকতা

হারুন উর রশীদ
১৩ মে ২০১৯, ১২:৫৯আপডেট : ১৩ মে ২০১৯, ১৫:২৩

হারুন উর রশীদ কথাটা এখন বাজারে চাউর। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম অনিশ্চয়তা আর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে সম্প্রচার মাধ্যমেই এই ঝুঁকির কথা বেশি শোনা যাচ্ছে। আর এর প্রথম ধাক্কা আসছে সাংবাদিকদের ওপরেই। তারা চাকরি হারাচ্ছেন। এক-দুই জন নন, এখন শত সাংবাদিকের চাকরি হারানোর ঘটনা খবর হচ্ছে বাংলাদেশে।
আমার পূর্ণকালীন সাংবাদিকতার ২৩ বছর চলছে। সেই ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি দেশের প্রাচীনতম দৈনিক সংবাদ-এর মাধ্যমে আমার পূর্ণকালীন সাংবাদিকতা শুরু। তারপর আরও দু’টি প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকে কাজ করেছি। আট বছর কাজ করেছি টেলিভিশনে। আর গত প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করায় অনলাইন সাংবাদিকতায়ও আমার হাতেখড়ি হয়েছে অনেক আগেই। আর এখন তো অনলাইনেই থিতু হয়েছি। সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সাংবাদিকতাও। নিজের ফিরিস্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। প্রয়োজন মনে করেছি এই কারণে, কিছু বিশ্লেষণের আগে আমি বলে রাখতে চাই, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার সামান্য হলেও আমার অভিজ্ঞতার গণ্ডির মধ্যে আছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের বর্তমান সংকটের কারণ অনুসন্ধান করতে চাই আমি। আমার বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের বর্তমান সংকটের পেছনে যে কারণগুলো প্রধান হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো হলো:

১. দলবাজি

২. পেশাদারিত্বের অভাব

৩. নেতৃত্বের সংকট

৪. সময়কে বুঝতে না পারা

৫. বিজ্ঞাপন

আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোনও টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। ছিল না অনলাইন সংবাদমাধ্যম। এফএম রেডিও ছিল না। ছিল বাংলাদেশ বেতার। সংবাদমাধ্যম বলতে ছিল মুদ্রিত পত্রিকা আর বিদেশি বেতার। তখনই দেখেছি দৈনিক পত্রিকাগুলোর আলাদা আলাদা ঘরানা ছিল। আর কয়েকটি পত্রিকা ছিল সরাসরি বিভিন্ন দলের মুখপত্র। তারপরও এই পত্রিকাগুলো খবর পরিবেশনে এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা করতো। আমার সাংবাদিকতা শুরুর এক দশকের কিছু কম সময় আগে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় এই সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল ব্যাপক গণমুখী।

কিন্তু গত দুই দশকে সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ তার গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন এসেছে। এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমও। যত বেশি সংবাদমাধ্যম এসেছে, তত বেশি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। আর শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সাংবাদিকরাও দলীয় সাংবাদিকে পরিণত হয়েছেন। আগে যেমন দলীয় মুখপত্র ছিল এখন তেমন দলীয় সাংবাদিকও আছেন। আর সংবাদমাধ্যমগুলোও দলীয়  বিবেচনায় সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। সাংবাদিকরাও তাদের মর্যাদার জায়গাটি হারাচ্ছেন। তাই এখন দলবাজ-দলদাস সাংবাদিক পদবাচ্য দু’টি খুব শোনা যায়।

এই কারণেই সংবাদমাধ্যমে এখন পেশাদার সাংবাদিকের অভাব দেখা দিচ্ছে। এজন্য সাংবাদিক নিজে যেমন দায়ী তেমনি তার প্রতিষ্ঠান, মালিকপক্ষ এবং সম্পাদকও দায়ী। মালিকপক্ষ সাধারণ বিবেচনায় ব্যবসা দেখে। ক্ষমতার সিঁড়ি বানায়। বাংলাদেশে ক্ষমতাকে চটিয়ে ব্যবসা হয় না বলে প্রতিষ্ঠিত ধারণা। ক্ষমতায়নও হয় না। ফলে মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক ও ক্ষমতার স্বার্থের অনুগামী সম্পাদক তো আর পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য কাজ করেন না। তিনি মালিককে গুডবুকে রেখে সম্পাদক পদে থাকার জন্যই কাজ করেন। ফলে দিন দিন অপেশাদারদের বাজার বড় হচ্ছে।

আর এটাই তৈরি করছে সংবাদমাধ্যমে নেতৃত্বের সংকট। নেতৃত্বের সংকট যেখানে তৈরি হয় সেখানে সৃজনশীলতা ও মানের সংকট দেখা দেয়। সম্পাদক যদি সংবাদমাধ্যমের মূলসূত্রের বাইরে গিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান আর ক্ষমতাবান হওয়ার চেষ্টা করেন, সাংবাদিক যদি তার দলীয় লোকজনকে খুশি করার খবরের পেছনে ছোটেন, প্রকাশক বা মালিক যদি সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেন অন্য ব্যবসা ও ক্ষমতার ভিত শক্ত করার কাজ করেন, তাহলে দেশে সংবাদমাধ্যমের যে চরিত্র দাঁড়ায়, তা হলো ক্ষমতামুখী সংবাদমাধ্যম। গণমুখী নয়। যে সংবাদমাধ্যম গণমুখী নয়, তা কখনোই সাধারণ মানুষের আস্থায় থাকে না।

এর ফলে আরও একটি ঘটনা ঘটে। তা হলো সময়ের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম এগোতে পারে না। স্থবির হয়ে পড়ে। সৃজনশীলতা থাকে না। থাকে না অনুসন্ধান। সাংবাদিকতা পিআর জার্নালিজমে পরিণত হয়। পরিণত হয় এমবেডেড জার্নালিজমে। যার বাংলায় নাম দেওয়া যেতে পারে শয্যাশায়ী সাংবাদিকতা। আর এ কারণেই অনলাইন সাংবাদিকতাকে আমরা এখনও ঠিকমতো ধরতে পারছি না। এখানে বড় বিনিয়োগ আসে না। আসে কপিপেস্ট সাংবাদিকতা। টুকটাক অনলাইন।

সংবাদমাধ্যমের ব্যর্থতাই ফেক নিউজকে জনপ্রিয় করে। ভুয়া অনলাইন বাজার পায়। সংবাদমাধ্যম যখন আস্থার জায়গায় থাকে না তখন মানুষ গুজবকে বিশ্বাস করে। অসত্য তথ্য বা মেকিং ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মানুষ নিঃশ্বাস নেওয়ার জানালা খোঁজে। তাই তো ব্যারিস্টার সায়েদুল ইসলাম সুমনের ফেসবুক লাইভ দেখতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন ফেসবুকে। কিন্তু টেলিভিশন দর্শক পায় না।

এর ফলে এখন বিজ্ঞাপন সংকটে ভুগছে সংবাদমাধ্যম। বিজ্ঞাপন কম হওয়া মানে আয় কম হওয়া। আর আয় কম হলে তা পোষানোর সহজ পথ হলো ছাঁটাই করা। ছাঁটাইয়ের এই কোপে এখন সবার আগে পড়ছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা।

বিজ্ঞাপনদাতারা এখন প্রচলিত সংবাদমাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ, তারা চান ফিডব্যাক। দুই মাস আগে এই বিজ্ঞাপন নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কাজ করতে গিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাই আমি। তাতে দেখা যায়, রেট কার্ড অনুযায়ী বছরে বাংলাদেশে ১১ হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু ডিসকাউন্ট ও অঘোষিত ছাড়ের হিসাব অনুমান করলে এই বিজ্ঞাপনের বাজারটি ৫ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো এই বিজ্ঞাপনের লায়ন শেয়ার হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নিয়ে নেয়। এতে বোঝা যায় অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমেরই বিজ্ঞাপনের আয় তেমন নেই। তাহলে যাদের আয় আছে তারা ছাঁটাই করছেন কেন? কারণ, মোট বিজ্ঞাপন কমছে মূল ধারার গণমাধ্যমে। ভারতে শতকরা ১৪ ভাগ বিজ্ঞাপন প্রবৃদ্ধি হলেও আমাদের অধঃগতি।

তবে বিজ্ঞাপন বাড়ছে বিকল্প মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবে। ওইসব মাধ্যমে গত বছর কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন গেছে। শুধু টেলকো থেকেই বিজ্ঞাপন গেছে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার। আর বিজ্ঞাপনের এই ট্রেন্ড ধরার জন্যও প্রয়োজন স্বাধীন ও পেশাদার গণমাধ্যম। সব কিছুকে মাল্টিমিডয়ার এক প্ল্যাটফর্মে আনার যে চ্যালেঞ্জ সেটা নিতে পারলেই এসব সংকট কাটানো সম্ভব। আর তা পারে কেবল পেশাদার সংবাদমাধ্যম।

এখন অনেকে হয়তো বলবেন, সংবাদমাধ্যম তো চাপের মুখে আছে। তার তো হাত-পা বাঁধা। এটা আমার কাছে অজুহাত বলে মনে হয়। আমি বলবো, চাপ সবসময়ই ছিল। বিশ্বের কোথাও কখনও সংবাদমাধ্যম চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে তার টিকে থাকার জন্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণের, গ্রাহকের আস্থায় থাকতে হবে। এটাকেই একটি স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে দেখতে হবে। সংবাদমাধ্যম অন্য ব্যবসা বা অন্য ধরনের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হলে স্বাভাবিকভাবেই পরগাছায় পরিণত হবে।

আমাদের এখানে অনেকটা তা-ই হয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এখানে স্বেচ্ছা আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত আছেন অনেকেই। এখন আর চাপ দিতে হয় না। জোর করে দাসত্ব নয়, স্বেচ্ছা দাসত্বের চর্চা শুরু হয়েছে। আমাদের কেউ কেউ এখন মনোদাস। তার ফলও আমরা দেখতে শুরু করেছি।

শেষে আমি একটি কারণের ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চাই। তা হলো দলবাজ সাংবাদিকতা। সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের কোনও দল বা কোনও দলের প্রতি সমর্থনকে আমি খারাপ বলে মনে করি না। কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ পরিবেশনে প্রভাব ফেলতে পারবে না। যদি ফেলে তাহলে সেটা দলবাজি। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমই আছে, যারা প্রকাশ্যেই কোনও দলকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সংবাদে তার কোনও প্রতিফলন থাকে না। থাকে না দলবাজি। থাকে না মতলববাজি।

পুনশ্চ: আমার এই লেখা তাদের জন্যই, যাদের জন্য এটা প্রযোজ্য। টু হুম ইট মে কনসার্ন। যারা এর বাইরে আছেন, তারা তো ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমই হয়তো আমাদের সংবাদমাধ্যমকে আলো দেখাবে। সেই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু ব্যতিক্রম তো আর উদাহরণ হতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক

 

[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ