X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেঁচে থাক বাংলা ট্রিবিউন

রুমীন ফারহানা
১৪ মে ২০১৯, ১২:৩৩আপডেট : ১৪ মে ২০১৯, ১৫:০১

রুমীন ফারহানা ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ম্যাস মিডিয়া’ বইটির প্রকাশনার ৩০ বছর পালিত হয় গত বছর। নোয়াম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড হারমান রচিত এই বইটি আজও মিডিয়ার চরিত্র এবং মূল উদ্দেশ্য বুঝতে সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বইটিতে লেখকদ্বয় অসাধারণভাবে দেখিয়েছেন মূলধারার মিডিয়ায় জনস্বার্থের প্রতিফলন দেখা আসলে একটা ইলিউশন; তারা দেখিয়েছেন পাঁচটি ফিল্টার পার হয়ে মিডিয়ায় আসা তথ্য আদতে জনমানুষের কথা বলতে তো পারেই না বরং সেটা শাসক, বিশাল করপোরেট এবং নানা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের প্রতি জনগণের মতামত তৈরির কাজই করে। উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশে আপাতভাবে পেশাদার, প্রাতিষ্ঠানিক রূপে দেখা যাওয়া পশ্চিমা মিডিয়ার চরিত্র যদি এমন হয়, তাহলে বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়াকে আমরা কীভাবে দেখবো? এই প্রশ্নের জবাবে আসছি শেষে।
মজার বিষয় হলো গণমাধ্যম নানান চড়াই উৎরাই পেরোলেও এ বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা ফুরায়নি এতটুকু। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র আর বাক স্বাধীনতার যে মন্দা চলছে তারই মাঝে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসম্যান স্টিফটুং-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে করা সমীক্ষায় যে নতুন পাঁচটি দেশ স্বৈরতন্ত্রের তালিকায় ঢুকেছে বাংলাদেশ তার একটি।

প্রায় একই ধরনের কথা উঠে এসেছে ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টে যা বলছে ১০০ মধ্যে ৪১ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে আংশিক মুক্তের কাতারে। অন্যদিকে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিবেচনায় বাংলাদেশে এখন ‘হাইব্রিড রেজিম’ ক্ষমতায় আছে। গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম যেহেতু হাত ধরাধরি করে চলে তাই এর খুব স্পষ্ট প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১৯ রিপোর্টে। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে চার ধাপ পিছিয়ে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০। উল্লেখ্য, এতে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের চাইতে ভালো ১৪২।

আইসিটি অ্যাক্ট বা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সঙ্গে যুক্ত সেলফ সেন্সরশিপ বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে একটি বড় বাধা। অল্প কিছু উদাহরণই বিষয়টি স্পষ্ট করবে। ২৯ ডিসেম্বর রাতে যে ব্যালট বাক্স পূরণের মহোৎসব হয়ে গেলো তার খবর যত না দেশীয় গণমাধ্যম থেকে পাওয়া গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে New York Times, Economist, Guardian, Washington Post, The Hindu, BBC, CNN কিংবা Al Jazeera রিপোর্টে। ঠিক যেমন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক লোপাটের কথা প্রথম মানুষ জানতে পারে ফিলিপাইনের একটি পত্রিকা থেকে। ৩০ ডিসেম্বর ভোট ডাকাতি, বিশেষ করে রাতে ব্যালট বাক্স নিয়ে নিয়ে Reporters Without Borders বাংলাদেশের নির্বাচনের পর রিপোর্ট করেছে ‘Serious press freedom violations in Bangladesh’s election’ শিরোনামে। এমন ভয়ঙ্কর একটা বিষয় নিয়ে রিপোর্ট বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ায় অনুপস্থিত থাকা মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নিঃসন্দেহে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি অডিও কল ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এটি প্রধানমন্ত্রীর কিনা নিশ্চিত নই। কিন্তু এতে যে বক্তব্য ছিল সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলধারার মিডিয়া এটা নিয়ে কোনও নিউজ করেনি, এমনকি এটা সত্য নাকি অসত্য সেটিও নিরূপণ করার চেষ্টাও করেনি। অথচ এই মূল ধারার মিডিয়াতেই এর আগে বিরোধীদলীয় নেতার অডিও কল কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাজিয়ে শোনানো হয়েছে।

মূলধারার মিডিয়ার এই সীমাবদ্ধতার জন্যই মানুষ এখন নিউ মিডিয়াতে খবর খুঁজতে যায়। এই খবর খোঁজায় কখনও কখনও গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মূলধারার অনেক‌ মিডিয়া সেই গুজবকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে নিউ মিডিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু এসব মিডিয়া এটা খেয়াল করে না, নানা রাষ্ট্রীয় ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারলে মানুষ নিউ মিডিয়ায় যেতো না।

নিউ মিডিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকা সরকারকে ও এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেছে। সেজন্যেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর মতো নিবর্তনমূলক আইন করা হয়েছে যাতে মানুষ সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা না বলে। একই অপরাধ মূলধারার মিডিয়া করলে যে শাস্তি সেটা ডিজিটাল মিডিয়া করলে শাস্তির পরিমাণ বেশি, এটা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে সরকার কোন মিডিয়াকে বেশি ভয় পায়।

বিশাল বিনিয়োগ, রাজনৈতিক চাপ, আইনের চোখ রাঙানি, মালিকপক্ষের মর্জি, সব মিলিয়ে খবরের ভেতরের খবর প্রকাশ করা সব সময় খুব সহজ হয়ে ওঠে না। যে কারণে আকরামের অডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুললেও তার এতটুকু আঁচ আসে না মূল মিডিয়ার গায়ে। কথায় কথায় ভারতের নাম নেওয়া আমাদের রেওয়াজ। ভারতের গণতন্ত্রের আজকের এই শক্ত অবস্থানের পেছনে নির্বাচন কমিশনের সাথে সাথে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে স্বাধীন বিচার বিভাগ আর গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা।

এই দেশে একটা সরকার যখন অথরিটারিয়ান থেকে টোটালিটারিয়ান হওয়ার পথে এগিয়ে গেছে অনেক দূর, তখন আমাদের মিডিয়াগুলো কতটুকু তাদের দায়িত্ব পালন করছে সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

শুরুতে প্রশ্ন করেছিলাম পশ্চিমা মিডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের মিডিয়াকে তাহলে আমরা কীভাবে দেখব। সেই অনুচ্ছেদে লিখেছিলাম পশ্চিমা মিডিয়াগুলো আদতে নানা ক্ষমতাবানদের উদ্দেশ্য পূরণে কাজ করলেও তার অন্তত জনগণের পক্ষে কাজ করছে এমন একটা ইল্যুশন তৈরি করার ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের বর্তমানকালের মূলধারার মিডিয়া এমন ইল্যুশনও কি তৈরি করতে পারছে? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়!

এতসব বাধা পেরিয়ে দেশের মূলধারার নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা ট্রিবিউন কি ব্যতিক্রম হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারবে? এই পোর্টালের একজন কলামিস্ট হিসেবে আমি খুব চাই বাংলা ট্রিবিউন এই ধারার এক ব্যতিক্রম হয়ে উঠুক। বাংলা ট্রিবিউনের জন্মদিনে কামনা করছি- বেঁচে থাক বাংলা ট্রিবিউন, পাশে থাক গণমানুষের স্বার্থের সব লড়াইয়ের।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

/এমওএফ/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ