পশ্চিমবঙ্গের ২২ জেলাজুড়ে চলছে ডাক্তারদের কর্মবিরতি। এ নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম এপিবির আনন্দ চ্যানেলে। এপিবির আনন্দসহ এ গ্রুপের চ্যানেলগুলো কার নামে নামকরণ করা হয়েছে, তা আমাদের বাংলাদেশের অনেকেই জানেন না। এপিবি গ্রুপের সব চ্যানেলের নামকরণ নাকি হয়েছিল ভারতের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নামে। তিনি বিজেপির ইন্দর কুমার গুজরালের পূর্বসূরি।
বাংলাদেশ বা ব্রিটেনের রাজনীতি নয়, ভারতসহ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির খোঁজখবর নিয়মিত জানার চেষ্টা করি। বাংলাদেশকে প্রথম বাংলা ধরে পশ্চিমবঙ্গকে অনেকে দ্বিতীয় বাংলা হিসেবে উল্লেখ করেন। আর ব্রিটেনকে বলা হয় তৃতীয় বাংলা। তিন বাংলাতেই গণতন্ত্র বিপদে, এটা সব দলের রাজনীতিবিদদের কথা। প্রথম দুটো ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রতি অভিযোগ—গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও হরণ করা। আর ব্রিটেনে ব্রেক্সিট নিয়ে গণতন্ত্রের সংবিধানহীন ৮০০ বছরের সুরাহা না হওয়ায় সংকটে এখন দেশটি।
সাংবাদিকতার গণ্ডির বাইরে একজন পাঠক হিসেবে আগ্রহ থাকে। গত ১৫ জুন এপিবি আনন্দ নামের ভারতের বাংলা টিভি চ্যানেলটিতে সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
ছাত্ররাজনীতির আমল থেকে যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, তাদের চেনা ভাষাতেই কথা বলেছেন। এখানে তিনি ইচ্ছে করেই বাংলাদেশকে টেনে এসেছেন। তিস্তায় বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার সর্বশেষ উপলক্ষ হিসেবে মমতাকে খুব ভালো করে চেনেন বাংলাদেশিরা। পশ্চিম বাংলার নাম বদলে বাংলা রাখতে চান তিনি। ওপারে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতটা বাঙালিপ্রেমী, বাংলাদেশের বাঙালিদের ন্যায্য সুবিধাটুকু দিতে তিনি ততটাই বিদ্বেষী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের মাটিতে সর্বশেষ জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক স্টান্টবাজি আসামের ‘বাঙালি খেদাও’ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার এবারের সুরধ্বনি তুলে তার সামগ্রিক কৌশলের অংশ হিসেবেই ভোটে জয় পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য এ ইস্যুতে আসামের বাঙালিদের পক্ষে।
দুই.
ভারতের ভোটের ফল বলছে, এখন রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম খারাপকে আর চাইছেন না ভোটাররা। তার চেয়েও বিজয়ী দলের সমর্থক হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ বেড়েছে। রাজনীতি হয়ে গেছে এন্টারটেইনমেন্টের শো বিজনেস। জরিপের গ্রাফে পেশির শক্তিতে এগিয়ে থাকা অভিনেতাদের জয়জয়কার দেশে দেশে রাজনীতির মঞ্চে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া সেই ট্রাম্পময়তার জয় এখন বিশ্ব রাজনীতিতে। চটুল কথার লোকরঞ্জনবাদী কিছু সস্তা জাতীয়তাবাদী স্লোগানই এখন ক্ষমতার নিয়ামক।
শিল্পবিপ্লবের পর এখন সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি ঘটছে রাজনীতির চরিত্র ও ভোটারদের প্রত্যাশার বাঁক বদলের ক্ষেত্রে।
ভারতীয়, পশ্চিম বাংলার বন্ধুদের কাছ থেকে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে উপলব্ধি করি, মোদির বাঙালি খেদাও, নয়তো দিদির পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমান প্রীতি–দুটোই রাজনৈতিক। পশ্চিম বাংলায় যারা এখন ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসলে মানুষের চেয়ে ক্ষমতার পক্ষে আগে।
তারা সাম্প্রদায়িকতার সুবিধা নেন না, সাম্প্রদায়িকতাকে মূল হাতিয়ার বানিয়ে ভোট বৈতরণী পার হন।
দেশে দেশে এখন রাজনীতির শিষ্টাচারহীনতা, ধর্মের নামে জাতীয়তাবাদের নামে স্টান্টবাজরাই ভোটারদের ভোটে কী করে জানি জিতে আসছেন।
খুব আশ্চর্য হয়ে দেখি, ভারত-পাকিস্তানের মতো আশপাশের দেশগুলোতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কে বেশি বাহুবল দেখাতে পারবেন, কেবল সেটিই এখন সরকারপ্রধান হওয়ার বৃহত্তম যোগ্যতা ভাবছেন ভোটাররা! মোদির সদ্য বিগত আমলে কোটি ভারতীয় নাগরিকের চাকরি গেছে। বেকারত্ব বেড়েছে। ভোট তবু মোদিকেই জয়ী করেছে। কারণ রাহুল গান্ধীর চাইতে মোদি শক্তিমান নেতা। তাই কংগ্রেস পারছে না বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের একজন করে মোদি আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। এ দু’জন আছেন বলে নন, কেবল এ দু’জনের ক্ষমতা আর কৌশলের বলেই রাজনীতি চলছে।
তিন.
শিরোনাম প্রসঙ্গ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে ফিরি। বাহাসের, পরস্পরবিরোধিতার শ্লীল-অশ্লীলতা, দল বদল, অনৈতিকতার প্রশ্নে দুই বাংলার রাজনীতির নেতিবাচকতার তুলনার বিশ্লেষণে গেলে লেখার দৈর্ঘ্য-ই বাড়বে।
এপিবি আনন্দের ওই সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গে পতনোন্মুখ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজের মতো নিজের ভাষায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খুব ভয়াবহ অভিযোগ তুলেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে নাকি বাংলাদেশ থেকে কারা গিয়েছিল ভারতে মিটিং করতে? তিনি ওই লাইভ অনুষ্ঠানটিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্ডার থেকে অন্য ধর্মের লোক পাঠিয়েছে, কোন ধর্মের লোক আমি বলব না।’
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমি বলবো, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাশের দেশের একটি রাজ্য সরকারের শীর্ষ ব্যক্তির মন্তব্য, খুবই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল মন্তব্য।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাগুলো মিথ্যা প্রমাণ করা, বাংলাদেশের নিজেদের সার্বভৌমত্বের প্রতি জনগণের ও সরকারের সম্মানের শ্রদ্ধার ও দায়িত্বের জায়গা থেকে।
লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয়ে বিজেপির ভারত জয়ের কারণ নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে, সে আলোচনা আমার আজকের লেখার গন্তব্যও নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থক বা বিরোধী কোনোটাই আমার পক্ষ নয়। আমার পেশা সাংবাদিকতা। গণমানুষের কথা বলবার আকাঙ্ক্ষিত গণমাধ্যম আমার স্বপ্নের জায়গা।
কিন্তু, বাংলাদেশের খুব কাছের দূরত্বের পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকতা কতখানি স্মার্ট, সাহসী ও কৌশলী, আর আমরা কোথায়; এ প্রশ্নটি আমাকে ভাবায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন রণমূর্তিময়ী মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা দেখি অনুষ্ঠানটিতে। সাংবাদিকতার সম্পন্নতাময় সাক্ষাৎকারটি দেখে সে পেশার তারে জড়ানো জীবনের শরীরে বেদনা টের পাই।
কেননা অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছে গত ১৫ জুন। বাংলা ট্রিবিউন ছাড়া বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমে বা সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত কোনও খবর চোখে পড়েনি। পশ্চিম বাংলার আনন্দবাজারময় গল্প সাংবাদিকতা, অথবা গণমাধ্যমের বড় অংশে সংবাদমাধ্যমের প্রধানত বিনোদনমুখিতার সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করি। একইসঙ্গে তাদের গণমাধ্যমে ক্ষমতার চাপের মুখেও অনসন্ধিৎসু পেশাদারিত্বের প্রয়াসের দিকটিকেও অস্বীকার করবারও সুযোগ নেই। আর এ দুটোকে স্বীকার করতে হলে আরেকটা বাস্তবতাকেও অবশ্য স্বীকার করতেই হবে। সেটি হলো ভারত পশ্চিমবঙ্গে, দুটো আলাদা দলের আলাদা সরকার। একটা রাষ্ট্রের সরকার, অন্যটি রাজ্যের। সে দুটি আবার পরস্পরবিরোধী। এই পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলো থাকায় সারদাকাণ্ডের মতো কেলেঙ্কারি, চিটফান্ডের গোমর ফাঁস হয়। রাজনৈতিক হত্যা, সন্ত্রাস ইস্যু হয়। সিঙ্গুরের মতো জনতা কথা বলে সেখানে। রাস্তায় নামার সুযোগ থাকে বলেই জনগণ কথা বলার সুযোগ পায়। সাংবাদিকতা অনুসন্ধান আর পেশাদারিত্বের বিকাশের জায়গাটুকু পায়। যেকোনও ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলবার মতো বহু কণ্ঠ, বহু ঐক্যবদ্ধ শক্তি সেখানে সোচ্চার। কিন্তু কার্যত একটা বিরোধী দল না থাকার বাস্তবতা প্রবলভাবে বিদ্যমান বাংলাদেশে।
তিন বাংলাতেই দেশপ্রেম জিনিসটা ছেলেবেলার মুখস্থ থাকা দু'লাইনের ছড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেম, মাটির প্রতি মায়া এসব কেমন করে জানি কেবল মুখের কথাতেই বেঁচে আছে। মুক্তবাজার চেতনার যুগে দেশপ্রেম এখন কেবল সস্তা স্লোগান। খুচরো কিছু মিথ্যে কথার মুদি দোকান হয়ে যাচ্ছে, সব বাংলায় সময়ের রাজনীতি।
লেখক: সাংবাদিক