X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধের বিচার না হলে অপরাধী সাহসী হয়!

রেজানুর রহমান
৩০ জুন ২০১৯, ১৫:৫৮আপডেট : ৩০ জুন ২০১৯, ১৫:৫৯

রেজানুর রহমান একটি সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর দিন তো—প্রশ্নটা হলো দেশের ছোটোখাটো সব ঘটনা, দুর্ঘটনার জন্যই যদি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মাথা ঘামাতে হয়, তাহলে দেশজুড়ে এত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পাশাপাশি সুশীল সমাজের লোকজনই বা আছেন কী জন্য? তাদের কাজটাই বা কী? রাতের অন্ধকারে সিলেটের অদূরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বললেন, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার কারণে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। পরে জানা গেলো ওই রাতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অস্বাভাবিক গতিতে ট্রেন ছুটছিল নড়বড়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে। কেন অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা করেছিল? এ ব্যাপারে কারও কি দায়-দায়িত্ব ছিল না? সিলেট অঞ্চলের রেললাইনের ওপর ধারণ করা একটি ভয়ঙ্কর ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—রেললাইনের নাট, বল্টু আলগা হয়ে গেছে। অথচ এর ওপর দিয়েই একটি রেলগাড়ি চলে গেলো ঝক ঝক শব্দ তুলে। আতঙ্কগ্রস্ত এক কিশোরের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে…‘ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ!’ চিৎকার। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর দেখা গেলো রেললাইনের জোড়া লাগা অংশের একদিকে নাট, বল্টু নাই। ভিডিওটির সঙ্গে দুটি লাইন জুড়ে দেওয়া হয়েছে—‘এই হলো সিলেটের রেললাইনের অবস্থা! আর কত দুর্ঘটনা ঘটলে, আর কত মানুষ মারা গেলে কর্তৃপক্ষ জাগবেন?’ যৌক্তিক প্রশ্ন। সিলেটের মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রেল কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু সিলেটের ব্যাপারেই নয়, সারাদেশের রেলপথের উন্নয়নের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এখন হয়তো অচিরেই সিলেটের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেলপথের করুণ দশা বদলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিন কেন রেলপথের উন্নয়নের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? একটি পত্রিকায় দেখলাম, সিলেট এলাকার রেললাইনের ছবিসহ একটি ভয়াবহ রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা—ঢাকা-সিলেট রেলপথের শায়েস্তাগঞ্জে খোয়াই নদীর ওপর নির্মিত সেতুতে সরে গেছে স্লিপার। নেই পর্যাপ্ত নাট বল্টু ও ক্লিপ। বাঁশ দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে স্লিপারগুলোকে! একবার কল্পনা করুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! রেললাইনের স্লিপার আটকানো হয়েছে বাঁশ দিয়ে। যারা রেললাইনে মানুষ মারার এই ফাঁদ তৈরি করেছেন, তাদের কি আদৌ শাস্তি হবে? আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর নিশ্চয়ই শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, গোটা দেশের রেলপথের সঠিক উন্নয়ন হবে। কিন্তু আবারও ওই একই প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকি মারছে। রেললাইনের কালভার্টে রেলের স্লিপার আটকানো হয়েছে বাঁশ দিয়ে, এটাও কি নজরদারিতে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে? রেলের এত এত কর্মকর্তা-কর্মচারী তাহলে কী করেন?

ফেনীর সোনাগাজীর হতভাগী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ধরুন। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক হস্তক্ষেপের কারণেই না এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা গ্রেফতার হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত আসামি মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল তার অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির ওপর হস্তক্ষেপ না করলে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা হয়তো জনসমক্ষে পরিষ্কার হতো না। বরং হতভাগী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকেই কল্পিত নানা ধরনের ন্যক্কারজনক অপরাদের ভাগীদার হতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর সহৃদয় সহযোগিতায় হতভাগী নুসরাত কল্পিত অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সব ঘটনা দুর্ঘটনার ব্যাপারেই কি প্রধানমন্ত্রীকেই মাথা ঘামাতে হবে? তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সমাজের বিবেকবান মানুষের ভূমিকা কী?

সম্প্রতি বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর বলতে গেলে অপরাধীরা বীরদর্পেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর বোধকরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরার জন্য মাঠে নামে। প্রশ্ন হলো, এতবড় একটা সন্ত্রাসী ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত কী ব্যবস্থা নিয়েছে? প্রচারমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা এলাকার দাগী আসামি বলে পরিচিত। হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন বরগুনায় একজন দাগী আসামি। শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি সড়ক, কেজি স্কুল ও ধানমন্ডি সড়কে মূলত নয়ন ও তার সাগরেদদের বিচরণ ছিল। অসহায় ছাত্রদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে মোবাইল ফোন জিম্মি করে টাকা আদায় করতো। ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্যসহ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর নয়ন তার অপরাধ কর্মকাণ্ডে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং একটি সন্ত্রাসী দল গঠন করে। কাজেই নয়নের ব্যাপারে পুলিশের তালিকায় সবকিছু পরিষ্কার থাকার কথা। অথচ নয়ন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে প্রকাশ্যে রিফাত নামে এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করলো। রিফাতের স্ত্রী সন্ত্রাসীদের বারবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেও রিফাতকে বাঁচাতে তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেনি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মানুষকে রামদা অথবা ছুরি দিয়ে হত্যা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। সেই দৃশ্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেকে। মোবাইলে ছবি ধারণ করছে কেউ কেউ। কিন্তু দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে কেউ এগিয়ে আসছে না কেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই এই অপ্রীতিকর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন অনেকে। তারা বলেছেন, অতীতকালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখলেই তা প্রতিরোধ করতে সাধারণ মানুষই সবার আগে এগিয়ে আসতো। কেন আসতো? আসতো এজন্য, সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দেওয়ার পর সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপত্তা পেত। আর এখন সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিলে সাধারণ মানুষকেই কখনও কখনও অহেতুক আইনি ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। তাছাড়া সন্ত্রাসী গ্রেফতার হওয়ার পর অনায়াসেই জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসে এবং যারা তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে। সে কারণে সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ সহজেই সংগঠিত হতে চায় না। এটা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণের মাঝে এই নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটি দূর করা জরুরি। তা নাহলে অন্যায় ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা সহজ হবে না। অথচ সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সোচ্চার ভূমিকা খুবই জরুরি। এজন্য একটা জাগরণ দরকার।

আমাদের দেশে হঠাৎ কোনও ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়ে যায়। সবকিছু দেখে মনে হয় এই বুঝি সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলো। কিন্তু হইচই বেশি দিন থাকে না। নতুন কোনও ঘটনা ঘটলেই আগের ঘটনা আড়ালে পড়ে যায়। বরগুনার কথাই যদি ধরি, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ঘটনাটি অনেকটাই আড়াল হতে চলেছে। অথচ এই ঘটনাকে মোটেই আড়াল হতে দেওয়া উচিত নয়। বরং এই ঘটনার সূত্র ধরে গোটা দেশে সন্ত্রাস ও অনাচারের বিরুদ্ধে একটা জাগরণ তৈরি করা জরুরি। মাদকাসক্ত অথবা বখাটে তরুণদের দাপট তো গোটা দেশেই রয়েছে। বরগুনার ঘটনার সূত্র ধরে সারাদেশে বিশেষ অভিযান শুরু করতে পারেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সবচেয়ে বড় কথা, বরগুনার ঘটনায় দোষী ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পেলে গোটা দেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারণ অপরাধের বিচার না হলে অপরাধী সাহসী হয়ে ওঠে। কাজেই অপরাধের বিচার হওয়া জরুরি।

কিন্তু বরগুনার লোমহর্ষক খুনের ঘটনায় অপরাধীরা কি আদৌ শাস্তি পাবে? জনমনে এমনই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে বরগুনার ঘটনাকে ঘিরে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—ঘাতকদের পাশে শম্ভু, দেলোয়ার পরিবার। মজার ব্যাপার হলো, এই দুই পরিবারই একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক। অথচ দুই পরিবারের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু বরগুনায় রিফাত হত্যার ঘটনায় দুই পরিবারই ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে! যদি অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে তো শঙ্কার বিষয়। পাঠক কী বলেন?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ