X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

অসহিষ্ণু ভারত: কোন পথে হাঁটবেন এখন রাহুল

আনিস আলমগীর
০৯ জুলাই ২০১৯, ১৫:৩২আপডেট : ০৯ জুলাই ২০১৯, ১৫:৩৫

আনিস আলমগীর তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিবিদরা পদত্যাগ নিয়ে নানা নাটক করেন। বিশেষ করে পরিবারতান্ত্রিক দলগুলোতে এ নাটক হামেশা দেখা যায়। নির্বাচনে দলের বিপর্যয়কে আড়াল করতে, বা নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে নেতা পদত্যাগ করে কিছু কর্মী সমর্থক দিয়ে পদত্যাগের বিরুদ্ধে মিছিল বের করান। আবার কর্মীদের চাপের মুখে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের একটা নাটক সাজান। রাজনীতির এই ফন্দিফিকির সবাই বুঝলেও বলার কিছু নেই।
রাহুল গান্ধী কিন্তু তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করলেন না। তিনি টুইট করে সব কংগ্রেস কর্মীকে জানিয়ে দিলেন সভাপতি হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবেন না। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস শাসিত চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও সাক্ষাৎ করেছিলেন। কিন্তু রাহুল গান্ধী সভাপতি পদে থাকতে তাদের কাছে কোনও সম্মতি দিলেন না। সভাপতি হিসেবে থেকে যাবেন, সম্মতি দিলে আমার মনে হয় তার আত্মহননের পথই পরিষ্কার হতো।
জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী—এদের হাতেই তো কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছিল চার দশক। সুতরাং পরিবারের অভিযোগ তো মিথ্যা নয়। অবশ্য অভিযোগটা কংগ্রেস নেতাকর্মীদের নয়, বিরোধী বিজেপি পক্ষের। বিরোধী পক্ষ এবারও ভোটে জিতেছে। সুতরাং বলা যায়, জনসাধারণ বিরোধীপক্ষের এই অভিযোগ প্রত্যয়ন করেছে। আমার এ কথা হয়তো গসপেলের মতো শোনাবে। প্রকৃত গণতন্ত্রকামীর কাছে এটিই সত্য।

আমরা গত এক দশক ধরে রাহুল গান্ধীকে রাজনীতিতে দেখছি। রাজনীতিতে তাকে গান্ধীবাদী হিসেবে দেখছি। নির্লোভ, নিরহংকার, ন্যায়নিষ্ঠ হওয়াই তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুতরাং তাকে টলানো যাবে কীভাবে!

রাহুল বলেছেন, তিনি সভাপতি থাকলেন না, কিন্তু সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে কংগ্রেসের কাজ করে যাবেন। মহাত্মা গান্ধীও তো কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন জীবনে একবার। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কংগ্রেস আর গান্ধী তো অভিন্ন ছিলেন। রাহুল সে পথেই হাঁটলেন। কংগ্রেসপ্রেমীদের তাকে সে পথে হাঁটতে দেওয়াই উত্তম হবে। এরমধ্যে তিনি গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছেন। মাটিতে বসে হরিজনদের ঘরে ভাত খেয়েছেন অথচ তিনি কাশ্মিরের উচ্চ জাতে ব্রাহ্মণ। মহাত্মা গান্ধী কিন্তু ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বৈশ্য। শূদ্রের একধাপ উঁচুতে।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়াতে অগৌরবের কিছু নেই। কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী আমেথি এবং রায়বেরেলি কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হয়েছিলেন রাজনারায়ণ নামক এক সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর কাছে। এবার রাহুল তার ঠাকুরমার ভাগ্য বরণ করলেন। আমেথি কেন্দ্রে বিজেপির স্মৃতি ইরানি নামক এক সাবেক অভিনেত্রীর কাছে তিনি পরাজিত হয়েছেন। অবশ্য রাহুল কেরালার অন্য এক নির্বাচনি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।

ইন্দিরা গান্ধী তিন বছরের মাথায় অন্তর্বর্তী নির্বাচনে জিতে পুনরায় ১৯৮০ সালে সরকার গঠন করতে পেরেছিলেন। জনতা দলের অন্তর্কলহে সেইবার সরকার টিকতে না পারায় অন্তর্বর্তী নির্বাচন হয়েছিল। বর্তমান বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং লাল কৃষ্ণ আদভানি জনতা দলের মন্ত্রী হয়েছিলেন। এবার কিন্তু বিজেপিতে কোনও অনৈক্য নেই। অন্তর্বর্তী নির্বাচনেরও কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং কংগ্রেসকে নিয়মিত চিন্তার মাঝেই পথ চলতে হবে। কংগ্রেসকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সভাপতি নির্বাচিত করতে হবে। রাহুল এই বিষয়ে তৎপর হলে উত্তম হয়। কারণ মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড এবং হরিয়ানায় বছর শেষে বিধানসভা নির্বাচন।

নেহরু-গান্ধী পরিবার ছাড়াও ১৩৪ বছরের পুরনো দলটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেক নামজাদা ব্যক্তি। ফলে গান্ধী পরিবার ছাড়া দলটি অচল ভাবার কারণ নেই। কংগ্রেসের সভাপতি পদে এক-দুই বছরের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হতো। সে সংগঠনে একটানা ১৯ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন সোনিয়া আর দায়িত্ব ছেড়েছেনও পুত্র রাহুলের হাতে। রাহুলের সরে যাওয়া দলে সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে আসার সুযোগও তৈরি হলো। কংগ্রেসের হতাশার কিছু নেই। এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সিট কম পেলেও ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অথচ বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২৮২টি আসন পেয়েছিল ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে।

২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ভারত এক গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে গান্ধীর রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে সাভারকার হিন্দুত্বকে অবলম্বন করে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন ভারতে। কিন্তু আরএসএস  আর সাভারকারের রাজনীতি তখন সফল হয়নি। গান্ধী, নেহরু, আজাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চর্চার মুখে দাঁড়াতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা। সর্বোপরি গান্ধী, নেহরু, আজাদ—এরা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী পুরুষ। স্বাধীনতার জন্য তারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বছরের পর বছর জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন। তাদের ভাবমূর্তি ছিল হিমালয়ের মতো সুতরাং আরএসএস আর সাভারকারের পক্ষে তাদের রাজনীতিকে উপেক্ষা করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

এখন সেই ইতিহাস ৭০ বছর অতীতের ইতিহাস। এর মাঝে তারা গান্ধীকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে। শক্তিশালী করেছে সংঘ পরিবার আর তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে। এখন তারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়। দুরভিসন্ধির অংশ হিসেবে তারা চেষ্টা করছে শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে যাতে সমগ্র ভারতে একসঙ্গে লোকসভা এবং রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এখন রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন দলের সরকার থাকার কারণে হিন্দুত্ববাদ কার্যকরী করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। নরেন্দ্র মোদির ডাকে এ সভায় সংঘ পরিবারভুক্ত দল ছাড়া আর কেউ যোগদান করেনি। এ প্রথা রহিত করা যাবে না। মূলত এমন খণ্ড খণ্ড নির্বাচনই হচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এবং কেন্দ্রের কোনও একরোখা নীতি কার্যকর করার পথে বাধা। ভারতের স্থপতিরা সংবিধান রচনা করেছেন বহুবিধ চিন্তা মাথায় রেখে।

একবার মহাত্মা গান্ধী এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বন্দে মাতরম সংগীতটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। সবাই বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়েছিলেন, গান্ধী দাঁড়াননি। কারণ এ সংগীতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আছে। জার্মান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবোজাহাজে করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জাপান গিয়েছিলেন। ডুবোজাহাজে আরোহণের আগে তাকে জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’ গেয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো জানার পর কনস্টিটিউন্ট অ্যাসেম্বলি রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’ গানকেই জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে, বন্দে মাতরমকে নয়।

ভারতের এই যুগের সন্ধিক্ষণে তার স্বাধীনতা সংগ্রামী দল হিসেবে কংগ্রেসের দায়িত্বও বেড়ে গেছে। হিন্দুত্ববাদ ভারতের সংহতি বিনষ্ট করবে। ভারত ক্রমেই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদের লক্ষণ ভারতে বিরাজমান। পার্লামেন্টে মহুয়া মিত্র নামের এক তৃণমূল এমপি তার খানিকটা বয়ান দিয়ে সম্প্রতি ঝড় তুলেছেন। জাত-পাতে তো সমাজটাই বিভক্ত হয়ে আছে জন্ম থেকে। সম্প্রতি ‘আর্টিক্যাল ১৫’ নামের একটি সিনেমায় তার খানিকটা উঠে এসেছে। বাস্তব পরিস্থিতি, সহিংসতার পরিসংখ্যান কিন্তু মহুয়ার ভাষণ আর সিনেমার কাহিনির চেয়েও ভয়াবহ।

গরু খাওয়া নিয়ে গোরক্ষকদের তাণ্ডব, জয় শ্রীরাম বলানো নিয়ে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। নিজেরা অন্য দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দরদ দেখাতে এলেও নিজেদের সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন না ভারতীয় নেতারা। গত মাসে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যলঘুদের অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু ভারত ‘এটি অর্থহীন ও মিথ্যে’, এই প্রতিবেদনের কোনও সত্যতা নেই বলে রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। এক নেতা তো তাদের ব্যাপারে নাক না গলাতেও সাবধান করেছেন।

একটুখানি আশার কথা, সিভিল সোসাইটির কিছু মানুষ সরকারের নির্লিপ্ততায় উদ্বিগ্ন আছেন। তারা বলছেন, এখন মানুষে-মানুষে যেভাবে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, এ জিনিস আমরা ভারতে আগে কখনও দেখিনি। একের পর এক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখন যেভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নীরব থাকছেন, সেটাই আসলে সবচেয়ে উদ্বেগের।  

ক’দিন আগেই দিল্লিতে একটি ছোটখাটো দাঙ্গা হয়েছে। কিছু হিন্দু মিলে একটা মসজিদ ভেঙেছে। তার উত্তরে কিছু মুসলমান একত্রিত হয়ে একটি মন্দির ভেঙে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের জায়গা পাকিস্তানেও হবে না, বাংলাদেশেও হবে না। এই উপলব্ধিটা ভারতীয় মুসলমানদের রয়েছে, সুতরাং তারা এখন তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রতিরোধের পথ বেছে নেবে। প্রতিরোধ মানেই তো সংঘাত। ছোটখাটো একটা গৃহযুদ্ধ। আর এর প্রভাব পড়বে প্রতিবেশীদের ওপর।

এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় কংগ্রেসকে খুবই দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমি বলেছি রাহুল গান্ধীবাদী মানুষ। এখন তার উচিত হবে ভারতীয় সংহতি ও অসাম্প্রদায়িকতার আবেদন নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, যেন গান্ধীর মতোই একটা গণজাগরণের জন্ম দিতে পারেন। এ পথে রাহুলের জয় নিশ্চয় হবে। জয় হবে ভারতের বিবেকবান মানুষদেরও।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
মাদক বহনের সময় দুর্ঘটনা, এরপর থেকে নষ্ট হচ্ছে জাবির ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি
মাদক বহনের সময় দুর্ঘটনা, এরপর থেকে নষ্ট হচ্ছে জাবির ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ