X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবার আলোচনায় এস কে সিনহা

বিভুরঞ্জন সরকার
০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৭:১৯আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৭:২১

বিভুরঞ্জন সরকার বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আবার আলোচনায় এসেছেন। তিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে এখন কানাডায় ধর্ণা দিয়েছেন। গত ৪ জুলাই তিনি সস্ত্রীক কানাডা পৌঁছেই সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।  মার্কিন কর্তৃপক্ষকে তিনি সন্তুষ্ট করতে না পারলেও কানাডায় তিনি সহানুভূতি পাবেন বলে আশা করছেন। যদিও কানাডায় এই মর্মে নতুন আইন হয়েছে যে, তৃতীয় নিরাপদ কোনও দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে তিনি কানাডায় আশ্রয় লাভে অনুপযুক্ত হবেন। এটা বিবেচনায় নিলে এস কে সিনহার জন্য অসুবিধা হবে, কারণ তিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন এবং সেখানে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি, ঝুলে আছে। তবে এক মাস পর কানাডায় তার আবেদনের শুনানি হবে জেনে এস কে সিনহা আশাবাদী যে কানাডায় হয়তো তিনি আশ্রয় পাবেন।
বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে। উত্তরায় একটি বাড়ির বিষয়ে দুদক তদন্তে নেমেছে। তার ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহাকে এরমধ্যে একদিন দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। এস কে সিনহা মামলা-মোকদ্দমা এড়ানোর জন্যই দেশে আসতে চান না। তিনি বিদেশে বসে সরকারের সঙ্গে ‘ফাইট’ করতে চান বলে মনে হয়। বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে গেলে দেশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ করতে হয়। সাধারণত এ অভিযোগগুলো বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে। এস কে সিনহাও নিশ্চয়ই তাই করছেন। তিনি বিদেশে গিয়ে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করবেন, অসত্য তথ্য দেবেন আর সরকার প্রতিক্রিয়াহীন থাকবে–তাই কী হয়?

প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে অসত্য অভিযোগ করে যদি দেশবিরোধী কাজ করে থাকেন, তাহলে আমেরিকা বা কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের জন্য এস কে সিনহা ‘যা নয় তা’ অভিযোগ করলে সেটা কেন গ্রহণযোগ্য হবে?

এস কে সিনহা কোনও সাধারণ মানুষ নন। তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার যে-কোনও ভূমিকাই সরকারকে হিসাবে নিতে হবে। তার তৎপরতা সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকতে পারে না। সম্ভবত সে জন্যই সরকার চায় না তিনি দেশের বাইরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় অংশ নেওয়া অব্যাহত রেখে সরকারকে বিব্রত করতে থাকুন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এম আবদুল মোমেন বলেছেন, আইন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে সিনহাকে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। অন্যদিকে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, মনোবল থাকলে এস কে সিনহার দেশে ফিরে আইনি লড়াই শুরু করা উচিত।

ব্যক্তিগতভাবে আমিও মনে করি, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেশে ফিরে আসা উচিত। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যদি অসত্য হয়, তাহলে তাকেই সেটা প্রমাণ করতে হবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের উপযুক্ত তথ্যাদি নিজের কাছে থাকলে তিনি প্রবাসে আশ্রিতের জীবন-যাপন করবেন কেন? সিনহা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, সরকার একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির মানহানি করছে পদে পদে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি শুধু শুধু তার পেছনে লেগেছে? নাকি তিনিই বারবার সরকারকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন? তিনি তো রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি বিরোধী দলের নেতা নন। তিনি নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি। তিনি কেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মতো কাজ করবেন? এস কে সিনহা বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি। তার আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত আর কেউ বিচার বিভাগের এই সর্বোচ্চ পদাধিকারী হননি। তিনি ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। তার এই পদপ্রাপ্তি খুব স্বাভাবিক ছিল না। দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব যখন প্রবল হয়ে উঠছে, তখন একজন সুরেন্দ্র সিনহাকে প্রধান বিচারপতির পদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিনের ট্যাবু ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মর্যাদাও বাড়িয়েছিলেন। এস কে সিনহা আইনজীবী হিসেবে সেরা ছিলেন বা তার ব্যাপারে দেশের মানুষের মনে খুব উচ্ছ্বাস-আনন্দ ছিল তা নয়। বরং তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল, কিন্তু দেশে একটি নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টির জন্যই হয়তো শেখ হাসিনার সরকার এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির পদে নির্বাচিত করেছিল। এটা শেখ হাসিনার উদারতা। শেখ হাসিনা সরকার প্রধান না হলে এস কে সিনহাকে যে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ভাবা হতো না, সেটা জোর দিয়েই বলা যায়। তার এই মনোনয়ন নিয়ে অনেকের মধ্যেই অসন্তোষ ছিল।

অথচ প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণের পর এস কে সিনহার প্রধান দায়িত্ব হয়ে যায় পদে পদে সরকারকে বিব্রত করা। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গিয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। বিবেচক মানুষের কাছে তার বেশি কথা বলাটা ভালো লাগেনি। তাকে কিছুটা প্রচারপ্রিয় বলেও অনেকের কাছে মনে হয়েছে। তার আগে দেশে ২০জন প্রধান বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু তাদের কারও মিডিয়া ক্রেজ ছিল বলে কারও কাছে মনে হয়নি। এস কে সিনহার কিছু কিছু বক্তব্য দেশে বিতর্কের সৃষ্টি করে। কিছু বক্তব্যে সরকার বিব্রত হয়, সরকারবিরোধীরা উৎসাহিত হয়। তিনি গুরুত্বপূর্ণ দুএকটি মামলা চলাকালে আসামি পক্ষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেও অনৈতিক কাজ করেছেন, বিতর্কিত হয়েছেন।

সর্বশেষ সরকারের সঙ্গে তার বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে। এই রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণে জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বাতিল করা হয়। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের বিরোধের বিষয়টি এস কে সিনহা ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ্যে আনেন। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির কথা উল্লেখ করে তিনি কার্যত সরকার এবং সরকার প্রধানকে হুমকি দেন।

বিচারপতি সিনহা সরকারকে বিব্রত করে ‘হিরো’ হতে চেয়েছেন, সরকার তাতে বিরক্ত হয়েছে। সরকার তাকে আগেই না থামিয়ে ভুল করেছে। বিদেশে অবস্থানরত সিনহা সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেছেন বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন।

এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় তার সঙ্গে একত্রে বিচারাসনে বসে বিচার কাজে অংশ নিতে অন্য বিচারপতিরা আপত্তি জানানোয় সিনহার জন্য পদ ধরে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় সিনহা সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়া হয়ে আমেরিকা চলে যান। কিন্তু সেখানে বসেও তিনি সরকারকে বিব্রত করার কাজটিই করতে থাকেন। যেহেতু সরকারের সঙ্গে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তার উচিত ছিল একটু সময় নিয়ে তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তিনি ধৈর্যহারা হয়ে ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ নামে একটি বই লিখে আরো নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেন। সিনহা একজন আইনের লোক এবং বয়সে প্রবীণ হয়েও যেসব কাজ করছেন তাতে তার চপলতাই প্রকাশ পায়। যারা সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অজুহাত খোঁজে তিনি তাদের হাতে উপকরণ সরবরাহ করে আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু তাকে সরকার সে সুযোগ কেন দেবে? তার নীতি-নৈতিকতা যদি প্রবল হতো তাহলে তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সরকার ঠিক পথে চলছে না, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন না কেন? গাছের খেয়ে তলারটা কুড়ানোর স্বভাব যাদের তাদের কি খুব আদর্শবান মানুষ বলে মনে হয়? এস কে সিনহা ছায়ার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। এতে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা ‘জিরো’।

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ