X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু: অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের প্রতীক

বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী
১৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:৫৩আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৯, ১৩:২৯

 






বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আজ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন আর শেখ রেহানা বড় বোনের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এভাবেই ভাগ্যের ফেরে দুই বোন বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর রক্তধারা এখন দুই কন্যাসূত্রে অব্যাহত আছে। তাঁর তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল আর শেখ রাসেল ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে ঘাতকদের হাতে মা-বাবার সঙ্গে নিহত হয়েছিলেন।


সত্য মিথ্যা জানি না, রাসেলকে হত্যার ব্যাপারে নাকি ঘাতকদের মাঝে দ্বিমত হয়েছিল। এক গ্রুপ বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে জীবিত রাখার পক্ষে ছিল, কিন্তু অপর গ্রুপ নাকি বলেছিল ব্যাঘ্র শাবককে জীবিত রাখলে বড় হয়ে আমাদের নির্মূল করবে। এ কথা বলেই নাকি তাকে গুলি করেছিল। ঘাতকদের অনুমান সত্যি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রবাস থেকে এসে ঘাতকদের বিচার করে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। কোনও বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকাই হচ্ছে শেখ পরিবারের বৈশিষ্ট্য। তারা দুই বোন বেঁচে না থাকলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চোখে দেখে যেতে পারতাম কিনা সন্দেহ।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি আদালতে চাকরি করতেন। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এত বড়মাপের নেতার উত্থান ইতিহাসে বিরল ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ উইক পত্রিকা বলেছে, শেখ মুজিব রাজনীতির কবি। ব্রিটেনের মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ফেনার ব্রোকওয়ে বলেছেন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, দ্য ভ্যালেরার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭০ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বলেছিলেন, আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।
অনুরূপ হিমালয়সম নেতার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম মৃত্যু হয়েছিল কেন? হিমালয়ের পতন হলে তো ধরণী কাঁপবে কিন্তু ধরণী কাঁপলো না কেন! এই বিষয়টার ওপর তো একটা বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার প্রয়োজন ছিল, যা আওয়ামী লীগের পাথেয় হতে পারতো। এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবীরা যে আলোচনা করেনি তা নয়, তবে কেউই সামগ্রিক আলোচনা পেশ করেননি। মনে হয় সব আলোচনায় ছিল খণ্ড খণ্ড। যারা বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করেছেন তারাও সামগ্রিক কোনও কিছু পেশ করেননি এবং তাও ছিল খণ্ড খণ্ড।
১৯০৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে। ভারত পাকিস্তানের বিভক্তিও ছিল ধর্মভিত্তিক। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল মুসলমান তারা একচেটিয়া পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা এমনি এমনি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানকে বাঙালি বলে মনে করতো না। তারা বলতো- আমরা বাঙালি ওরা মুসলমান।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বড়লাট লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলার মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে যখন পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পৃথক প্রদেশ গঠনের উদ্যোগ নেন তখন কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং জমিদারদের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। পৃথক প্রদেশ গঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচণ্ড বাধার কারণে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির মসনদে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা করেন।
এমনি করে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে কাজ করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৪৭ সালে তিনি ছাত্র হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন বাঙালি নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করলেন যে পরস্পর থেকে ১২ শত মাইল দূরে একটা রাষ্ট্রের দুই অংশের অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রটি কখনও একটি কার্যকর রাষ্ট্র হতে পারবে না, তখন তারা বাঙালির মুক্তির কথা চিন্তা করে অঞ্চলভিত্তিক ভাষা ও সাংস্কৃতিকভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জিন্নাহর বক্তব্য ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক জাতি ও জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির একটা পটভূমিকা সৃষ্টি সহজভাবে করেছিল। কিছু সংখ্যক বাঙালি নেতৃবৃন্দ এই সুযোগ কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের শক্তিশালী এক ব্যক্তি প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে ঐতিহাসিক রূপান্তর তার প্রধান সূত্রধর ও শিরোমনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান’।
১৯৪৮ সালে ভাষা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে যে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, ১৯৫২ সালে এসে তা পরিপূর্ণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত মূর্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তমুদ্দিন মজলিস নামে একটা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তি ভাষা আন্দোলনের মাঝে সক্রিয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তি তাকে আত্মস্থ করে ফেলেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অঞ্চলভিত্তিক ভাষা ও সাংস্কৃতিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ চূড়ান্তভাবে সক্রিয় ছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার চূড়ান্ত সফলতা জন্ম থেকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মওলানা ভাসানীও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের পক্ষে কথাবার্তা বলেছেন কিন্তু তা অব্যাহতভাবে নয়। কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার কারণে তিনি কখনও এককভাবে অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করতে পারেননি। এ কাজে কমিউনিস্টরা তাকে বিভ্রান্ত করেছে বারবার। তবু তিনি যখনই বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন তখনই কোনও বাধা না মেনে বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতা গিয়ে সর্বতোভাবে প্রবাসী সরকারকে সহায়তা প্রদান করেছিলেন।
কলকাতা গিয়ে ভাসানীর দলের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কোনও আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায় না। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকেও নির্মূল করা যায়নি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তা আবার ধীরে ধীরে তুসের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। আবার বামপন্থীরাও একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য চরমভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল হক, আলাউদ্দিন, আবদুল মতিন, সিরাজ সিকদার- এরাও পশ্চিমবাংলার চারু মজুমদারকে আদর্শ ভেবে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড উন্মাদের মতো আরম্ভ করেছিলেন। প্রতিদিন তারা পাটের গুদামে আগুন দিতে থাকেন এবং দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগেন। তখন সমাজে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি তা নয়।
বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেন। তখন তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা না করে সংবিধান, ৭৩-এর নির্বাচন, দেশ পুনর্গঠন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আর এ সময়ে বামপন্থীরা এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু যখন তার সারা জনমের গণতন্ত্রের পথ পরিহার করে একদলীয় বাকশালের পথ ধরলেন তখন বাম-ডান আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সবই একটা সাময়িকভাবে এক প্লাটফর্মে সম্মিলিত হয়ে ১৫ আগস্টের কালরাত্রির নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটালো। আর সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো।
অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন রাস্তায় বের হয়নি। তারা কিন্তু বের হলে প্রতিরোধ ঠিকই করতে পারতেন। সাধারণ মানুষ তখন নিরপেক্ষ ভূমিকায় চলে যেতেন। সামরিক বাহিনীর কয়টা লোক তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করেছিল সত্য, সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী তাদের পেছনে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণ, এরপর তোয়াহা প্রমুখ বামপন্থী নেতারা বিপ্লব ঠেলে জিয়ার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন। ডানপন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে সিরাত সম্মেলনের নামে স্লোগান তোলেন- ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই চাঁন-তারা পতাকা চাই।’ এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ডেপুটি চিফ এডমিনিস্ট্রেটর এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব।
আমি এখনও বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন সাহস করে প্রতিরোধের জন্য বের হয়ে এলে তারা সফল হতেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টি ছিল অসংগঠিত মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাজ। এ হত্যার পেছনে যারা ছিলেন তারা সুসংগঠিত ছিলেন না। যাক, এভাবেই ইতিহাসের এক মহানায়কের, হিমালয়সম এক নেতার জীবনাবসান হয়েছিল।
যারা সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ