X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানবিকতার সব দায় কি বাংলাদেশের?

প্রভাষ আমিন
২৫ আগস্ট ২০১৯, ১৫:০৮আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ১৫:০৯

প্রভাষ আমিন হঠাৎ করেই যখন মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২২ আগস্ট তারিখ ঘোষণা করা হলো, অনেকেই খুব আশাবাদী হয়েছিলেন। আমি খারাপ মানুষ। আশাবাদী তো হইনি, উল্টো সন্দেহ করেছি। রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তির তিন দিন আগে প্রত্যাবাসনের এই ঘোষণাকে আমার আইওয়াশই মনে হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে প্রথম দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর মিয়ানমার এমন কী উদ্যোগ নিয়েছে, যে তারা ডাকলেই রোহিঙ্গারা মনের আনন্দে ফিরে যাবে? এই প্রশ্ন আমি নিজেকেই করেছি। উত্তর পেয়েছি, মিয়ানমার এমন কিছুই করেনি। তাই আমি অফিসে অনেকের আশায় জল ঢেলে ঘোষণা করেছিলাম, এবারও প্রত্যাবাসন হবে না। রোহিঙ্গাদের কেউ ফিরে যেতে রাজি হবে না। আশঙ্কাটা সত্যি না হলেই আমি খুশি হতাম। কিন্তু সত্যি না হওয়ার কোনও উপায় ছিল না। আমার মতো একজন অতি সাধারণ সাংবাদিক যদি জানি রোহিঙ্গারা এখনই ফিরে যাবে না, তাহলে কি মিয়ানমার জানে না, চীন জানে না, বাংলাদেশ জানে না। আমার ধারণা সবাই জানে। কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না বলে সবাই প্রত্যাবাসনের মহড়া করেছেন। নির্ধারিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। প্রস্তুত ছিল গাড়ি, প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি ছিল ঘাট। দেশি-বিদেশি মিডিয়া আর এনজিওর তৎপরতায় সরগরম ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্প। দীপ ছিল, শিখা ছিল; শুধু তুমি ছিলে না বলে আলো জ্বললো না…। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও সব ছিল, শুধু রোহিঙ্গারা রাজি ছিল না বলে প্রত্যাবাসন হয়নি। সবাই যদি জানতোই প্রত্যাবাসন শুরু হবে না; তাহলে এত আয়োজন কেন? আমার ধারণা এটা মিয়ানমারের এক ধরনের ফাঁদ। নিজেদের মুখ বাঁচাতে তারা এই আইওয়াশের আয়োজন করেছিল। কারণ মিয়ানমার জানতো, রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিকভাবে আরেক দফা চাপের মুখে পড়েত হবে তাদের। তাই ঠিক আগে আগে একটা প্রত্যাবাসনের মহড়া করতে পারলে আক্রমণের ধার কিছুটা কমবে; অন্তত জবাবে তারা বলতে পারবে, আমাদের অত গাল দাও কেন। আমরা তাদের ফিরিয়ে নিতে চাই। কিন্তু তারা আসেনি। আমাদের কী দোষ?

আজকের এ রোহিঙ্গা সঙ্কটের দোষ পুরোটাই মিয়ানমারের। এখন আন্তর্জাতিক নানা চাপে, নিজেদের ভাবমূর্তির কারণে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের নাটক করছে বটে। কিন্তু দুই বছর আগে এই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রীতিমতো গণহত্যা চালিয়ে একটা আস্ত জাতিকে তাদের শেকড় থেকে উচ্ছেদ করেছে। রোহিঙ্গা নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের আসলে রাখাইনের জমি দরকার ছিল, মানুষ নয়। সত্যি বলতে রোহিঙ্গাদের তারা মানুষই মনে করেনি। একদল ভেড়াকে যেভাবে তাড়ায় মানুষ, হাতিকে যেভাবে খেদায় ঢোকায়; ঠিক সেভাবে গুলি করে, আগুন লাগিয়ে ১০ লাখ মানুষকে সীমানা ছাড়া করেছে। রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার আনন্দে বগল বাজাচ্ছিল মিয়ানমার। তারা এতটা করতে পেরেছিল, কারণ তাদের পাশে চীন আছে, রাশিয়া আছে, ভারত আছে। কেন আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি অবাক হতেও ভুলে যাই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মিয়ানমারের বন্ধুত্ব চীন, রাশিয়া, ভারতের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে আছে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, সম্পদ, কানেকটিভিটি, বন্দর, পাইপলাইন ইত্যাদি ইত্যাদি স্বার্থ। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কটকেও কেউ কেউ স্বার্থের নিরিখে বিবেচনা করেন। ১১ লাখ মানুষ বছরের পর বছর আরেক দেশে উদ্বাস্তু হয়ে থাকবে আর চীন-মিয়ানমার নিজেদের স্বার্থের হিসাব কষবে; পুরো বিশ্বটাই মগের মুল্লুক হয়ে গেলে। পুরো সমস্যাটা বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। অথচ এখানে বাংলাদেশের কোনও স্বার্থ নেই। বাংলাদেশ পুরো বিষয়টি দেখছে মানবিকতার বিবেচনায়। কিন্তু মানবিকতার সব দায় কি বাংলাদেশের একার? মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, ভারত—কারো অভিধানে কি মানবিকতার বিষয়টি নেই? তারা কি শুধু স্বার্থ দেখবে আর নাটক করবে? রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে রাখাইনে ইকোনমিক জোন বানানোর স্বপ্ন দেখবে?

ঠিক দুই বছর আগে যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে, তখন বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারতো। রোহিঙ্গা ঢল ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু একটা মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া মানবিক বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের প্রশংসার বন্যা। কিন্তু খালি প্রশংসায় তো চিড়া ভিজবে না। সবাই মিলে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যা হলো, রোহিঙ্গা ঢলের সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজার আর টেকনাফে দেশি-বিদেশি নানান এনজিও আর আন্তর্জাতিক সংস্থারও ঢল নেমেছে। দারিদ্র্যই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসা। আর দরিদ্র শরণার্থীরা সেই ব্যবসার ব্লু চিপস। টেকনাফে তাই বিশাল হাট বসেছে। এনজিওগুলো ১০০ টাকা নিয়ে আসে, ২০-৩০ টাকা রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করে। বাকি টাকা খরচ হয়, তাদের আসা-যাওয়া আর আয়েশি জীবন-যাপনে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে, বিলাসী হোটেলের ভাড়া বেড়েছে। এ কারণে  এই এনজিওগুলো চাইছে না, রোহিঙ্গারা ফিরে যাক। তাই প্রত্যাবাসনের প্রশ্ন এলেই কিছু এনজিও উল্টা মটিভেট করে, রোহিঙ্গাদের সামনে দাবি তুলে ধরে; যাতে তারা ফিরে না যায়।

বাংলাদেশের মানবিকতার গল্প অনেক হয়েছে। দুই বছরে বাংলাদেশ ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এনাফ ইজ এনাফ। এবার দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়, আন্তর্জাতিক, জাতিসংঘ—সবাই মিলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ কখনোই তাদের জোর করে পাঠাবে না। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় তাদের ‘আরামটা একটু কমিয়ে দিতে হবে।’ আর রোহিঙ্গাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, তোমাদের দেশ মিয়ানমার, সেখানে ফিরে গিয়েই তোমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বার্গেইন করতে হবে।

প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গারা পাঁচটি শর্ত দিয়েছে—নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমি ফেরত, নিজেদের গ্রামে বসবাসের নিশ্চয়তা এবং অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা। খুব ন্যায্য দাবি। এই দাবি পূরণ না হলে তারা ফিরবে কেন? এখন যে এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের ফিরে না যেতে মটিভেট করছে; তাদের আরেকটা টিম রাখাইনে যাক। গিয়ে দেখুক সেখানকার পরিবেশ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত কিনা। হলে সেটা রোহিঙ্গাদের বলুক, না হলে মিয়ানমারকে চাপ দিক। বাংলাদেশও মিয়ানমারকে বারবার বলছে, রোহিঙ্গাদের ১০০ জন নেতৃস্থানীয়কে রাখাইনে নিয়ে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ দেখানো হোক। তারা ফিরে এসে যদি আস্থার কথা বলে, তবেই প্রত্যাবাসন হবে, নইলে নয়। শুধু কয়েকটা ঘর তুলে রাখলে রোহিঙ্গারা যাবে না। মিয়ানমারকে আন্তরিক হতে হবে, চীনকে আন্তরিক হতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ সামনে এলেই প্রত্যাবাসনের কথা বলে নাটক করবেন, আন্তর্জাতিক মহলে অ্যাডভান্টেজ নেবেন, দায় চাপাবেন বাংলাদেশের ঘাড়ে; দিনের পর দিন এই প্রহসন চলবে না। মিয়ানমারের মানুষ মিয়ানমারকেই ফিরিয়ে নিতে হবে।

আর রোহিঙ্গা ভাইদেরও বলি, আপনাদের সব দাবি যৌক্তিক। কিন্তু সব বাংলাদেশের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই আদায় করতে হবে কেন? আপনাদের নাগরিকত্বের সমস্যা তো ৭০ বছরের পুরনো। দুই বছরে তো সেটা সমাধান হবে না। ২০১৭ সালে আপনারা যখন এসেছেন, তখন কি আপনারা মিয়ানমারের নাগরিক ছিলেন? নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আপনারা ফিরে যান। গিয়ে নিজেদের দাবি আদায়ে লড়াই করুন। আপনারা বিপদে পড়েছিলেন, আমরা আশ্রয় দিয়েছি। এখন অকৃতজ্ঞ হবেন না, আমাদের বিপদের কারণ হবেন না। আপনারা অতিথি। এসেছেন। আমরা আপ্যায়ন করেছি। অনেক হয়েছে। এবার ফিরে যান নিজের শিকড়ে। পরদেশের ক্যাম্পের চেয়ে নিজের দেশের গাছতলাও ভালো।

ছোট মুখে একটা ছোট কথা বলি। টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। প্রতি দুই বছরে আরো এক লাখ যুক্ত হবে। রোহিঙ্গা শিশুরা, তরুণরা, যুবকরা বেড়ে উঠছে বঞ্চনা আর বৈষম্য দেখে দেখে। তাদের পিঠ অনেক আগেই দেয়ালে ঠেকে আছে। তারা যদি রুখে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ করে; জঙ্গিবাদে জড়ায়, সন্ত্রাসে জড়ায়, তাদের কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে? কিন্তু মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, ভারত আপনাদের বলছি; আপনারা যদি ভেবে থাকেন; পুরো রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আপনারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন; তাহলে ভুল। টেকনাফে টাইম বোমা রেখে আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না। বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় না, দেবেও না। কিন্তু রোহিঙ্গারা তেমন কিছু করলে তার প্রথম টার্গেট কিন্তু মিয়ানমার, চীন, ভারত, রাশিয়া; বাংলাদেশ নয় মোটেই। বিশ্বায়নের এই যুগে সন্ত্রাসেরও বিশ্বায়ন ঘটছে। তাই যেখানেই থাকুন, ঝুঁকি আপনার থাকবেই।

আর মিয়ানমারকেও বলি, রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবেন না। নিজের দিকে তাকান। গত দুই বছরে ভাবমূর্তি কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মিয়ানমার মানেই এখন অত্যাচারী রাষ্ট্র। যে স্বার্থের কথা বলেন, হিসাব করে দেখুন, গত দুই বছরে বিনিয়োগ কত কমেছে। আপনাদের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা নিষিদ্ধ। পর্যটকরা ঘৃণায় মিয়ানমার যায় না। এভাবে চলতে থাকলে, নিজেদের মান-সম্মান বাঁচাতে আপনাদের বন্ধুরাও কিন্তু আপনাদের পাশে থাকবে না। ছোট্ট রোহিঙ্গাদের তাড়াতে গিয়ে আপনাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে। মনে রাখবেন, একটা জাতিকে নির্যাতন করা যায়, নিপীড়ন করা যায়; ধ্বংস করা যায় না। ৭০ বছর চেষ্টা করেও পারেননি। এবার অনিচ্ছায় হলেও মেনে নিন। অনেক বেশি দেরি হওয়ার আগেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন। মানবিকতার দায় কিন্তু বাংলাদেশের একার নয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ