X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এই নেট দুনিয়ায়…

মো. সামসুল ইসলাম
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৪৬আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:১৪

মো. সামসুল ইসলাম নেট দুনিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা। আমরা যতটুকু না রাষ্ট্রের নাগরিক বা সিটিজেন তার চেয়ে ঢের বেশি নেট দুনিয়ার নাগরিক বা নেটিজেন। রাষ্ট্রের নাগরিকদের তো তাও একটা সংবিধান আছে– রাষ্ট্রে অবস্থান করতে কিছু আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। তবে নেটিজেনরা এক রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকায় তাদের অনেক ক্ষেত্রেই আইন-কানুন মেনে চলতে হয় না। আর সবাই যখন নেট দুনিয়ায় তাদের আবেগ, অনুভূতি ঢেলে দিচ্ছেন সেখানে আইন দিয়ে আর ক’জনকেই বা আটকানো যায়!
আপনি কাউকে সামাজিকভাবে উঠাতে চান বা নামাতে চান বা ফাঁসাতে চান বা হেনস্থা করতে চান–কিছুই করতে হবে না আপনাকে। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে দেন। আর এর ফলে কারও মানসম্মান থাকলো বা গেলো এতে কিছুই যায় আসে না।  উন্নত দেশগুলোতে এ প্রবণতা কম হলেও আমাদের এই  উপমহাদেশে আমরা প্রতিনিয়ত এটা দেখছি। বাংলাদেশে অধিক মামলা হয় এরকম কোনও একটি জেলা সম্পর্কে একটি কৌতুক আমরা সবাই হয়তো জানি। সে জেলার এক তরুণ কোনও এক কাজে শহরে এসেছে। শহরে এসে সে বলছে, ‘শহরে যখন আসলাম, চাচার নামে একটা মামলা দিয়ে যাই।’
ফেসবুকে আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। সবাই হয়তো নয়, কিন্তু আমরা অনেকেই মনে করি ফেসবুকে যখন ঢুকলাম  তখন একটা স্ট্যাটাস বা কমেন্ট দিয়ে যাই। আর ফেসবুকেই বহুল প্রচারিত একটি পোস্টে থেকে জেনেছি যে ভালো মন্দ যাই হোক, মানুষের প্রতিটি স্ট্যাটাসের পেছনে নাকি অন্য কোনও মানুষ বা কোনও উদ্দেশ্য থাকে।      
সারাদেশ যখন জামালপুরের ডিসির ভিডিও নিয়ে উন্মত্ত তখন সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কথাটি বলেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেছেন, জেলা প্রশাসকের খাস কামরায় সংঘটিত ঘটনায় কারও দোষ থাকলে তার বিচার হওয়া উচিত, কিন্তু ভিডিও যারা ছড়িয়েছেন তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মাত্রা অতিক্রম করেছেন।  
তিনি সম্পূর্ণ সঠিক কথা বলেছেন। খাস কামরার এই সংস্কৃতির আমাদের বিরোধিতা করা উচিত, যারা এ ধরনের কাজে জড়িত তাদের বিচার প্রার্থনা করা উচিত। কিন্তু আমরা কেউ প্রশ্ন তুলিনি এই ভিডিও ছড়ানোর যৌক্তিকতার ব্যাপারে, চিন্তা করিনি ওই দুই পরিবারের নিরীহ সদস্যদের ব্যাপারে, যাদের এ ঘটনার ব্যাপারে কোনও দায় নেই। আমরা আসলে জড়িত দুজনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকভাবে মেরে ফেলেছি তাদের পরিবারের অন্য নির্দোষ সদস্যদেরও।
আবার বাংলা সিনেমায় আমরা একসময় দেখেছি তরুণ-তরুণীরা আগে বিধাতাকে সাক্ষী রেখে প্রেম করতো। তবে এখনকার তরুণরা প্রেম করছে মোবাইলকে সাক্ষী রেখে। প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখছে এবং পরবর্তীতে সম্পর্কে কোনও জটিলতা তৈরি হলে তার ছবি তারা মোবাইলে ছড়িয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে। গণমাধ্যমে দেখছি অনেক মেয়ে এতে আত্মহত্যা করছে, কেউ পড়াশোনা ছাড়ছে। আবার কাউকে বা আইনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।    
কিন্তু নেট দুনিয়ায় এসব চিন্তাভাবনার কোনও বালাই নেই। যে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে আমরা তাদের এদেশে আশ্রয় দিলাম, এখন সেই নেট দুনিয়ার একাংশই তাদের বহিষ্কার চাইছে, গালাগালি দিচ্ছে। কিছু লেখা দেখে আমার এতই খারাপ লাগলো যে আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিতে বাধ্য হলাম। আমি বললাম নির্যাতিতদের পক্ষ নেওয়াই তো মানবিকতা। এ সংকটের সমাধানে হয়তো সময় বেশি লাগবে কিন্তু আমরা তো তাদের হঠাৎ করেই বাঘের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।  
এতো গেলো নেট দুনিয়ার খারাপ দিকের কথা। কিন্তু নেট দুনিয়ার অনেক ভালো দিকও তো আছে। ফেসবুকে মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে অনেক ব্যবসা টিকে আছে। অনেকেই করে খাচ্ছেন। মানবিক সম্পর্ক পাচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। আছে সম্পর্ক পুনর্গঠন বা পুনর্বিন্যাসের উপায়। আছে রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক চর্চা। নেট দুনিয়ায় কী না হচ্ছে? এখানে আছে আবেগ, আছে প্রেম, আছে ঘৃণা। আছে লাইক, ফ্রেন্ড, ব্লক আর আনফ্রেন্ডের জটিল মনস্তত্ব। এগুলো নিয়ে কি আমরা চিন্তা করি?
আমাদের মনোজগতে ফেসবুক তো প্রতিনিয়ত এক সুনামি সৃষ্টি করছে। এতে যেমন আছে ভালোবাসার সুনামি, আবার পারস্পরিক তুলনা করছি, হতাশায় ভুগছি। এই সেদিন আমি আমার এক বন্ধুকে হাসতে হাসতে বলছিলাম, আমি নিশ্চিত যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ জনের ব্যাচের মধ্যে ধনসম্পদের দিক থেকে আমি সবচেয়ে দরিদ্র। কথাটা সত্য বা মিথ্যে সেটি বড় কথা নয়। কিন্তু আমি আমার নিজের অর্থসম্পদ সম্পর্কে এক ধরনের তুলনায় যেতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ, সবার ধনসম্পদের উন্নয়নের সূচকগুলো ফেসবুক আমাদের প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে। কে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন, কার কীরকম গাড়ি আছে, কার ছেলেমেয়ে কোন স্কুলে পড়ে এগুলো দিয়ে তো একজনের সামাজিক অবস্থান বা অর্থনৈতিক বৈভব বোঝা যায়।
ফেসবুকের লাইক, ব্লক আর আনফ্রেন্ডের ফিজিক্যাল বা মেন্টাল ট্রমা নিয়ে আমরা কতজনই বা চিন্তা করি। এ সম্পর্কে অনেক ঘটনাই শুনি বা পড়ি। তবে অন্যের ঘটনা না বলে নিজের কথাই বলি। যেমন ফেসবুকে আমি এখন আর কোনও কটু মন্তব্য সহ্য করতে পারি না। আমি এজন্য সম্প্রতি কয়েকজনকে আনফ্রেন্ড করেছি।
আবার আমার পুরনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছিল এরকম এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি কয়েকদিন আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। কিন্তু সে আমার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলো না। কেন করলো না এটা নিয়ে আমার বেশ কয়েকদিন মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে দিন কাটলো। আমি লেখালেখি করি এটা নিয়ে সে কি ক্ষুব্ধ, নাকি পত্রিকার কলাম লেখকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকে সে বিপজ্জনক মনে করছে –এসব বিভিন্ন চিন্তা করে এর কোনও কূলকিনারা পেলাম না।  
আসলে আমাদের দেশে নেট দুনিয়ায় যেভাবে পত্রিকার লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্টদের আক্রমণ করা হয় তা অন্য কোনও দেশে হয় কিনা সন্দেহ। আমি বিদেশি কয়েকজন ভালো লেখককে ফলো করি, কিন্তু এরকম মন্তব্য তো দেখি না। আগে পত্রিকায় একটা লেখা প্রকাশিত হলে বা টিভিতে একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে এর পক্ষে বিপক্ষে পাঠকেরা পত্রিকায় মতামত পাঠাতেন। সেখান থেকে  দু’-একটি নির্বাচিত প্রতিক্রিয়া সম্পাদনার মাধ্যমে পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। কিন্তু এখন প্রতিটি লেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়, একটু এদিক-ওদিক হলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে তুলোধুনা করা হয়। আমাদের দেশে প্রচুর লেখকের দরকার হলেও এজন্য অনেক মেধাবী লোকজনই আজকাল পত্রিকায় লিখতে চান না। প্রতিটি লেখা নিয়ে এত মানসিক স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষমতা কয়জনের আছে? সমালোচনা করুন কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে করুন। লঘুপাপে গুরুশাস্তিতো কোনোভাবেই দেওয়া উচিত নয়।  
আসলে নেট দুনিয়াই আমাদের জীবনের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিয়ে বলুন, চাকরি বলুন বা বিদেশে ভিসাপ্রাপ্তি, সবক্ষেত্রেই প্রথমেই এখন ফেসবুকে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। যেমন বিগত জুনে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে এখন থেকে ভিসা পেতে সবাইকে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহৃত নাম (ইউজার আইডি), এবং পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করা হয়েছে এমন ইমেইল এবং ফোন নম্বর জমা দিতে হবে। কারণ, সন্ত্রাসীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক অপব্যবহার করছে।
বোঝাই যায় ব্যাপকতার আর প্রভাবের কারণে নেট দুনিয়ায় নজরদারি দিনে দিনে বাড়বে। এটি কোনোভাবেই কমবে না। তবে এটা ঠিক যে নেটদুনিয়া মানুষের আবেগ অনূভূতি প্রকাশের ভালো জায়গা হলেও এখানে শৃঙ্খলা দরকার, এখানে সবার লিখিত বা অলিখিত সংবিধান বা নীতিমালা মেনে চলা উচিত। বিশেষত নেটদুনিয়ায় যাতে একজন অপরজন দ্বারা কোনোভাবেই নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার।  
লেখক: কলামিস্ট
ইমেইলঃ [email protected]

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ