X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়ার বোর্ড থেকে মাঠে ফিরুক খেলা

তুষার আবদুল্লাহ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০৩আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০৬

তুষার আবদুল্লাহ গেলো শতকের আশির দশকে আমাদের কিশোর-তরুণদের উচ্ছ্বাসের বড় উপলক্ষ ছিল ফুটবলের সুপার ও প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ। সংবাদপত্রের পাঠক হতে অভ্যস্ত হওয়ার পেছনে ছিল এই ফুটবল। মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়নের পাশাপাশি আমরা খবর রাখতাম ইয়াংমেন্স ফকিরাপুল, আরামবাগ, ওয়ারী থেকে শুরু করে চলন্তিকা, ইস্টঅ্যান্ড ক্লাবেরও। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্র নিয়েও আমাদের চিন্তায় পড়তে হয়েছিল। কারণ মোহামেডান, আবাহনীর ঘাড়ে শিরোপার লড়াইয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিল তারা। ছোট দলগুলো নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকতাম। কবে তারা আটকে দেয় মোহামেডান বা আবাহনীকে। শীর্ষ দুই দলের যেদিন খেলা, সেদিন শহর রূপ নিতো পতাকার নগরীতে। আবাহনী-মোহামেডানের খেলার দিন স্কুল ছুটি হয়ে যেতো, আমাদের সন্তানদের কাছে রূপকথার গল্প মনে হতে পারে আজ। বেতার বা টিভিতে ছোট দুই দলের খেলার ফল রাতের খবরে না জানালে ঘুম হারাম। সকালে কখন পত্রিকা পাবো। জানবো আদমজী ও ধানমন্ডির মধ্যে কে জিতলো? পত্রিকা কখন পৌঁছাবে সেই অপেক্ষার প্রহর গোনাও অসম্ভব হয়ে পড়তো। বাড্ডা থেকে চলে আসতাম ফার্মগেট জনতা ব্যাংকের সামনে। যেখান থেকে আশপাশের এলাকার পত্রিকা বিলি হতো। আজকের ফেসবুক, অনলাইন, এসএমএস প্রজন্মের কাছে এই গল্প অবিশ্বাস্য হতে পারে। আমাদের সময়ে তারকা ছিলেন সালাম মুর্শেদী, গোলরক্ষক মোহসীন-কানন, আসলাম, বাদল রায়, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, সাব্বির, ইলিয়াস, মনু, এমিলি, জসি, ওয়াসিম, জনি, জুয়েল রানা। তারা সিনেমার নায়কের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন আমাদের কাছে। সিনেমার নায়ক-নায়িকা দেখতে যেমন এফডিসির গেটে ভক্তরা ভিড় করতেন, তেমনি আমরাও এক নজর এই তারকা খেলোয়াড়দের দেখতে ক্লাবের সামনে ভিড় করতাম, যদি একবার প্রিয় তারকাকে এক নজর দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যে অপেক্ষার নজির আছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফুটবল পাগল এসে ভিড় করতেন। পরবর্তী সময়ে এই ক্লাবগুলোকে ঘিরেই ক্রিকেটের তারকারাও তৈরি হতে থাকেন। গাজী আশরাফ লিপু, আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, ফারুক আহমেদ, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, দুলু, মোহাম্মদ রফিকেরা ক্রিকেটের তারকা হয়ে ওঠেন। হকিতে জুম্মন লুসাইসহ আরও কত নাম চলে আসে। হকির দলগুলোও জনপ্রিয় হয় উষা, অ্যাজাক্স, সোনালী ব্যাংক, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং।  ক্রীড়া ক্লাবগুলোর সেই জৌলুস এখন আর নেই। আমাদের সন্তানরা ভিনদেশের ক্লাবের নাম যতটা জানে, নিজ দেশের ক্লাবের নাম সেভাবে জানে না। এর কারণ শুধু বিশ্বায়ন বা দৃশ্যমাধ্যম বিস্ফোরণের সুফল, তা নয়। আমাদের স্থানীয় লিগের অনিয়মিত হয়ে পড়া। মানের দৈন্যদশাই এর জন্য দায়ী।

ক্লাবগুলোর বাহ্যিক জৌলুস বেড়েছে। সাম্প্রতিক অভিযানে দেখলাম ক্লাবে অন্দরের চাকচিক্য কম বাড়েনি। কমেছে ক্লাব পরিচালনার দক্ষতা। দেখা দিয়েছে যোগ্য নেতৃত্বের। এই ক্লাবগুলো বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি বা শিল্পগোষ্ঠীর অনুদানে চলতো। ক্লাব পরিচালনা করতেন ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তি বা সংগঠক। স্থানীয় সমাজসেবীদের পাশাপাশি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকরাও ক্লাব পরিচালনায় সক্রিয় থাকতেন। রাজনীতিবিদদের অনেকেও যুক্ত ছিলেন। ক্লাব থেকে আয় করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তারা ক্লাবের জন্য নিবেদিত থেকেই খুশি ছিলেন। ক্লাবের নিজস্ব আয়েরও ব্যবস্থা ছিল। ‘হাউজি’ নামক জুয়ার একপ্রকার অলিখিত অনুমোদেন ছিল। রাতে চলতো হাউজি খেলা। এখান থেকে আসা আয় ক্লাবের খরচের খাতায় যেতো। ধীরে ধীরে দেখা গেলো, ক্রীড়ামোদী সংগঠকদের চেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা অধিকাংশ ক্লাবের নেতৃত্বের দখল নিতে শুরু করে দিলেন। এক প্রকার ক্লাবের মালিকানা নেওয়ার মতো। খেলাপাগল ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, প্রাক্তন খেলোয়াড় এমনকি খেলা মনস্ক রাজনীতিবিদ ক্লাবের উঠোন অনেকেই থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেন। ধীরে ধীরে ক্লাবগুলো চলে গেলো রাজনীতির তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির নেতৃত্বের কাছে। যে কারণে আমরা দেখতে পেলাম প্রিয় ফুটবল, ক্রিকেট, হকি দলগুলোর অবনমন। ফেডারেশনগুলোতে নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা। মোটকথা পুরো ক্রীড়াঙ্গনই ক্রীড়ার মেজাজ হারালো। মেজাজ হারানোর কারণ অবশেষে আবিষ্কৃত হয়েছে। ক্লাবগুলো কতিপয় রাজনৈতিক লেবাসধারী মানুষের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মূল খেলার চেয়ে মনোযোগ চলে গিয়েছিল জুয়ার বোর্ডে। জুয়ার বোর্ড থেকে টাকা এলেই হলো, মাঠে খেলা গড়াক বা না গড়াক।

ক্রীড়া ক্লাবগুলোর সাম্প্রতিক অভিযান নিয়ে নানা জনের নানা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। কিন্তু সবার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্লাবগুলোকে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। মাঠে নিয়মিত খেলার আয়োজন করা। খেলার মান বাড়ানো। এজন্য ক্লাবের আয়ের পথগুলো নিশ্চিত রাখতে হবে। সরকারি অনুদানে কোনও ক্লাব চলে না। এখানে প্রকৃত ক্রীড়ামনস্ক পৃষ্ঠপোষকদের প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। সাবেক খেলোয়াড়, দক্ষ ক্রীড়া সংগঠকরা নেতৃত্বে এসে ঠিক করুক ক্লাবের আয়ের উৎস কী হতে পারে। যদি হাউজি বা ক্যাসিনো সমাধান হয়, তাহলে তার বৈধতা দিতে হবে। সেই সঙ্গে এর মাধ্যমে যেন কোনও অপরাধী ক্লাবের নিয়ন্ত্রক না হয়ে ওঠে সেদিকে ক্রীড়া পরিষদ ও মন্ত্রণালয়কে মনোযোগ দিতে হবে। যদি ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত মানুষগুলোকে আবার ক্লাবে ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে মোহামেডান, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্র আবারও তাদের পুরনো ঐতিহ্যে ফিরবে। ফিরতে হবেই তারুণ্যের প্রয়োজনে।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ