শূন্যতা বাজে শোনো রুপালি গিটারে
কে আছো বাজাও আজ বাজাও আমারে
পাঁজরটা খুলে দেখো বাজে অন্তর
সেখানেতে আছে এক স্বপ্ন শহর
শহরে নতুন তাই চিনিনি তো তারে
প্রবর্তক মোড় সাজে রুপালি গিটারে
চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার যে রুপালি গিটারটা আছে, বাংলার অগণিত সংগীতপ্রেমীর হৃদয়ে সেই গিটারের উচ্চতা আরও অনেক বেশি। বীর চট্টলার মানুষেরা রুপালি গিটারের ভাস্কর্য তৈরি করে শুধু আইয়ুব বাচ্চুকেই সম্মানিত করেননি, আধুনিক বাংলা ফর্মের গানকেও স্থায়ী করেছেন নিজেদের বুকে। বাউলের একতারার পরে (যদিও এই ভাস্কর্য স্থায়ী হয়নি) রুপালি গিটারই ‘সংগীত ভালোবাসার আরেক ভাস্কর্য’, যা নিয়ে গানপ্রেমীরা গর্ব করতে পারেন।
কিন্তু গত একটা বছরে কেমন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার? কেমন ছিল তার প্রাণের এলআরবি? নাজিম হিকমত তাঁর জেলখানার চিঠি কবিতায় লিখেছিলেন—বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একটা বছর! আসলে কি তাই? শোক সয়ে ভুলে যাওয়া এতই সহজ? আইয়ুব বাচ্চুর জীবদ্দশাতেই এলআরবি-লিটিল রিভার ব্যান্ড থেকে লাভ রানস ব্লাইন্ড হয়েছিল। ব্যান্ড সদস্যসহ আরও অনেকের কাছে ‘বস’ আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি ‘অন্ধ ভালোবাসা’ থাকলেও তার মৃত্যুর পরে কার্যত ‘ভেঙে গেছে’ ব্যান্ড এলআরবি। আইয়ুব বাচ্চুবিহীন ব্যান্ড সদস্যরা দু’ভাগে বিভাজিত হয়ে নিয়মিত শো করার চেষ্টা করলেও নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কটাও হয়তো এখন আর আগের মতো নেই। আগের মতো নেই হয়তো গানের ডাক। আর তাই হয়তো জমকালো শো করার সময়ে নিয়মিত যে বাদ্যযন্ত্রগুলো (গিটার, কী-বোর্ড, ড্রামস) বাজানো হতো, এলআরবির সেই বাদ্যযন্ত্রগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গিটার সংগ্রহ করা আইয়ুব বাচ্চুর শখ ছিল। দেশ-বিদেশে তিনি গিটারের দোকানে যেতেন, সংগ্রহ করতেন, একা একা সেসব গিটার বাজাতেন। এমন চুয়াল্লিশটা জমানো গিটার তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে ও মেয়ে বিদেশে থাকছেন। তারা জানিয়েছেন, তাদের বাবার গান মঞ্চে গাইতে কারও কোনও বাধা নেই। মগবাজারের কাজী অফিস গলির যে বাসাটায় আইয়ুব বাচ্চু গান চর্চা করতেন, গিটারে সুর তুলতেন, কিংবা গানের সুর করতেন, ব্যান্ডের প্র্যাকটিস বা শুভানুধ্যায়ী ভক্তদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন—সেই বিখ্যাত ‘এবি কিচেন’ আর নেই। এ বছরের মার্চে বাসাটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইয়ুব বাচ্চু নেই, এবি কিচেন কিংবা এলআরবিও থাকবে না—এটাই হয়তো বাস্তবতা। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—‘চোখ খুললে জীবন। চোখ বুজলেই মৃত্যু। জীবনের রঙটাই এমন!’
একসময়ে নিজের জীবনী লেখার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। নিজেই আবার সরে এসেছিলেন সেই ইচ্ছে থেকে। বলেছিলেন, ‘জীবনের কিছু দুঃখ বেদনা কিংবা আনন্দের ঘটনা বলে যাওয়ার দরকার নেই’। বলেছিলেন, ‘আগের মতো আর আবেগতাড়িত হই না। অনেক কিছুই আর অনুপ্রাণিত করে না। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে তাদের জন্য, যারা আমার গান শোনার জন্য রাত জাগেন। রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভেজেন! নতুন করে এখন আর কোনও স্বপ্ন দেখি না!’ স্বপ্ন ফুরিয়ে যায় না কখনও। আইয়ুব বাচ্চু তার এমন ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের মাঝেই বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল।
এলআরবি নিয়ে তার স্বপ্নটা ছিল এমন–‘এলআরবি শুধু ব্যান্ড দল নয়। এটা পরিবার। আমি না থাকলেও আমার বা আমাদের উত্তরাধিকাররাই এলআরবিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে।’ যদিও এলআরবি সদস্যরা এখন আর এক নেই। তবু অগণিত শ্রোতার হৃদয় থেকে হারিয়ে যাবেন না আইয়ুব বাচ্চু।
মঞ্চে নাটক আর ব্যান্ডের দল নাকি সবচেয়ে বেশি ভাঙে। অনেকেই বলেন—দ্বন্দ্বের শেষে ভাঙন আর ভাঙনেই বিকাশ! যাদের হৃদয়ে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, নতুন কোনও গান না এলেও তেমনই থাকবেন তাদের হৃদয়ে। তবু নতুন করে বিকশিত হবেন নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে। তার মৃত্যুর পরে এক লেখায় লিখেছিলাম, ‘ব্যান্ড সংগীতের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ক্যাপ পরা গিটার হাতে স্মার্টলি আপনার বাজানো স্মৃতি থেকে কখনও যাবে না। না পাওয়ার বেদনা, স্বজন হারানোর কষ্ট, বাবা-মা’র মৃত্যু, পরাজয়ের বেদনা সইতে নতুন যে ছেলেটা গিটার হাতে নিয়ে বসবে, তার আজম খান কিংবা লাকি আখন্দের মতো আপনার কথাও মনে পড়বে। কেউ হয়তো একাত্তর সালে ‘সাবিত্রী রায়’ কেন দেশত্যাগ করেছিল সেটা ভাববে। তারাভরা রাতে কেউ ময়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। দরজার ওপাশে নিজ ভুবনে চিরদুঃখী মানুষটার কষ্ট বোঝার চেষ্টা করবে। কেউ এক আকাশ তারা গোনার জন্য তার প্রিয়তমাকে আহ্বান জানাবে। কেউ ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র আড়ালে হাসি শেষের নীরবতাটা অনুভব করার চেষ্টা করবে। কেউ ‘শেষ কবে বৃষ্টিতে করেছিলে স্নান, মনে আছে নাকি নাই’-এর হিসাব কষবে। আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার ছড়িয়ে যাবে সারা বাংলাদেশে’!
ইতোমধ্যে আইয়ুব বাচ্চুর জন্মশহর চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ঠাঁই করে নিয়েছে রুপালি গিটার। তার জন্ম আর মৃত্যুদিনে এখানে সমবেত হতে পারবেন তার ভক্তরা। যারা আইয়ুব বাচ্চুর কোনও গান গেয়ে তাকে স্মরণ করতে চান, তারা প্রবর্তক মোড়ের রুপালি গিটারের সামনে গিয়ে সেই গান গাইতে পারবেন। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে গিটার হাতে এই প্রজন্মের কেউ মিনতি জানাতে পারবেন—আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে, তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়! আশি আর নব্বই দশকের ব্যান্ড সংগীতের সেই উত্তাল দিনগুলোর জোয়ার ফিরিয়ে আনতে কেউ কেউ হতে চাইবেন আইয়ুব বাচ্চুর মতো। প্রবর্তক মোড়ের রুপালি গিটার চত্বর ক্রমশ হয়ে উঠতে পারে ব্যান্ড সংগীতের প্রাণকেন্দ্র।
আমেরিকা-ইউরোপে একসময়ে মনে করা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড দল বিটলস! জনপ্রিয় ছিল ইগলস, অ্যাবা, বনিয়েম কিংবা আরও অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ড। কালের পরিক্রমায় মারা গেছেন বব মার্লে কিংবা মাইকেল জ্যাকসন, মারা গেছেন জর্জ মাইকেল কিংবা বাংলাদেশের আজম খানের মতো শিল্পীরা। নানা কারণে ভেঙেছে জনপ্রিয় অনেক ব্যান্ড। কিন্তু সংগীত থেমে থাকেনি কখনও। যারা গান ভালোবাসে তারা মানুষকেই ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। হৃদয়ের সুর-ঝংকারই চিরকালীন সংগীত।
চিরকালীন সংগীতের সুর-ঝংকার নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশে।
লেখক: রম্যলেখক