X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

কর্তব্যের ও গৌরবের যুব সমাজ

রেজা সেলিম
২৫ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৫১আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৯, ১২:০১

 

রেজা সেলিম পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্যে কর্তব্য পালনে যুব সমাজের যত রকম ভূমিকা আছে সেসবের সবক’টি উদাহরণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, আচরণ ও নানা সময়ে দেওয়া নির্দেশনাগুলো ভালো করে অনুধাবনের চেষ্টা করলে আর যাই-ই হোক, বাংলাদেশের যুব সমাজকে অপাংক্তেয় ও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশই ছিল এই যুব সমাজ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকালের পুরো অধ্যায়ই যুব বয়সের। ১৯৪৮ সাল মাত্র ২৮ বছরে তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতারক নেতৃত্বের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। দাবি তুলেছিলেন একটি নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। কারণ, পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে ‘গণআজাদি হয়নি’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসে এমন একটি উদাহরণও আর নেই, যে দেশকে স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। আর সে মানুষটিই তাঁর চিন্তায় ও দর্শনে অবিচল থেকে মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকের পরিচয় আমাদের দিয়ে গেছেন। ফলে বাংলাদেশের পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের পুরো ঐতিহ্যই যুব সমাজ ধারণ করে আছে, এখানে তাঁর কর্তব্যের কোনও ব্যত্যয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আলাদা করে মূল্যায়ন করে যে কেউ এই সত্য অনুধাবন করবেন যে পিতা বা স্বামী তাঁর কর্ম ও সক্রিয় সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের জন্যে পেয়েছিলেন ২৭ থেকে ৫৫ বছর বয়স, মানে মাত্র ২৮ বছর। এই ২৮ বছরের ১১ বছর গেছে জেলে, আর বাকি জীবন রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে শুধু একটি লক্ষ্য সামনে রেখে, আর তা হলো স্বাধীন সোনার বাংলা গড়ে তুলে ‘বাংলার দুখী মানুষের মনে হাসি ফোটানো ’। কিন্তু পিতা বা স্বামী হিসেবে কর্তব্যের কি কোনও ত্রুটি রেখেছেন? তাঁর প্রতিটি ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন পিতার আদর্শ শিক্ষায় দীক্ষিত। এখানে স্বামী হিসেবে বয়সে ছোট একজন প্রত্যয়ী ও সংগ্রামী স্ত্রীকে সেই মর্যাদা ও সম্মানের আদর্শ অনুপ্রেরণা না দিলে বেগম ফজিলাতুন্নেসা একা পারতেন সেই উত্তাল দুঃসময়ে পরিবারের হাল ধরে রাখতে? এই যে এক আদর্শ পরিপূরক দম্পতির উদাহরণ বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব রেখে গেছেন, আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের যুব সমাজের জন্যে তা অনুকরণীয় হওয়া উচিত।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশের দুঃসময়ে জীবন বাজি রেখে রাজনৈতিক দলের হাল ধরেন তখন তাঁর বয়স ৩৪, কোলে দুই সন্তান। একজন আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে তিনি তখন দায়িত্বশীল ও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। প্রবাসের নির্বাসিত জীবনে বেঁচে যাওয়া উনিশ বছর বয়সী ছোট বোনকে বুকে আগলে রেখে একজন মানুষের সব পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছেন, দুই বোন মিলে সংগঠিত করেছেন প্রবাসী জনমত, তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংসতা, জাগানোর চেষ্টা করেছেন বিশ্ববিবেক। যে বিচারহীনতার অভাবনীয় আইন করা হয়েছিল তার প্রতিবাদে ও নিরসনে দুনিয়ার সব দেশে নিজে ও নানা মাধ্যমে তুলে ধরেছেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই অমানবিক অন্যায়ের চিত্র। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তাঁর এই যুব বয়সের অনুসরণীয় ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে জানার ও বিশ্ববিবেক সংহত হওয়ার একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত, যা আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলের হাল ধরে শেখ হাসিনা যে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ান তা একজন যুব বয়সের মানুষের জীবনের উদাহরণ হিসেবে অতুলনীয়। গত ৩৮ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের জীবনে ১৫ বছর কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে, বাকি জীবন গেছে আন্দোলন সংগ্রামে পথে প্রান্তরে, আর পদে পদে আজও  আছে মৃত্যুর হাতছানি, উনিশবার সেসবের মুখোমুখি হয়েও সৃষ্টির এক অপার মহিমায় তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্যে বেঁচে আছেন। যদি তাঁর পরিবারের দিকে দেখেন দেখবেন দুই সুযোগ্য উচ্চশিক্ষিত সন্তান, নিজেদের যোগ্যতায় দেশের জন্যে ও স্বমহিমায় আন্তর্জাতিক পরিসরে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এত বিপদসংকুল জীবনে এই শিক্ষা ও পারিবারিক অধ্যবসায় বজায় থাকলো কেমন করে? এখানে আমাদের যুব সমাজের শিক্ষণীয় কি?

যখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, জীবনাচার ও অবিচল সংগ্রামী মনোভাব আমাদের শ্রদ্ধার আসনে দেদীপ্যমান এবং সেই আদর্শ বিনির্মাণ ও বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার ত্যাগী জীবন অনুসরণীয় ভাবনার বিষয়, তখন বাংলাদেশের যুব সমাজের আদর্শ প্রেরণা হলো যুগ-যুগান্তরে সে আদর্শের পতাকা বহন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় থেকে আজ  পর্যন্ত শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের যে প্রান্তে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে যুব সমাজের দায়িত্ব অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত উন্নয়ন ভাবনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এই দেশকে নিয়ে যেতে যে পথ পাড়ি দিতে হবে তা কোনও আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।

১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে পাকিস্তানি ধারায় টেনে নিতে আমাদেরই একটি কুচক্রী মহল বিশেষ তৎপর ছিল এবং এখনও আছে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটি নবমাত্রা যুক্ত করেছে এবং প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের যুব সমাজ ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে যে সাংস্কৃতিক চেতনা বহন করে তা হারিয়ে যায়নি, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র যুদ্ধেও এই চেতনা অবিকৃত ছিল। গ্রাম-প্রান্তর-শহরের সাধারণ লুঙ্গি পরা যে যুব সমাজ সেদিন শুধু একটি প্রত্যয়ে গৃহ ছেড়েছিল তা ছিল আমাদের দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের পুরো যুবশক্তি সেদিন একটি বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়েছিল বলেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে গ্রামীণ গেরিলা কৌশলে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছিল।

এমন যে গৌরব আমাদের যুবশক্তি ও চেতনার তাঁকে আমরা ধংস করতে পারি না। রুশ বিপ্লবের অগ্রনায়ক লেনিন ১৯২০ সালে ‘যুব লীগসমূহের কর্তব্য’ পুস্তিকায় লিখেছিলেন, ‘পুরনো পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের ওপর সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বোঝাটি চাপিয়ে দিয়েছে তা হলো বইয়ের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ সাধন’। আজ আমরা যখন লক্ষ করি দেশের স্কুলে ও উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়ন ও অনুধাবনে আমাদের গৌরবগুলো ধারণ করা হয় না তখনই আমরা অন্য এক সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্নকে নিজের সমাজ-স্বপ্ন মনে করতে শুরু করেছি। আমাদের পরিবারগুলো এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, যেখানে সন্তানের কাছে কোন ঐতিহাসিক গৌরব তুলে ধরা হয় না। ’৭৫ পরের আমলে সংস্কৃতির মূলধারাকে বিকৃত করে আমরা এমন এক সংস্কৃতি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি, যা আমাদের কোনও গৌরব ধারণ করে না, এমনকি ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ আমরা ভালো ফলাফল অর্জনের মধ্যে বেঁধে দিয়েছি। ফলে মনের যে শিক্ষা, যা তাদের একটি গৌরবের জাতির অংশীদার করবে, তা থেকে সে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ‘৭৫ থেকে ‘৮০ সালের মধ্যে যাদের জন্ম তাঁদের বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণ এক পেছনে টানা ঘানির দেশে। আজ  তাঁদের বয়স ৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে। এদের একটি বড় অংশ বেড়ে উঠেছে কালো রাজনীতির শাসনামলে; যেখানে অনিশ্চয়তা, ইতিহাসের মিথ্যা সংজ্ঞায়ন আর স্বৈরশাসন শিখিয়েছে কেমন করে সত্যকে মিথ্যার প্রলেপে ঢেকে দিতে হয়। আর সেই মিথ্যা স্বপ্নের জগতে অর্থবিত্তমাখা জীবনাচরণ অর্জন ছাড়া গৌরবের আর কিছু নেই। ৯০-এর আন্দোলন এদেশের ছাত্র-যুবার অংশগ্রহণে একটি অভূতপূর্ব অংশীদারিত্ব সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করলেও পরের সরকার কোন গৌরবগাথা সামনে এনে দিতে পারেনি। তথাকথিত উন্নয়ন পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমাদের যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করে গৌরবের স্বপ্ন জগত ছেড়ে একটি ভোগের সমাজের স্বপ্ন দেখানো শুরু হলো।

আমাদের হাতে এখনও দুই বছরের বেশি সময় আছে; দেশটাকে গৌরবের দেশে নিয়ে যেতে আর সামান্য কিছু অর্জন বাকি। স্বাধীনতার সুবর্ণ তিথিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই দেশই হতে যাচ্ছে, আমাদের যুব সমাজের ভূমিকাই যেখানে সবচেয়ে বেশি। যদি তাঁদের পেশাগত শ্রেণিবিন্যাসও আমরা তৈরি করি, দেখা যাচ্ছে উৎপাদনশীল খাতে এই সমাজই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। আমরা কিছুতেই তা অস্বীকার করে তাঁদের অগৌরবের জীবন উপহার দিতে পারি না। 

 

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প 

e-mail: [email protected] 

 

 

 

/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ