X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এমনই দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বড় প্রয়োজন

সালেক উদ্দিন
২৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:০৯আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:১২

সালেক উদ্দিন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হলো ২৪ অক্টোবর। নুসরাতকে ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা নিজকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে অধ্যক্ষকে পুলিশ গ্রেফতার করে। শত চেষ্টার পরেও মামলা তুলে না নেওয়ায় অধ্যক্ষের নির্দেশে ৬ এপ্রিল নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হয় এবং আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপকৌশল নেওয়া হয়। সবশেষে ১০ এপ্রিল হাসপাতলে মারা যান নুসরাত।
মর্মান্তিক এই ঘটনায় দেশবাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। সেই সূত্র ধরেই হবে হয়তো, এই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এপ্রিলে মামলা এবং অক্টোবরে রায় ঘোষণা। মাত্র ৬১ কর্মদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তাই করা যায় না। মামলার রায়ে প্রধান আসামি ধর্ষক ও হত্যার নির্দেশদাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মর্মস্পর্শী ও বহুল আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের এমন রায়ই দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল। এখন প্রয়োজন সেই রায় কার্যকর করা। 

বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সমাজে এমন হাজারো অপরাধের ঘটনা সচরাচর ঘটে। শুধু ঘটেই না, রীতিমতো ঘটেই চলছে। থামছে না। কেন? কারণ একটাই—তা হলো ঘটনা ঘটিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার একটি অতি পরিচিত প্ল্যাটফর্ম আমাদের এই দেশ। নুসরাতের ঘটনার মতো যদি ভাইরাল না হয়, তবে টাকার জোরে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে ঠিকই পার পাওয়া যায়। একটি দুটি নয়, এরকম বহু নজির রয়েছে।

নুসরাতকে যখন হাত-পা বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো, তখন আমি একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম—‘তনু, মিতুর হত্যার বিচার না হলে নুসরাতরা মরবেই।’ তারও আগে শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকেই তাদের কলামে উল্লেখ করেছিলেন, তনু, মিতু, সাগর-রুনি হত্যাগুলোর রহস্য উদঘাটিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং প্রকৃত অপরাধীর বিচার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই নগণ্য। যার কারণেই সমাজে এ ধরনের অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রভাবশালী অপরাধীদের এ ধরনের অপরাধ থেকে পাতি অপরাধীরা এমন ঘটনা ঘটিয়েও পার পেয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। 

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনিকে নিজ বাসভবনে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিমর্মভাবে হত্যার ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে হইচই হয়েছে অনেক, কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। কেন এমন হলো, কেউ বলতে পারে না!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতু হত্যার ৩ মাস আগে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। আর এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে খুন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে। পরবর্তী সময়ে মিতুর স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা এসপি বাবুল আক্তারকে জেলে নেওয়া অথবা চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার শর্ত আরোপ করলে, তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাঁচার পথ খোঁজেন। তাতে তার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এখন এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নেই। যতই শুনি ‘অপরাধী যেই হোক, ছাড় দেওয়া হবে না, শাস্তি তাকে পেতেই হবে’—এসব ক্ষেত্রে কেন যেন তা হচ্ছে না। 

এছাড়া দেশের প্রচলিত আইন ব্যবস্থায় বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া বিচারহীনতার একটি কারণ। এর হাত থেকে বেরিয়ে আসা নুসরাত হত্যাকাণ্ড বিচারের একটি রায় বা রায়ের কার্যকরিতাই যথেষ্ট নয়। অপরাধ করলেও পার পাওয়া যায়, এমন চিন্তার কারণেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, সমাজের যেখানে যেদিকে তাকাই, সেখানেই দেখা যায় অপরাধীদের নির্বিঘ্নে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। যেমন—এমন একটি দিন পাওয়া বড় দায়, যেদিন দৈনিক পত্রিকায় ধর্ষণের খবর নেই, হত্যা-নির্যাতনের খবর নেই, অন্যায় অবিচার ও বর্বরতার খবর নেই। যে যেখানে আছে, সেখানে থেকেই নির্বিঘ্নে অনৈতিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেসব খবর ও ছবি নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকা।

এই অপরাধপ্রবণতা কেন এত বেশি? এর একটি কারণ হতে পারে আমাদের দেশে অপরাধের পরিমাণ এত বেশি এবং আদালতের সংখ্যা এত কম যে, একটি মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে তরুণ বিচারপ্রার্থীকে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হয়ে যেতে হয়। এতে বিচারের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং সেই সুযোগে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা সগৌরবে বেরিয়ে আসে। আর তাই দেখে সমাজ হয়ে ওঠে নব্য অপরাধীদের অভয়ারণ্য। এই কালচার বন্ধ করতে হবে। এর জন্য যা যা প্রয়োজন, সরকারকে তাই করতে হবে। বিচারিক আদালত বহু বহুগুণ বাড়াতে হবে, বিচারের সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে এবং রায়কে দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই হয়তো একদিন আমাদের সমাজ যে অপরাধপ্রবণতার ক্যানসারে ভুগছে, তা রোধ হতে পারে। অন্যথায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মতো একটি দুটি অপরাধকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করে সমাজের অপরাধপ্রবাহ রোধ করা সম্ভব হবে না। 

‘অপরাধী যেই হোক, শাস্তি পেতেই হবে’—এটি শুধু কথায় নয়, যেদিন বাস্তবে পরিলক্ষিত হবে, যেদিন মানুষ অনুধাবন করতে পারবে, অপরাধ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে, দ্রুত বিচারে অপরাধের ফয়সালা হবে এবং এর হাত থেকে রক্ষা নেই, সেদিন থেকেই সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমতে থাকবে। নুসরাতরা শ্লীলতাহানির হাত থেকে, বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষা পাবে। 

সমাজে অপরাধপ্রবণতা হাল টেনে ধরার প্রধানতম উপায় হলো দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি এবং শাস্তি কার্যকর করা। সাধারণ মানুষ নুসরাত হত্যার মামলার রায়ের মতো দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি চায়। চায় এমন একটি উদাহরণ, যেন আর কোনও দিন আর একজন নুসরাতকেও এমনভাবে মরতে না হয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এমএনএইচ/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ