X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘নার্সিসিস্ট’দের সেলফি সমাচার

রুমিন ফারহানা
২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:০৬আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:০৮

রুমিন ফারহানা ছবি তোলার একটা সময়ের কথা বলছি, অতি ব্যবহারে বিষয়টি তার সৌন্দর্য হারায়নি যখন। সেই সময় মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতো। যেদিন ছবি তোলা হবে, সেদিন পরিবারের সবার সে কী উত্তেজনা! বাচ্চাদের সাজিয়ে, তুলে রাখা জামা পরিয়ে কর্তা, গিন্নি মিলে যেতেন ছবি তুলতে। বেড়াতে যাওয়ার মতোই ছবি তুলতে যাওয়াও ছিল একটা শখের, আনন্দের, পারিবারিক বিষয়। বছরে খুব বেশিদিন যে এই আনন্দ আসত, তা না। সবার ঘরে তো আর ক্যামেরা ছিল না তখন, তাই বরপক্ষকে কনের ভালো একটা ছবি দেওয়ার একটাই পথ ছিল, আর তা হলো ভালো কোনও স্টুডিওতে গিয়ে সুন্দর একখানা ছবি তোলা। সাদা-কালো ছবি? তাই সই।  
এরপর ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তের নাগালে এলো ক্যামেরা। তাও বেশুমার ছবি তোলার নয়। ২৪ বা ৩৬ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো ছবির সংখ্যা। তাছাড়া ছবি মানে তো আর তাৎক্ষণিক ছবি না; স্টুডিওতে নিয়ে ওয়াশ করানোর বিষয় আছে। সুতরাং অমূল্য সেই ছবি ক’খানা হাতে পেতে সময় যেতো আরও কিছু দিন। ছবি তোলার জন্য প্রস্তুতি ছিল, হাতে পাওয়ার জন্য ছিল অপেক্ষা। মানুষ তার সুন্দর সময়, আনন্দের সময়টুকুই কেবল ফ্রেমে বন্দি করতে চাইত। তাই আজকের মতো কুরুচিপূর্ণ ছবি ভাইরাল হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না।  

আমার মনে আছে আব্বুর মৃত্যুর পর পরিচিত এক কবি ওরফে সাংবাদিক ওরফে রাজনীতিবিদ (!) খুব খাতির করে বললেন আব্বুর ওপর বই লিখবেন, কিছু পারিবারিক ছবি দরকার। ছবি এমনিতেই ছিল কম। তার মধ্যে বেছে বেছে ১৯টা ছবি তার হাতে দিলাম। আমাদের ৩ জনের ছোট্ট পরিবারের অল্প কিছু ছবির মধ্যে বেছে তোলা ১৯টি ছবি। এরপর বাঙালির যা চরিত্র। মাসের পর মাস যায়, ছবি তো আর হাতে আসে না। তাকে বারবার ফোন দেই। দিচ্ছি, দেব বলে সময় পার, কিন্তু ছবির খবর নেই। শেষমেশ তার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি, সহকর্মীদের দিয়ে তাকে অনুরোধ করা, চাপ দিয়ে প্রায় ২ বছর পর ছবিগুলো আমার হাতে আসে। তাও সব ছবি না, ১৫টা। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, ধাক্কা খেয়েছিলাম এই ঘটনায়। মনে হয়েছিল হাতেগোনা অল্প কয়টা ছবির মধ্যে ১৯টিই যদি হারিয়ে ফেলি, তবে আর থাকল কী? বাবাকে তো আর পাবো না। বুকের পাঁজর ভাঙার কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। আজকের এই হাতে হাতে মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে ঘোরার যুগে সে কষ্ট বোঝানো যাবে না কিছুতেই। একেকটা ছবি ঘিরে কত স্মৃতি, কত গল্প, কত ঘটনা। একটা ছবি একটা সময়ের গল্প। ছবি ছুঁয়ে যেন হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ছোঁয়া।  

আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তখনকার সেই অনুভূতি বোঝা খুব সহজ নয়। এখন এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা। উঠতে ছবি, বসতে ছবি, চেনা মানুষের সঙ্গে ছবি, অচেনা মানুষের সঙ্গেও ছবি। বেডরুমের ছবি, বাথরুমের ছবি, রিকশায় ছবি, গাড়িতে ছবি, রেস্তোরাঁয় তো কথাই নেই। আজকাল কথা হয় কম, ছবি অনেক বেশি। ফেসবুক আছে, আছে ইনস্টাগ্রাম, আছে ছবি এডিট করে চেহারা যেমন চাই তেমন বানানোর সুযোগ। সুতরাং এই সুযোগ হাতছাড়া করে কোন ‘বেকুব’! হাতে হাতে মোবাইল, হাতে হাতে ক্যামেরা। অতএব তোলো ছবি। দুনিয়াকে দেখাতে হবে না কতো সফল, কতো আনন্দের আর প্রাচুর্যে ভরা জীবন আমার। ছবির চেহারা দেখলে বাস্তবে চেনার কায়দা নেই। তার ওপর আছে ঠোঁট বেঁকিয়ে, ঘাড় টেরা করে চোখ নাচানো ছবি। এখন তো আর হিসাব করে ছবি তোলার দরকার নেই। হাজারটা তোলো, পরে বেছে নিলেই হবে। 

অনেক সময় বলা হয় ‘অমুক’ নেতার সঙ্গে ‘তমুক’ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের ছবি। কোনও সমাবেশে কোনও দলের নেতা যখন আসেন, তখন ছবি তোলার যে হিড়িক পড়ে, তাতে কে সন্ত্রাসী আর কে চাঁদাবাজ, তা বের করা নেতা তো দূরের কথা, কারও পক্ষেই সম্ভব না। আর শুধু সমাবেশই বা কেন? সামাজিক অনুষ্ঠানেও চলে একই কাণ্ড। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। ‘নার্সিসিজম’ বা আত্মপ্রেম কোন পর্যায়ে গেলে ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সেলফি তুলতে গিয়ে মানুষ মারা গেছে ২৫৯ জন। এটা রেকর্ডেড সংখ্যা। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সেলফি নিয়ে অতি উচ্ছ্বাসে মানুষ যে কেবল নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে তাই না, অন্যের জীবনও দুর্বিষহ করতে পারে।  

একটা সমাজে সব মানুষই তার ভূমিকা রাখে, তাই সমাজে প্রতিটি মানুষই মূল্যবান, কিন্তু বাজার আমাদের জানায় কোনও কোনও মানুষের পরিচিতি অন্যদের চাইতে বেশি। কোনও সেক্টরের কোনও ‘পরিচিত’ মানুষকে দেখলে অন্যদের উচ্ছ্বাস হওয়া স্বাভাবিক। সেই মানুষদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সম্মান থাকে। তাই তেমন কোনও মানুষকে দেখলে এখন হাতে থাকা মোবাইলে একটা সেলফি তুলে ফেলা যায়। এই ছবি তোলার পেছনে ভালোবাসা থাকে না, সেটা বলি না, কিন্তু ইদানীং প্রায় সব ক্ষেত্রে সেটাকে ছাপিয়ে ওঠে নিজের সেলফির গুরুত্ব বাড়ানো, এতে ফেসবুকে রিঅ্যাকশন বেশি পাওয়া যায়। এটাও মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু আমাদের অনেকে এটা ভেবে দেখে না, যে মানুষের সঙ্গে এটা করছি, তার ন্যূনতম সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। আমাদের নার্সিসিজম এসব ব্যাপারে আমাদের একটুও ভাবায় না।    

ব্যক্তিগতভাবে সেলফি আমি পছন্দ করি না, এমনকি ছবি তোলাই আমার পছন্দ না। ছবি তোলা আমি উপভোগ করি না, তবে আমার সঙ্গে ছবি তুলতে আসা মানুষের ভালোবাসা, উচ্ছ্বাসকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাই অনেকের সঙ্গে সেলফি তুলতেও  আপত্তি করি না। সমস্যা হচ্ছে আমাদের অনেকেরই মনে থাকে না আমাদের অনেক সময়ের আচরণ ভব্যতা এবং সৌজন্যের চৌহদ্দির মধ্যে থাকে না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে বেশিরভাগ নারীই পরিচিত পুরুষের সঙ্গেও গা ঘেঁষা সেলফি পছন্দ করে না, সেখানে অপরিচিত পুরুষ তো অনেক পরের কথা।   

প্রায় সময়ই আমাদের মনে থাকে না, যার সঙ্গে ছবি তুলছি, তার অনুমতি নিতে হয়। বিশেষ করে যার সঙ্গে তুলছি, সে যদি সমাজে পরিচিত কেউ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। অথচ এটা একদমই ন্যূনতম একটা ভদ্রতা। নারী হওয়ার কারণেই সেলফির একটা দিক দেখতে হয় আমাকে। সেলফি তোলার সময় কিছু মানুষ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ ভুলে যান, প্রতিটি মানুষের একটা পার্সোনাল স্পেস থাকতে হয়। বিশেষ করে একজন পুরুষ যখন নারীর সঙ্গে ছবি তোলেন, তখন এটার প্রতি খেয়াল রাখাটা জরুরি। অনেক সময় অতি ভদ্রভাবে বলেছিও সেই কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনও হয়েছে হাঁটছি, পাশে হাঁটতে হাঁটতে বিনা অনুমতিতে ঘাড় বেঁকিয়ে সেলফি নিচ্ছে মানুষ।   

মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে যাদের সঙ্গে সেলফি তোলে, সাধারণত তারা বড় মাপের একজন অভিনেতা, সাংবাদিক, লেখক কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যাই তিনি হোন না কেন, দিনের শেষে তিনি কিন্তু রক্ত মাংসের মানুষই। তারও ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ, অপছন্দ, শরীর, মন সবই আর দশটা মানুষের মতোই কাজ করে।  

অতি সম্প্রতি ঘটা একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছি। লম্বা সময়ের ফ্লাইট। ক্লান্ত আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম পাশে বসা এক বাংলাদেশি লোক কোনোরকম কোনও অনুমতি ছাড়াই সেলফি কায়দায় আমার ছবি তুলে এমিরাতের ওয়াইফাই ব্যবহার করে কাকে যেন সেই ছবি পাঠাচ্ছে। অথচ এর কিছুক্ষণ আগেই এই লোকের আলাপের আগ্রহে আলাপ করেছি, সেলফি তুলতে চাইলে অনুমতি দিয়েছি। শুধু তাই না, তার অনুরোধে দেশে থাকা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলেছিলাম, কারণ তারা আমার ‘ফ্যান’। একটা ক্লান্তিকর ভ্রমণের সময় একজন মানুষের আগ্রহকে মূল্যায়ন করেছি, কিন্তু তার কাছেই এমন কুৎসিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। এক অদ্ভুত দেশে বসবাস আমাদের, যেখানে সৌজন্যকে কেউ দুর্বলতা ভাবেন, আবার কেউবা মনে করেন যাচ্ছেতাই করতে পারার প্রশ্রয়।

নিশ্চয়ই সবাই নার্সিসিস্ট নয়; প্রায় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকে না সবাই। কিন্তু নিজেকে ভালোবাসে সব মানুষ; নিজেকে ভালোবাসা আমাদের প্রবৃত্তির অংশ। তবে আমাদের মনে রাখা জরুরি, নিজের প্রতি পর্যাপ্ত ভালোবাসা থাকা আর নার্সিসিস্ট হওয়ার মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেলফি/ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে দিয়ে মানুষের নানা রকম রিঅ্যাকশন আর কমেন্ট পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের প্রবৃত্তিরই এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। বিপদের বিষয় হচ্ছে এমন কাজ নিয়মিত করতে থাকা আমাদের এই প্রবৃত্তিকে ক্রমাগত উসকে দিতেই থাকে। এর ফলাফল আমরা পাচ্ছি হাতেনাতেই, সমাজে নার্সিসিস্ট বা আত্মপ্রেমীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। সমাজের মধ্যে তো বটেই, এমনকি পরিবারের মধ্যেও মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এখন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবো শুধু আমাদেরই না, বর্তমান বিশ্বেরই অনেক সমস্যার মূল মানুষের ক্রমবর্ধমান নার্সিসিজম, আত্মপ্রেম বা আত্মকেন্দ্রিকতা। যত দ্রুত এই মোহমুক্তি ঘটে, ততই মঙ্গল। 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ