X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:৩২আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৪:৩৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়, কথা বলতে হয়। বিশেষ করে সমাবর্তন অনুষ্ঠানগুলোতে তার দেওয়া বক্তব্য বেশ বড় আলোচনা, তথা ভাবনার খোরাক সৃষ্টি করছে। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে তিনি বলেছেন, এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। তিনি বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত সান্ধ্যকোর্সের সমালোচনা করেছেন এবং সনদ বেচার প্রতিযোগিতায় বা লোভে যেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ডুবে না যায় সে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষায়, ‘বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটা লাভবান হচ্ছেন এ ব্যাপারে প্রশ্ন না থাকলেও একশ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিবেক ও গরিমার অলংকার। দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে প্রদত্ত বক্তব্যকে আমরা নৈতিক ধমক হিসেবে দেখতে পারি, যা অভূতপূর্ব এবং অস্বাভাবিক মনে হলেও দেশের অভিভাবক হিসেবে তাকে এমন নৈতিক ধমক দিতেই হয়। আমরা জানি, উচ্চশিক্ষা থেকে যে সামাজিক সুফল ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে শিক্ষকদের নৈতিকতার মূল্য অনেক। শিক্ষাই সমাজের ভূষণ, সমাজকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তায় শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বর্তমান সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভাতা যে হারে বাড়িয়েছে সেখানে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছন্দ নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তবু আচার্যকে বলতে হয়, ‘কিছু শিক্ষক আছেন যারা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও এসব কোর্সের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। কারণ, এগুলোয় নগদ প্রাপ্তি থাকে’। আমরা দেখেছি, শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে ছিবড়ে করে দেন অনেক সময়ই, যদিও নিজেদের গুণমান মূল্যায়নে তাদের ভারি অনীহা।

দেশে আইনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ সরকারের পক্ষে চাহিদার ব্যাপকতার বিপরীতে এত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব না। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি আনুকূল্যে সব শ্রেণির ছাত্র অল্প খরচে এক প্রতিষ্ঠানে একই শিক্ষা দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই রাষ্ট্রকে হাঁটতে হয়েছে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পেছনে। একটি বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ মিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জাতীয় মানবসম্পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহেলা করে অর্থের প্রলোভনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সময় বেশি দেন কিংবা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই সান্ধ্যকোর্সের নামে অর্থ আয়ের উপায় খোঁজেন তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার চরিত্রটা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে।

অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার এই সংকোচন ও লঘুকরণের বিরুদ্ধে কার্যকর পন্থা আমাদের বিদ্বৎসমাজকে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রপতির চাওয়া সেটিই। এমনিতেই ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। রাজনীতির কারণে, দলাদলির কারণে আসল পঠন-পাঠনের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে, হতে বাধ্য। কিন্তু এর পাশাপাশি বাণিজ্যিক মনোভাব এমনভাবে চলতে থাকলে একদিন সব প্রতিষ্ঠান সত্যিই তলিয়ে যাবে—সেই আশঙ্কাটাই প্রকাশ করেছেন আচার্য।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে স্থান পায় না। সেখান থেকে জাতীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোনও গবেষণা পাই না। তবু এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের উচ্চশিক্ষা স্তরে জাতীয় সম্পদ। এগুলো যারা পরিচালনা করেন তাদের ভাবতে হবে শিক্ষার মুক্তি কেবল আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে নয়, আধুনিক পঠন-পাঠন ও গবেষণায়। হ্যাঁ, গবেষণা ব্যয়সাধ্য ব্যাপার, সরকার দরাজ হয়ে উঠবে সেরকম আশা থাকতেই পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে, সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমেও আসতে পারে গবেষণার অর্থ। বয়স্ক বা চাকরিজীবী ছাত্রদের আকৃষ্ট করে তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট বেশি বেতন নিয়ে নয়। আরেকটা উপায় শিল্প-বাণিজ্যের সহায়ক হয়ে সরাসরি অর্থ উপার্জন করা। সেক্ষেত্রে যে যে বিষয় শিল্প-বাণিজ্যের পক্ষে প্রাসঙ্গিক,সেগুলোই প্রাধান্য পাবে।

তবে একথাও ঠিক উচ্চশিক্ষার উচ্চতর দিক অর্থাৎ গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্বন্ধে অনীহা শুধু শিক্ষকদের নয়, সরকারেরও নিরুৎসাহ আছে। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাবার প্রয়াস নিতে হবে সরকারকে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা শিক্ষকদের হাতেই থাকবে, কিন্তু তারা যেন গঠনমূলকভাবে তা ব্যবহার করেন। শিক্ষার মূল লক্ষ্য যে ভবিষ্যৎ গড়া, সেই ভবিষ্যতের কাছে নিশ্চয়ই কেউ অপরাধী হয়ে থাকতে চাইবে না।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ