X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নুর কেন মার খায়?

আনিস আলমগীর
২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:২৫আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৫১

আনিস আলমগীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে এক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুরে ডাকসু ভবনের নিজ কক্ষে নুরের ওপর হামলা চালিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। এ সময় নুরের সঙ্গে থাকা ঢাবি, জাবির ছাত্রসহ কয়েকটি কলেজের ছাত্র আহত হয়েছে। নুরকে এটি প্রথম পিটুনি নয়। ডাকসু ভিপি হওয়ার আগে-পরে তাকে অনেকবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগ। তাকে নানা সময়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
নুরুল হক নুরকে কারা মারে, কেন মারে আর ভিপি হয়েও নুর কেন বার বার মার খেয়েই যায়– বিষয়টি আমার কাছে বরাবরই ঘোলাটে মনে হয়। নুর কেন কোনোদিন তাকে যারা নির্বাচিত করেছে সেই ভোটার বা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার প্রতি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে পারেননি? তার দুর্বলতা কোথায়? সুযোগ পেলে রগ কাটা আর সুযোগ না পেলে মার খেয়ে সহানুভূতি আদায়ের এই কৌশলতো শিবিরের। নুর কি শিবির করে?
সত্যিকথা বলতে গেলে, শিবিরের সঙ্গে নুরের সম্পৃক্ততা এখনও আমার কাছে সন্দেহমুক্ত নয় বলে আমি তার পক্ষে কখনও কলম ধরতে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা তার মার খাওয়া, তাও আবার ভারতের মোদি সরকারের মানবতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক একটি নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে- বিষয়টি আমি হজম করতে পারছি না। আবার যারা সন্ত্রাসী হামলা করেছে তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে- ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’। সন্ত্রাস এবং দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নাম ব্যবহার করা যায় না। কারা এই মহান সৈনিকরা যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে এতো নিচে নামানোর সাহস পায়? কাদের বলে এরা নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে?

ভারতে গত ১২ ডিসেম্বর কার্যকর হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ)। এতে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ আইনে শুধু মুসলিমদের বাইরে রাখা হয়েছে। একে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিবাদ করেছে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং উত্তর প্রদেশের আলীগড় মুসলিম শ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা ভারতের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত, যদিও সব ধর্মের শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের। সারা ভারত কাঁপিয়ে তুলছে শিক্ষার্থীরা, অসাম্প্রদায়িক মানুষরা। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা ধিক্কার দিচ্ছে এই দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর ভারতীয় পুলিশের বর্বর হামলার, যা কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলার রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ।

অমিতাভ বচ্চনসহ অনেকে সরকারি অনুষ্ঠান বর্জন করছে। তারা বলছেন, এই আইন মুসলমানদের টার্গেট করে করা হয়েছে এবং এটি ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। ছাত্রদের প্রতি সংহতি জানিয়ে এই আইনের প্রতিবাদ করেছে অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুনিয়ার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে অন্যরা মানববন্ধন করেছে। এখনও করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রম থাকবে কেন! এখানে বিষয়টি মানবতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা জড়িত নয় শুধু, বাংলাদেশের স্বার্থ আর ইমেজের সঙ্গেও সরাসরি জড়িত। মোদির সরকার এই দুই আইনের টার্গেটদেরকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলছে। বলছে বাংলাদেশ থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে যাওয়া সংখ্যালঘু। আসামে ১৯ লাখ বাঙালিকে বাস্তুহারা করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ৬ লাখ মুসলিম। ভাগ্য ভালো যে নাগরিকপঞ্জির তত্ত্বাবধায়ন করেছে স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট, নয়তো মোদির প্রশাসন প্রায় সব মুসলিমকে আসামে অনাগরিক বানিয়ে দিত।

অসমীয়রা দাবি করে আসছিল ‘বাঙালি খেদাও’। এখন শেষ পর্যন্ত মোদি সরকার তাকে রুপ দিয়েছে ‘মুসলিম খেদাও’। কারণ হিন্দুদেরকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন দিয়ে আসামে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। আর মুসলিমরা যাবে বিশেষ ক্যাম্পে নয়তো লাগোয়া সীমান্ত পথে গলাধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর চিন্তা। আর সে কারণে অসমিয়ারা নাগরিকপঞ্জির বা এনআরসির পক্ষে কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ’র বিরুদ্ধে।

গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন নুরুল হক নুর এবং তার ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেয়। দু’পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়। দুইপক্ষই পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ হামলাকারী, আর নুররা আক্রান্ত।

একই ঘটনা ঘটেছে ২২ ডিসেম্বর রবিবারও। মিডিয়ার খবর হচ্ছে, রবিবার দুপুর ১২টায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। সংগঠনটি মিছিল করে ডাকসু ভবনের দিকে আসে। এ সময় ভিপি নুর ২০/২৫ জনকে নিয়ে ডাকসু ভবনে প্রবেশ করছিলেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তারপর নুর তার লোকদের নিয়ে ডাকসু ভবনে নিজের কক্ষে চলে যান। এর মধ্যেই ডাকসু ভবনের সামনে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজীত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং তাদের অনুসারীরা। দুটি সংগঠনের কর্মীরা তখন ডাকসু ভবনের দিকে ইটের টুকরা নিক্ষেপ করতে থাকেন। তাদের দাবি ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের কার্যালয়ে শিবির আছে।

এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী, একটি অনলাইন সংবাদপত্রের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক মো. সিরাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এর খানিকক্ষণ পরে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ কয়েকজন নেতাকর্মী সেই কার্যালয়ে প্রবেশ করে নুরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে বলেন। তখন নুর সনজিতকে বলেন, সাদ্দাম তো ডাকসু নেতা, কিন্তু আপনি কে? এই প্রশ্নে জবাবে সনজিত উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমি কে, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝবি।’

সিরাজুল ইসলাম জানান, ‘এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ভিপির কক্ষে ঢুকে হামলা করে। সেখানে তারা লাইট বন্ধ করে রড, বাঁশ, লাঠি দিয়ে হামলা করে। সাংবাদিকরা ভিডিও করার চেষ্টা করলে তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়।’

১৭ ডিসেম্বর পিটানোর সময় বলা হয়েছে, ‘এনআরসি ও সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। নুর একজন ছাত্র প্রতিনিধি। এটা নিয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ করার এখতিয়ার তার নেই।’ ২০ ডিসেম্বর বলা হয়েছে, নুরের সঙ্গে বহিরগতরা আছে, ওরা শিবির। প্রশ্ন আসে, এত দায়িত্ব ছাত্রলীগকে কে দিলো? কার কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে সেটাও ছাত্রলীগ নির্ধারণ করবে! ডাকসু ভবন কি শিবির দখল করে নিয়েছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিবাদী মিছিলে ‘বহিরাগত’ প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে কবে থেকে?

ভারতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্রলীগ মিছিল করলে আমরা অনেকে খুশি হতাম। কিন্তু সরকারি দলের সংগঠন বলে তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে তা না করাতেও নাখোশ না। সেই কাজটি নুররা করেছে বলেতো তারাতো ধনবাদ পাওয়ার যোগ্য। উল্টো তাকে পিটানো কেন! তার ২৮ সঙ্গীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলো কেন! ঘর বন্ধ করে পৈশাচিক হামলা চালানো এবং ডাকসু ভবনের সিসি টিভির ফুটেজ গায়েব করে দেওয়ার নেপথ্যে কী! ঢাবি প্রক্টরের কাজ কী? এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

হামলায় নুরের একজন সঙ্গী এমন আহত হয়েছে যে তাকে লাইফসাপোর্টে নিতে হয়েছে। কয়েকজন আইসিইউ-তে রয়েছে। এই ঘটনায় দৃষ্টি দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নুর এবং অন্যান্য আহতদের দেখতে গিয়েছেন আওয়ামী লীগের দু’জন কেন্দ্রীয় নেতা- জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বাহাউদ্দিন নাসিম। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যদেরতো উপস্থিতিই চোখে পড়ে না। আমরা দুঃখিত যে, একজন মাত্র নুরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ এতো বড় সংগঠন- ছাত্রলীগ। তাই তারা তাকে বার বার শারীরিকভাবে আঘাত করছে।

ঢাবি প্রশাসন এবং সরকারের বুঝা উচিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারও লাশ পড়লে ছাত্ররা কিন্তু সারা দেশে ভিন্ন মেজাজ দেখাতে পারে। সরকারের জন্য এটি শুভ হবে না। সুতরাং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ নতুন কমিটির নেতাদের অনুরোধ করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য। ঘটনাটা যেন শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলা হয়। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবার প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। মোদির সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেতো বটেই। বাংলার ছাত্রসমাজ, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দাবিয়ে রাখা যায় না। ভিন্ন মত দেওয়ার, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার, কথা বলার স্বাধীনতা না থাকলে হীতে বিপরীত হবে।

সবার স্মরণে থাকা উচিত মাহমুদুর রহমান মান্নারা বহুদিন থেকে ক্যাম্পাসে একটি লাশের তালাশে আছেন। কারও ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা উচিত হবে না। জাতি যখন তার শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছেড়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় তখন পরাক্রমশালী বীরেরও পতন হয়। বিরোধী শক্তি একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেলে তারাও প্রবল শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ