X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির বিয়েতে বাংলা কোথায়?

রেজানুর রহমান
০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৮:৪৪আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৮:৪৬

রেজানুর রহমান সোবহান সাহেব একটু যেন দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলেন। এ কোথায় এসেছেন তিনি? বিভিন্ন বয়সী কয়েকশ’ মানুষের জমায়েত হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোরেরাও রয়েছে। সবার মুখের ভাষা বাংলা। অথচ অনুষ্ঠান হচ্ছে বিদেশি ভাষায়। বিয়ের অনুষ্ঠান। আজ গায়েহলুদ। বর-কনেকে মঞ্চে আনা হলো। তারা এখন মঞ্চে  সবার সামনে নাচবে, গাইবে। সোবহান সাহেব লক্ষ করলেন বর ছেলেটির চেয়ে কনে মেয়েটিই একটু যেন অতিমাত্রায় হাসছে, কথা বলছে, হাই হ্যালো করছে। বর ছেলেটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলছে না। কারও দিকে তাকাচ্ছেও না। হঠাৎ শব্দযন্ত্রে বিকট শব্দ হলো। এবার অনুষ্ঠান শুরু হবে। মঞ্চের বাম পাশে একটা পিলারকে আড়াল করে দুটি ছেলেমেয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেয়েটিই অনুষ্ঠান শুরু করলো, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, আমার বাংলা বলাটা ভালো না। কাজেই আমি বাংলা, ইংরেজি মিশেল করে কথা বলবো। নাউ উই আর গোয়িং টু স্টার্ট আওয়ার শো...
এবার কথা বলতে শুরু করলো উপস্থাপক ছেলেটি। সোবহান সাহেব ভেবেছিলেন,ছেলেটি হয়তো বাংলায় কথা বলবে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে। দেখতে অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। তার মুখে বিদেশি ভাষা মানাবে না। কিন্তু ছেলেটির মুখে বিদেশি ভাষাই উচ্চারিত হলো। ইংরেজিতে কথা বলছে সে। তার কথা শেষ হতে না হতেই শব্দযন্ত্রে হিন্দি ছবির একটা গান ভেসে এলো। গানের তালে তালে মঞ্চে নাচতে শুরু করলো একদল তরুণ-তরুণী। তারা নাচছে ভালোই। কিন্তু হিন্দি গানের সুরে তারা নাচবে কেন? বাংলা গান গেলো কোথায়? এসব ভাবতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন সোবহান সাহেব।

ঢাকায় ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন সোবহান সাহেব। বউমা বললো, বাবা রাতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। যাবেন নাকি?

সাত-পাঁচ না ভেবেই অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়ে যান সোবহান সাহেব। ছেলে আসেনি। কী একটা জরুরি কাজ আছে তার। বউমাই সোবহান সাহেবকে গাড়িতে করে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসে। গাড়িতে আসতে আসতে কত কথাই না ভেবেছেন সোবহান সাহেব। এর আগে ঢাকা শহরের কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেননি। তাই আগ্রহ ও উত্তেজনা একটু বেশিই ছিল। নিশ্চয়ই এই বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন কিছু দেখবেন। ঢাকা শহরের বিয়ে বলে কথা। তাও আবার অনেক বড় লোকের ছেলের বিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে আকাশছোঁয়া একটা বড় বিল্ডিংয়ের লিফটে চড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসতে হলো। লিফটে ওঠার সময় বোঝা যায়নি। কিন্তু লিফট থেকে বেরিয়ে বোঝা গেলো জায়গাটা কত বড়। ফুটবল খেলার মাঠের মতো জায়গা নিয়ে ১৪ তলায় বিয়ের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে। নতুন ঝলমলে পোশাক পরে এসেছেন অতিথিরা। কয়েকজন বিদেশি মহিলা ও পুরুষকেও দেখা গেলো। ছোট ছোট বাচ্চা প্রাণ খুলে দৌড়াদৌড়ি করছে। ডানদিকে একটা বড় জায়গা জুড়ে খাবারের স্টল সাজানো হয়েছে। জিলেপি, ভাপা পিঠার সঙ্গে আরও কিছু খাবারের আয়োজনও। যে যত খুশি খাও, আপত্তি নাই। পরিবেশটা বেশ পছন্দ হলো সোবহান সাহেবের। মনে মনে বউমাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। কারণ তার কারণেই না এতো সুন্দর একটা অনুষ্ঠানে আসতে পেরেছেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা শুনে সকল আনন্দই যেন মাটি হয়ে গেলো। সোবহান সাহেব ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের বিয়ে। কাজেই বাংলায় কথাবার্তা হবে, বাংলা গান বাজবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হলো ইংরেজি ভাষায়। নাচে বাজতে থাকলো হিন্দি গান।

সোবহান সাহেব অস্থির ভঙ্গিতে বউমাকে খুঁজতে থাকলেন। ভিড়ের মাঝে পেয়েও গেলেন। শ্বশুরকে দেখে বউমা এগিয়ে এলো। বাবা, কোনও সমস্যা?

হ্যাঁ একটা সমস্যা হচ্ছে? শ্বশুরের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো বউমা—কী সমস্যা বাবা? সোবহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি এখান থেকে যেতে দেরি হবে? বউমা অবাক হয়ে উত্তর দিলো, কেন? এখনও তো মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া...সোবহান সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ওই যে মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছে...ওরা কি এভাবেই সারাক্ষণ ইংরেজি আর হিন্দি ভাষা নিয়ে মেতে থাকবে? বাঙালির অনুষ্ঠানে বাংলা কোথায়?

বউমা সোবহান সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো, বাবা, এটাই এখনকার কালচার। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন সোবহান সাহেব। বাঙালির বিয়েতে বিজাতীয় এই কালচার আমি মানি না। বাঙালির বিয়ে, আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে হবে কেন? বাংলায় আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে দোষ কোথায়? বাঙালির বিয়েতে বাংলা গান বাজবে না, এটা কী করে হয়? তুমি বাজাও বিদেশি গান। কিন্তু দেশের গানকে তো প্রথম গুরুত্ব দেওয়া উচিত, নাকি? বউমা, চলো এই অনুষ্ঠানে আমি আর একদণ্ড থাকব না! আমি অনুষ্ঠান বয়কট করব...

তবে বউমার পীড়াপীড়িতে সেদিন ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত ছিলেন সোবহান সাহেব। অনুষ্ঠানের শেষ দিকটা ছিল আরও জঘন্য। ইংরেজি গানের তালে নেচেছে একজন নৃত্যশিল্পী। সে বোধকরি পণ করেই এসেছিল নাচের সময় শরীরে কাপড় রাখবেই না।

বাসায় ফিরে একটি খোলা চিঠি লিখলেন সোবহান সাহেব। ‘বিয়ে’ ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এই শব্দের শক্তি অনেক। বিয়ে দুই নর-নারীর একসঙ্গে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি। বিয়ের পর সৃষ্টি হয় পরিবার। পরিবার থেকেই তৈরি হয় সমাজ। আবার সমাজই তৈরি করে রাষ্ট্র। কাজেই বিয়ে প্রতিটি মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানের ওপরও একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ঐতিহ্য নির্ভর করে। কিন্তু আমরা এব্যাপারে কতটা সচেতন? আর মাত্র কয়েকদিন পরই শুরু হবে আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমরা তখন অতিমাত্রায় সরব হয়ে উঠব। কিন্তু সারা বছর আমরা কেন একথা মনে রাখি না? বিয়ের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লিখলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের? খুব কি লজ্জায় পড়ব আমরা? বিয়েতে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তাতে বাংলা গানের প্রাধান্য থাকলে কারও কি কোনও ক্ষতি হবে?

প্রিয় দেশবাসী, বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেও আমরা একটা সাংস্কৃতিক জাগরণের ডাক দিতে পারি। আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ বিয়ের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও আমরা এব্যাপারে সচেতন ভূমিকা রাখতে পারি। সেটা কেমন? অপেক্ষা করুন বলছি। প্রতিটি বিয়েতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। আমরা অনুষ্ঠানগুলোকে বিষয়ভিত্তিক করে সাজাতে পারি। যেমন—কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্রের গানকেই গুরুত্ব দিতে পারেন। আমাদের কালজয়ী সব চলচ্চিত্রের গানের ওপর অনুষ্ঠান সাজানো যেতে পারে। অথবা হতে পারে টিভি নাটকের গান নিয়েও বিশেষ পর্ব। বিশেষ কোনও শিল্পীর গান নিয়েও অনুষ্ঠান সাজানো যেতে পারে। দেশের গান নিয়েও বিশেষ পর্ব হতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা! আমি দেশকে মাথায় রেখে অনুষ্ঠান সাজাতে চাই কিনা এটাই হলো কোটি টাকার প্রশ্ন!

প্রিয় পাঠক, সোবহান সাহেবের খোলা চিঠি পড়লেন তো...সোবহান সাহেবের পরামর্শগুলো ভেবে দেখবেন কী? সত্যি কথা, বিয়ের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব। চলতি বছর যারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন অথবা বসতে যাচ্ছেন তাদের সবার প্রতি রইলো শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। দেশকে ভালোবেসে ভালো থাকুন সকলে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ