X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

শরীর ‘তীর্থ’ নয়

হারুন উর রশীদ
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৩৪আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:৪৫

হারুন উর রশীদ ধর্ষণের একটি সামাজিক ফর্মুলা আছে। এই ফর্মুলা ধর্ষণের শিকার নারীকে যেমন সারাজীবনের জন্য পর্যুদস্ত করে দেয়, তেমনি ধর্ষককে উৎসাহিত করে, সুবিধা দেয়। সেই ফর্মুলা হলো–‘ধর্ষণ মানে সব শেষ’। এই ঘটনার পর ধর্ষণের শিকার নারীর সব কিছু শেষ হয়ে যায়।
আর এই চিন্তার পেছনে আছে ‘পবিত্রতার’ ধারণা—নারীর শরীরকে তীর্থ মনে করা। মনে করা হয়, পবিত্র এই তীর্থ ধর্ষণের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে গেলো তো জীবনই শেষ হয়ে হয়ে গেলো। আর কিছুই রইলো না। তাই ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। কোনও কোনও নারী মনে করেন, ‘এ জীবন রেখে আর কী লাভ!’
যদি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীধর্ষণের ঘটনাটি একটু গভীরভাবে দেখি, তাহলে আরও অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে। আমরা সাধারণ বিবেচনায় ভেবেছিলাম ধর্ষক হবে শারীরিকভাবে শক্তিশালী কেউ। কেউ কেউ ভেবেছিলেন ‘বডি-বিল্ডার’ না হলেও নিদেনপক্ষে পেশীবহুল শরীর থাকবে তার। নয়তো সে একাই একজন নারীকে কীভাবে দুর্বল করবে? তাই অনেকেই হয়তো ধর্ষকের চেহারা দেখে হতাশ হয়েছেন। কিন্তু তাদের এই হতাশার কারণ সামাজিক বাস্তবতা মাথায় না রাখা।

ব্যতিক্রম ছাড়া একজন নারী যখন বুঝতে পারেন তিনি ধর্ষণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছেন, তখন তিনি দুর্বল হয়ে যান। তখন তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ‘জিরো’ লেভেলে নেমে যায়। এরপর প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও তা অনেক সময়ই সফল হয় না। আর এই প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার কারণ ওই চিন্তা, ‘আমার সব শেষ হয়ে যাবে।’

একটি সাধারণ উদাহরণ দেই। একেকজন ছিনতাইকারী সামান্য একটি চাকু দেখিয়ে  ছিনতাইয়ে ‘সফল’ হয়। তাকে প্রতিরোধ করলে  সে সফল তো দূরের কথা  উল্টো ধরা পড়বে। যারা প্রতিরোধ করতে পারেন বা করেন তারা ছিনতাইকারীতে ধরে ফেলেছেন এরকম উদাহরণ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা হয় না। কারণ, আমাদের আগে থেকেই মনোজগতে ভয় কাজ করে। তাই ছিনতাইকারী দেখলেই সাধারণভাবে আমরা ভয় পেয়ে যাই। দুর্বল হয়ে পড়ি। ‘সফল’ হয় ছিনতাইকারী। এখানে কার গায়ে কত শক্তি, সেই বিবেচনা খুব কমই কাজ করে।

বাংলাদেশে যত ধর্ষণের মামলা হয় তার মাত্র শতকরা তিন ভাগ ঘটনায় অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় এই শাস্তির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৩ ভাগ। এই পরিসংখ্যান শুধু বিচারহীনতার কথা বলে না। একইসঙ্গে ওই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণ মামলার যে আসামিরা ছাড়া পায়, তারা সমাজে একটি ‘ধর্ষণবান্ধব’ পরিবেশ তৈরি করে। ধর্ষণের শিকার নারী ও ধর্ষক একই এলাকায় বসবাস করে। ধর্ষক ওই নারীর সামনে বুক চিতিয়ে চলাফেরা করে সারাক্ষণ তার সামনে একটি ধর্ষণের পরিবেশ জারি রাখে। আর ওই নারীকে বলা হয় মিথ্যাবাদী। সমাজে তাকে বলে, ‘হ্যাবিচুয়েটেড’। ফলে তাকে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। অথবা আত্মহত্যা করে ‘সম্মান’ বাঁচাতে হয়।

তাহলে কি আইন কঠোর নয়? আইন আরও কঠোর করলে তা কি শাস্তির হার বাড়ানোর নিশ্চয়তা দেবে? সেই প্রশ্ন সামনে নিয়েই এগোতে চাই।

কেন শান্তি হয় না তার উত্তর মোটামুটি একই ধরনের:

১. আইনের দুর্বলতা

২. সাক্ষ্য আইনের ত্রুটি

৩.আলামত সংগ্রহে জটিলতা

৪. বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটি

৫. তদন্তে অদক্ষতা এবং অনিয়ম

৬. সামাজিক প্রতিকূলতা

এই কারণগুলো নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। ধর্ষণের শিকার নারীর সুরক্ষা এবং সামাজিক সম্মান বিবেচনায় এখন সংবাদ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে তার নাম পরিচয় এবং ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা হয় না। এই পরিচয় কোনোভাবে প্রকাশ না করা আজকের সামাজিক বাস্তবতায় সঠিক। কিন্তু আজ যা সঠিক মনে হচ্ছে, তা যে এক সময় ধর্ষণের বিচার না হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হবে না, তা কে বলতে পারে!

যদি ধর্ষণের শিকার নারী প্রকাশ্যে আসতে চান, যদি তার পরিবার তাদের পরিচয় প্রকাশ করেই বিচার চান, যদি তারা এটাতে কোনও  কথিত ‘কলঙ্ক’ হিসেবে বিবেচনা না করেন, যদি তারা মনে করেন এটা ধর্ষণের শিকার নারীর লজ্জা নয়, এটা ধর্ষকের লজ্জা, তাহলে তাদের এই সাহসী সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার কোনও কারণ নেই। বরং উৎসাহিত করা উচিত। তবে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার আছে।

আমাদের কেউ যদি হত্যা করতে আঘাত করে, তাহলে আমরা কি তা গোপন করি? আমাদের নাম পরিচয় গোপন করি? আমরা যদি কোনও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হই, তাহলে তা কি গোপন করি? আমাদের পরিচয় গোপন করে বিচার চাই? না, চাই না। কারণ ওই আঘাতগুলোকে আমরা আমাদের ‘কলঙ্ক’ মনে করি না। আমরা অপরাধীদের বিচার চাই প্রকাশ্যে। শুধু ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনায় আমরা কুঁকড়ে যাই। কারণ ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষণের শিকার নারীর লজ্জা হিসেবেই এটাকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। আমরা মনে করি, ধর্ষণের শিকার নারী ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। তাই আমরা তাকে ‘রক্ষা’ করতে চাই, তাকে গোপন করে। আসলে এই প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে ‘ধর্ষণবান্ধব’ পরিবেশ তৈরি করে।

এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। আর এটা থেকে প্রথম বেরিয়ে আসতে হবে আক্রান্ত নারীকেই। এটা তিনি একা পারবেন না। তার পরিবারকে তার পক্ষে থাকতে হবে। সমাজকে আরও অগ্রসর হতে হবে। মননে এটা ধারণ করতে হবে যে ধর্ষণ ধর্ষকের অপরাধ তার কলঙ্ক। আর ধর্ষণের শিকার নারী দুর্বৃত্তের আঘাতের শিকার, হামলার শিকার। আর এই হামলার কারণে তার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে না। কারণ এটা তার কোনও অপরাধ নয়।

তাহলে দেখা যাবে, ধর্ষক প্রতিরোধের মুখে পড়বে। নারী শুরুতেই ‘কলঙ্কের’ চিন্তায় দুর্বল হয়ে পড়বেন না। বরং জীবন বাঁচাতে মানুষ যেমন শুরুতেই প্রাণপণ লড়াই করে, তিনিও সেভাবে লড়াই করবেন। আর এই ‘কলক্কের’ ট্যাবু দূর হলে ধর্ষণের আলামত, সাক্ষ্য পাওয়া অনেক সহজ হবে। সহজ হবে বিচার পাওয়াও। বিচার  প্রক্রিয়ায় নারীর চরিত্রহননের জন্য প্রশ্ন করে আইনজীবী তাকে আর কাবু করতে পারবেন না। তিনি তখন বুঝাতে পারবেন ‘না’ মানে ‘না’।

আর এসবই সম্ভব হবে  নারীর শরীরকে ‘তীর্থ’ জ্ঞানের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে। কী অদ্ভূত চিন্তা—নারীর শরীর তীর্থ, কিন্তু পুরুষের শরীর নয়! তাই পুরুষ ধর্ষক হলেও তার তীর্থ কলঙ্কিত হয় না। হয় শুধু নারীর। নারীকে অবদমিত করে এই তীর্থ চিন্তাই ধর্ষণের মূল সূত্র বলে আমার মনে হয়।

শরীর তো শরীর। এটা  আক্রান্ত হতে পারে। পীড়নের শিকার হতে পারে। মাথায় আঘাতের শিকার হওয়া বা শরীরে অন্য কোনও অঙ্গ দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হওয়ায় আমাদের যে প্রতিক্রিয়া, আমাদের যে ক্ষোভ, আমাদের যে কষ্ট এবং বিচারের দাবি, সেই প্রক্রিয়াই সঠিক। ধর্ষণের শিকার নারী যতদিন এটাকে নিজের ‘কলঙ্ক’ হিসেবে দেখবেন, তত দিনই ধর্ষক সুবিধা পাবে।

তাই আমার কাছে সহজ বিবেচনা হলো শরীর ‘তীর্থ’ নয়। আর কেউ এটাকে কলঙ্কিত করতে পারে না। এটা আমাদের চিন্তায় ও মননে ধারণ করতে পারলেই ধর্ষক জবাব পাওয় শুরু করবে।

লেখক: সাংবাদিক

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ