X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্রাট থেকে পাপিয়া: রাজনীতির নতুন ‘সৃজনশীলতা’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:০১আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:০৩

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বৈশিষ্ট্য হলো তারা রাজনীতির আলাপ করতে পছন্দ করে। এই ঢেউটা লেগেছে নিম্নবিত্তের মাঝেও। সিএনজি বা রিকশায় উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন চালক রাজনীতির আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার হটানোর পর থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শ, কর্মসূচি, স্লোগান, জমায়েত ক্রমশ কেমন প্রাণহীন হয়ে উঠেছে। বাসে, ট্রেনে, চায়ের দোকানের আড্ডায়, বন্ধুর সঙ্গে যে রাজনৈতিক আলোচনা হয়, সেগুলো অনেকদিন ধরেই জীবন্ত, চলমান, সৃষ্টিশীল হচ্ছিল না। রাজনীতির মাঝেই একটা অরাজনৈতিক শূন্য পরিসরে হঠাৎ করে যেন ঢাকাই সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য দেখা যেতে শুরু করেছে।
সম্রাট বাহিনীর ক্লাব পাড়ার ঝলমলে ক্যাসিনো জগৎ থেকে পাঁচ তারকার ওয়েস্টিন হোটেলে পিউ পাপিয়ার রঙিন দুনিয়া–যেন রাজনীতিতে জ্যান্ত এক সৃজনশীল প্রয়াস। রাজনীতির যে চেনা জগৎটা আমরা চিনি, সেটা যেন ছোট হয়ে গেছে। বড় হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এক নতুন রাজনীতি, যা নেতা-পাতি নেতাদের বানিয়ে দিচ্ছে মহাধনাঢ্য। এই লেখা যখন মঙ্গলবারে লেখা হচ্ছে তখনই খবর এলো ক্যাসিনোয় জড়িত দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকার বাড়িতে র‌্যাব আবার অভিযান চালিয়েছে। তারা দেখতে পেয়েছে এই বাসায় স্তরে স্তরে সাজানো শুধু টাকা আর টাকা এবং স্বর্ণালংকার।

শাসক দল আওয়ামী লীগের অতি সাধারণ এক অঙ্গ-সংগঠনের নরসিংদী জেলা শাখার নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ তার স্বামীসহ র‌্যাবের হাতে আটকের পর আলোচনা থামছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে তার বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ উঠছে, সেসব দেখে সেই প্রাণহীন গতানুগতিক রাজনৈতিক আড্ডায় যেন সৃজনশীলতা ফিরে এসেছে। আড্ডাবাজরা চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনে, আর সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশে একটি মফস্বল শহরে আওয়ামী লীগের একটি সহযোগী সংগঠনের নেত্রী কীভাবে এত প্রভাব-প্রতিপত্তি-অর্থ-বিত্তের মালিক হলেন? তারই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে তাকে যারা রাজনীতিতে এনেছে, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, তারা না জানি কী করেছে?

যেকোনও ঘটনা বা বিষয়কে ভেতর থেকে আর বাইরে থেকে দু’ভাবে দেখা যায়। আমরা যারা আমজনতা, তারা বাইরে থেকে অবাক হচ্ছি শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার গল্প আর এই ছোটখাট নেতা-নেত্রীদের চকচকে জীবন দেখে। বাইরের লোক হিসেবে যতই গবেষণা করি না কেন, আমরা জানতেও পারবো না, যারা সম্রাট পাপিয়াদের সৃষ্টি করে, রাজনীতিতে নিয়ে আসে, তাদের জীবন আরও কতটা বেশি সিনেম্যাটিক।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন অনেক আগেই প্রবেশ করেছে। ব্যাপারটা কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। মানুষ যেন ধরে নিয়েছে, এই দু’টি কুপ্রথার সঙ্গে সহাবস্থান করা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু ক্যাসিনো কাণ্ড আর পাপিয়ার ওয়েস্টিন কাণ্ড কেমন যেন নতুন জানালা খুললো মানুষের জন্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মানুষের মনে একটা উন্নয়ন স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছে। এবং বড় প্রকল্প, বড় বিনিয়োগে সেই উন্নয়নটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে যখন, তখন এই দুর্বৃত্তায়ন চিত্র আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি হতাশাও সৃষ্টি করে। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের কিছু কিছু নেতার এই অনাচার প্রশাসনকে এবং মানুষকে বিপন্ন করছে।

আমাদের সব প্রত্যাশাকে নিচুতলার জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা বলে রাজনীতিতে সম্রাট-পাপিয়ার জন্মদানকারীরা উড়িয়ে দেয়। দুর্বৃত্ত অধ্যুষিত শাসকদলের এসব নেতার শাস্তি কী হবে জানা নেই। কারণ বিচারিক প্রক্রিয়া বড় দীর্ঘ। তবে আশার কথা এই, অন্তত দু’একজন হলেও ধরা পড়ছে এবং সেটা হচ্ছে তখন, যখন তাদের দলই ক্ষমতায়। এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন দূর করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। 

দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আর দুর্বৃত্তায়নের দৌরাত্ম্যে রাজনীতির সর্বাঙ্গে পক্ষাঘাতের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই ব্যাধির একটি চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যা চাচ্ছেন, সেটাই চিকিৎসা। দল এবং প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দুরাচারীদের কবল হতে মুক্ত করতেই হবে। তত্ত্বগতভাবে দুটি কাজ স্বতন্ত্র। প্রশাসনকে দলের সঙ্গে না মিলিয়ে আলাদাভাবে কাজটি করার কথাই বলবে সবাই। কিন্তু একথা মানতেই হবে, প্রশাসনের ওপর দলের একটি প্রভাব থাকেই। প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি যেন আমলারা যে জনগণের সেবক সেটা তাদের মনের গভীরে আরেকবার জেগে ওঠে। আর রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের অশালীন প্রদর্শনকে কোনোভাবেই সস্নেহ প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সেকথাটি স্পষ্ট করা জরুরি।

চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং সিন্ডিকেটবাজি কেবল এই সরকারের আমলেই ঘটেছে এটা কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধীরাও বলবেন না। শুরু হয়েছে বহু আগেই। তবে ‘খুল্লাম-খুল্লা’ ভাবটা দেখা দিতে শুরু করে ২০০১-এর পর জামায়াত-বিএনপি সরকারের সময় বহুল কথিত হাওয়া ভবনের মাধ্যমে। সময়ের ব্যবধানে এই সংস্কৃতি নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য নিচ্ছে কেবল।

এটি অসুখ এবং অসুখটা তুচ্ছ নয়। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের এই নতুন অসুখকে থামাতেই হবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ