X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাপিয়াদের উত্থান প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৫ মার্চ ২০২০, ১৫:৪৩আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২০, ১৫:৪৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী পাপিয়া নামের এক নারীকে নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় দেখছি বেশ কয়েকদিন ধরে। বড় শহরে পাপিয়ারা থাকেই। একসময় কলকাতা শহরের হেমাঙ্গিনীর ছেলের হিন্দু কলেজে ভর্তি নিয়ে বিরাট এক তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল। বড় জমিদাররা থাকতো কলকাতায়। এমন কোনও জমিদার ছিল না যারা হেমাঙ্গিনীর শয্যাসঙ্গী হয়নি। হেমাঙ্গিনীর ছেলেটা তাদেরই কারও না কারও ঔরসজাত সন্তান ছিল। হেমাঙ্গিনীর ছেলের হিন্দু কলেজে ভর্তি নিয়ে প্রতিপত্তিশালী জমিদাররা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছিল ভর্তি করার পক্ষে, আরেক অংশ ভর্তির বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত হেমাঙ্গিনীর ছেলের ভর্তির বিরোধে হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দু কলেজের পরিত্যক্ত কাঠামোর মধ্যে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কলকাতা শহরের হেমাঙ্গিনী নিজস্ব বিলাসবহুল রঙমহল প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর ঢাকায় পাপিয়া ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটকে রঙমহল হিসেবে ব্যবহার করতো—এই যা ব্যবধান। যুগের বিবর্তনে এখন ডিজিটাল যুগ এসেছে। তাই পাপিয়ারা ডিজিটালের সুবিধা ভোগ করছে। পাপিয়াদের উত্থান যুগে যুগে ছিল—এটা কোনও নতুন ইতিহাস নয়।

কয়েকজন অটোম্যান সম্রাট ছিলেন যারা হেরেমের বাইজিদের সন্তান। সৌন্দর্যও সম্পদ। অনেক বাইজি সেই সম্পদ ব্যবহার করে পরিপূর্ণভাবে ফায়দা লুটেছে। বর্তমান পাপিয়া হয়তো তাদেরই একজন বা অন্যদের সে সম্পদকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নেত্রীর আদেশে পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ কার আদেশে গ্রেফতার করা হলো, সেটাই বড় কথা নয়। গত ৩৮ বছর শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ বছর রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও তিনি পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং গত ৩৮ বছর সংগঠন আর ১৬ বছর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মধ্যে শামীমা নূর পাপিয়া, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, জি কে শামীম-খালেদ মাহমুদ, আলমগীর মহিউদ্দিন, পি কে হালদারদের উত্থান হলো কীভাবে!

হাইকোর্টের নির্দেশে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি সমগ্র কিছু দেখেশুনে পদত্যাগ করেছেন। আর বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানো যাবে না। যেখানে লিজিং কোম্পানিগুলোর এই অবস্থা, সেখানে নতুন লিজিং কোম্পানির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংকের সব টাকা তো উদ্যোক্তারা খেয়ে ফেলেছে। বেসিক ব্যাংকের টাকাগুলো চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু গংরা বিলিবণ্টন করে নিয়ে গেছে। অথচ এরা সবাই অধরা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানি টিকবে কিনা সন্দিহান ইব্রাহিম খালেদ।

এখন সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে আগামী বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করতে হবে, না হয় ব্যাংকগুলো অচল হয়ে যাবে। দেশের অর্থব্যবস্থায় যদি অনুরূপ হাল বিরাজ করে তবে অর্থব্যবস্থা তো ভেঙে পড়বে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো আপনি অচিরেই অভিজ্ঞ লোক দিয়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করুন এবং কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করুন। না হয় দেশ এক মহাবিপদের সম্মুখীন হবে।

আমরা যা উপলব্ধি করেছি ব্যাংকগুলোর ওপর, লিজিং কোম্পানিগুলোর ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সেই কারণে অর্থব্যবস্থার করুণ হাল সৃষ্টি হয়েছে। এত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জারের মধ্য দিয়ে সীমিত সংখ্যায় নিয়ে আসুন এবং শক্তিশালী লোক দিয়ে ম্যানেজমেন্ট পরিচালনা করুন।

ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণর পতনের আগে ইন্দোনেশিয়ার ব্যাংক ব্যবস্থাও অনুরূপ হয়েছিল। সুহার্তো ক্ষমতায় এসে শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানের সময়ে স্টেট ব্যাংকে কন্ট্রোলার অব শিডিউল ব্যাংক বলে এক শক্তিশালী অফিসার ছিলেন। তারা খুবই ভিজিলান্ট থাকতেন। কন্ট্রোলারের অফিস ইচ্ছা করলে যে কোনও ব্যাংকের ভল্ট খুলে নগদ টাকা গুনে রেকর্ডের সঙ্গে মিল আছে কিনা দেখতো। অনুরূপ কঠিন ব্যবস্থা প্রয়োগ না করলে অর্থ ব্যবস্থার হাল ফেরানো কঠিন হবে।

ওয়ার্ল্ড মিডিয়াগুলো চীনের, আমেরিকার, জাপানের, ভারতের অবনতিশীল আর্থিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মন্দার কথা বলছে। বিশ্ব মন্দায় আক্রান্ত হলে বাংলাদেশ যে মন্দার কবলে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং মন্দা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা বিষয়ে নিবেদন করবো, আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে উঠাবসা করি, আর সাধারণ মানুষ মনে করছে দেশে একটা নীরব লুটতরাজ চলছে। মানুষের এই ধারণা তো মারাত্মক খারাপ একটা ধারণা। এটি সরকারের জন্য আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে এবং এই ধরনের একটি সংকট সরকারের পতনের জন্য যথেষ্ট।

আমরা মনে করি এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা প্রয়োজন। সুতরাং মন্ত্রিসভার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী—এদের মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনুন। এখনকার মন্ত্রিসভাকে মানুষ ওজনদার মন্ত্রিসভা মনে করছে না।  আর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত কোনও ব্যক্তিকে যদি মানুষ সরকারপ্রধানের কাছাকাছি দেখে, তার প্রতি যদি মানুষের ঘৃণা থাকে, তাহলে মানুষ তো আস্থাহীনতায় ভুগবে।

১৯৬৬ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর ৪৩ দিন পর বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত করেন, তার দুই সপ্তাহ পরে চট্টগ্রামে জ্যাক্স বেকারির পাশের খালি জায়গায় একটি কর্মিসভা করেছিলেন এবং তাতে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই কর্মিসভায় উপস্থিত ৪৩ জন কর্মীর একজন কর্মী। আমরা যখন সংগঠনের জন্য প্রাণ বাজি রেখে কাজ করেছি, তাই সংগঠনের আজকের করুণ অবস্থা, আর কর্মীদের দেখলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু রোগে, শোকে, বয়সে জর্জরিত হয়ে গেছি বলে এখন দেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর কাজ করাও সম্ভব নয়। যা উপলব্ধি করেছি, প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর দরকার বলে এই লেখা লিখছি। আশা করি সভানেত্রী দেশ গঠনের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় সবকিছুই পুনর্বিন্যাস করবেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ