X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে কি মধ্যবিত্ত?

রুমিন ফারহানা
০৭ মার্চ ২০২০, ১৫:২৯আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২০, ১৫:৩১



রুমিন ফারহানা মধ্যবিত্ত হলো একটা সমাজের আয়না, যে আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের চিত্র। সুতরাং একটা সমাজের চরিত্র কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ধারণ করে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং তারাই বড় অংশ। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন আমাদের সমাজের এই অংশ শুধু সমাজ গঠন নয়, এমন কী রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হবে তাতেও ভূমিকা রাখতো। এই শ্রেণিতে বেড়ে ওঠা মেধাবী ছেলেটিই হয়ে উঠতো অসাধারণ ছাত্রনেতা, সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, যার মেধার ছাপ স্পষ্ট হতো সমাজের সর্বক্ষেত্রে। আর তাই সমাজ নির্মাতা বলতে যা বোঝায় তা উঠে আসতো এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই। শিক্ষা, আভিজাত্য এবং কিছুটা বিত্তের মিশেলে তৈরি হওয়া সমাজের এই অংশ গড়ে উঠেছিল নানা শ্রেণি পেশার মানুষের সমন্বয়ে, যার মূল অংশজুড়েই ছিল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সরকারি কর্মকর্তাসহ সেসব মানুষ, যারা সমাজ গঠনে, পরিবর্তনে, নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে শিক্ষা অনেক পরে এলেও অন্তত ৯০ দশক পর্যন্ত সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিই তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল সর্বস্তরে। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও নির্ণায়কের ভূমিকায় তারাই ছিল প্রধান।

৯০-এর পর থেকে সমাজে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে নতুন আর একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, অর্থনীতিই ছিল যাদের মূলভিত্তি। অর্থনীতিকে মূলভিত্তি ধরে গড়ে ওঠা এই নতুন মধ্যবিত্তের তিন/চার প্রজন্মের শিক্ষা, সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা তেমন জোরালো না থাকলেও সমাজ গঠন আর নির্মাণে ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। তারপর ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে সর্বত্র। বিশেষ করে নব্য ধনী শ্রেণির দ্রুত বিকাশ, রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য শুধু নয়, পুরো রাজনীতির দখল নেওয়া বদলে দেয় সমাজের চিত্র। যেহেতু সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি পরস্পরের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কযুক্ত, তাই এর যেকোনও একটির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটতে থাকে অন্যগুলোরও। নব্য ধনী এই শ্রেণিটি রাজনীতির দখল নেওয়ার পর পালটে যায় পুরো সমাজচিত্র।
সরকারের পক্ষ থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি আর কিছু অবকাঠামো নির্মাণ দেখিয়ে উন্নয়নের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কতটা ফাঁপা বুলি সেটা বোঝা যায় দেশের বেকারের অবিশ্বাস্য সংখ্যা দেখে। তিন মাস আগে প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র এক গবেষণা দেখিয়েছে এই দেশের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণ বেকার আর এক-পঞ্চমাংশের পূর্ণকালীন চাকরি নেই। মধ্যবিত্তের আর্থিক ভিত্তি তৈরিকারী চাকরির এই অবস্থা প্রমাণ করে দেশে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারছে না।
ওদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর সরকারের নানা রকম পরোক্ষ কর আরোপ করে, ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দূরেই থাকুক, অতি উচ্চ বাড়ি ভাড়া দিতে বাধ্য করে, সরকারের প্রণোদনায় বা নির্লিপ্ততায় সিন্ডিকেট করে নানা নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির মাশুল উপর্যুপরি বাড়িয়ে, শেয়ারবাজারে নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে কারসাজির মাধ্যমে পথে বসিয়ে, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার একেবারে কমিয়ে ফেলে মধ্যবিত্তকে আর্থিকভাবে বিকলাঙ্গ করে ফেলা হচ্ছে ক্রমাগত। সুতরাং ঐতিহ্য, সংস্কৃতি দূরেই থাকুক, কেবল অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিও আজ হুমকির মুখে।
সামন্তবাদী সমাজ থেকে একটা পুঁজিবাদী সমাজে বিবর্তিত হওয়ার সময়ই নানা শিল্প এবং সেবা খাতের বিকাশের পথে নতুন নতুন পেশা তৈরির মাধ্যমেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির সৃষ্টি এবং বিকাশ হয়েছে। একটা পুঁজিবাদী অর্থনীতি টিকে থাকে মানুষের ভোগের ওপর ভিত্তি করে। আর ভোগের মূল হিস্যা থাকে মধ্যবিত্তদের। কোনও সমাজে যদি ভোগ কমে যায় তাহলে সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।
গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি বিকশিত হয়েছে খুব দ্রুত। বিআইডিএস-এর গবেষণা অনুযায়ী আমাদের দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ২০১৫ সালে ছিল ২০ শতাংশের মতো অর্থাৎ প্রায় ৩.৫ কোটি। সেই হিসাবে এই সংখ্যা এখন প্রায় ৪ কোটি হতে পারতো। সাম্প্রতিক কোনও গবেষণার তথ্য নেই, কিন্তু অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি দেখলে বোঝা যায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রত্যাশিত পর্যায়ে যায়নি।

দেশের অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়ায় মানুষের দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসার হার কমে যাচ্ছে। এছাড়াও যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে সেটার মূল অংশ যাচ্ছে নানাভাবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সুফলভোগী অল্প কিছু মানুষের কাছে। ফলে মধ্যবিত্তের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশের যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে তার পেছনে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির খুব বড় ভূমিকা আছে। তাই এই শ্রেণিটির বিকাশের গতি মন্থর হয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে এর মধ্যেই স্থবির হতে শুরু করা দেশের অর্থনীতি আরও বিপদাপন্ন হওয়া, সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।

অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত কমছে ‘সাংস্কৃতিক মধ্যবিত্ত’-এর সংখ্যাও। গত প্রায় এক দশকে সমাজে আর্থিকভাবে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যাদের উপার্জন তাদের শিক্ষাভিত্তিক চাকরি কিংবা ব্যবসা নয়, তারা বরং উপার্জন করছে সরকারের নানা প্রকল্পে তদবির, দালালি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি অর্থাৎ নানা ধরনের ‘রেন্ট সিকিং’-এর মাধ্যমে। এখানে বলছি সরকারি দলের একেবারে নিম্ন সারির কর্মীদের কথা। এর ওপরে থাকা কর্মী এবং নেতারা হয়েছে ধনী কিংবা অতি ধনী। এভাবে বেশ কিছু মানুষ বেশ দরিদ্র অবস্থা থেকে দ্রুত ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত’ হয়ে উঠেছে।
স্বাভাবিক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তরা হয় ‘কমফরমিস্ট’ অর্থাৎ তারা তাদের শ্রেণির ঐতিহ্যবাহী চিন্তা, মূল্যবোধ মেনে চলতে এবং রক্ষা করতে চায়। কিন্তু ‘রেন্ট সিকিং’-এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এসব ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত’ এসব মূল্যবোধের কথা জানেও না, আবার জানতে পারলেও সেটা তাদের কাছে কোনও মূল্য রাখে না। তাই মধ্যবিত্তের চিরায়ত মূল্যবোধ আমাদের সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে বেশ দ্রুত গতিতেই। এ কারণেই দীর্ঘ সময় ধরে অর্জিত ‘সামাজিক পুঁজি’ মধ্যবিত্তের হাতছাড়া হতে বসেছে। এই পুঁজি হাতছাড়া হওয়া মানে সমাজে মধ্যবিত্তের যে প্রভাব ছিল একসময় সেটা আর থাকবে না। আর তাই ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে নতুন এক শ্রেণি, যারা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি থেকে বহু দূরে অবস্থান করা সম্পূর্ণ নতুন এক শ্রেণি, যারা দ্রুত ধনী হওয়ার নেশায় যেকোনও কিছু করতে প্রস্তুত।

নানামুখী চাপে পড়ে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়া শিক্ষা আর সংস্কৃতি নির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি আজ দখল হারিয়েছে রাজনীতি সমাজসহ আরও নানাদিকে। শুধু তাই নয়, ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া এই শ্রেণির কিছু অংশ আত্মরক্ষার্থে প্রতিনিয়ত দেশের বাইরেও পাড়ি জমাচ্ছে।
সমাজে খুব মোটাদাগে স্পষ্ট হচ্ছে দুটি শ্রেণি। একটি যারা বৈধ-অবৈধ নানান উপায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছে আর আছে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। এই দুই শ্রেণি কোনোদিনই সমাজ, রাজনীতি, মূল্যবোধ তৈরি বা পরিবর্তনে কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং তীব্র বৈষম্য সমাজকে করেছে অস্থির। এই অস্থিরতার বিরুদ্ধে যে শ্রেণিটি পাল্টা শক্তি হিসেবে কাজ করে সমাজের কাঠামোটিকে (সোশ্যাল ফ্যাব্রিক) রক্ষা করে এসেছে এতকাল, সেই শ্রেণিটি আকার এবং মূল্যবোধগত দিক থেকে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গিয়ে আমাদের বিপদ বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমানের চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারটির আমলে চরম গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে আমাদের ‘মধ্যবিত্ত’ সমাজ কেন যথেষ্ট প্রতিবাদী হয়ে উঠছে না, এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত আছে এই শ্রেণিটির চরিত্রগত বিবর্তনের মধ্যে।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ