X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের শাসন তিরোহিত হলে অরাজকতা দেখা দেবে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১২ মার্চ ২০২০, ১৫:২৬আপডেট : ১২ মার্চ ২০২০, ১৫:২৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একজন বিজ্ঞ আইনজীবী। তিনি আইনজীবী পরিবারের সন্তান, আবার দীর্ঘদিন আইন ব্যবসার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। সুতরাং তার হাতে বিচারব্যবস্থার মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত হলে তাতে মানুষ শঙ্কিত হয়। কারণ সাধারণ মানুষ আশঙ্কা করে, বিচারব্যবস্থাও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে কিনা। পিরোজপুরের সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতা একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের জামিন নিয়ে গত সপ্তাহে যে ঘটনার অবতারণা লক্ষ করেছি, তাতে আমরা যারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাই, তারা ব্যথিত হয়েছি।
ইংরেজ রাজত্বের শুরুতে যখন বিচারব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়, তখন তাতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। মেয়রস কোর্ট তুলে দিয়ে ১৭৭৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে যখন সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনও কিন্তু গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল অব্যাহত ছিল। সমক্ষমতাসম্পন্ন দুইটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে বহুমুখী ঘটনা ও গল্প প্রচলিত ছিল। এই দুই প্রতিষ্ঠান প্রধান পরস্পরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে পেয়াদা পাঠিয়েছিলেন। কর্তৃত্বের মধ্যকার সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট ছিল বলেই এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রশ্রয় পেয়েছিল। ১৭৮১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট পাস করে বিবাদের ক্ষেত্রগুলোকে নির্দিষ্ট কর্তৃত্বের হাতে অর্পণ করেছিল। এইভাবে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা বর্তমান পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং এখন বিচারব্যবস্থায় এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই বললে চলে।

শাসক দলের একজন সাবেক এমপি এবং তার স্ত্রীকে তিনটি দুর্নীতি মামলায় জামিন মঞ্জুর না করায় পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নানকে সঙ্গে সঙ্গে সেই কোর্ট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরেকজন জজকে নিয়োগ দিয়ে আউয়াল এবং তার স্ত্রীর জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেই জজ জামিন মঞ্জুর করেননি, তাকে প্রত্যাহার করে প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়, পরবর্তী সময়ে কুড়িগ্রামের জেলা জজ হিসেবে পদায়ন করা হয়। বিচার বিভাগের অনুরূপ কর্মকর্তাকে অনাচারের সম্মুখীন করা আইনমন্ত্রীর জন্য মোটেও শোভনীয় কাজ হয়নি। তার এই কাজে একটা নগ্ন হস্তক্ষেপের আলামত প্রকাশ পেয়েছে। নগ্ন হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশের শাসনব্যবস্থা চলছে বলে যেই প্রচারণা তাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ন্যায়-অন্যায়ের কোনও বালাই এখন নেই। আদালতে একটু নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ ছিল, তাও যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে জাতি তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে।

আউয়াল সাহেব সরকারি দলের শক্তিশালী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা। নিশ্চয়ই মামলার ভিত্তিও শক্তিশালী হবে, মসলা আছে, না হয় তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হবে কেন! সম্ভবও নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন কিছুটা তৎপর হয়েছে। মাঝে মাঝে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুই একটা মামলাও সম্প্রতি হচ্ছে। দুদককে শুধু মামলা করে বসে থাকলে হবে না, মামলার পরিণতিও লক্ষ রাখতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাৎক্ষণিক জেলা জজকে বদলি করে আরেকজন বসিয়ে আউয়াল আর তার স্ত্রীর জামিনের ব্যবস্থা করে একটা লজ্জাজনক কারবার করলেন। আবার তার সাফাই গাওয়ার জন্য প্রেস কনফারেন্স করেছেন তিনি। বলেছেন, কোর্টের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নাকি সেশন জজকে বিদায় দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু তার জামিন নাকচের আদেশ বাতিল করার ব্যবস্থা নিলেন কোন অজুহাতে, তা তো বুঝলাম না। আর আইনশৃঙ্খলার অজুহাতে যদি জামিন দিতে হয় তাহলে তো সব যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। তাদের সমর্থকরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে অরাজকতা, নৈরাজ্য, পৈশাচিক আচরণ করেছিল।

আনিসুল হক আরেকটি কথা বলেছেন, ওই জজ ‘অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ়’ ব্যবহার করায় তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকে কারাগারে পাঠানো ওই বিচারককে তাৎক্ষণিক বদলি আইনের শাসনের ব্যত্যয় কিংবা বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ নয় বলেও তিনি দাবি করেন। একজন বিচারকের আচরণ রূঢ় হতে পারে, কিন্তু আইনমন্ত্রীর ভাষায় ‘অত্যন্ত অশালীন’ হয় কী করে! এখানে নিশ্চয়ই কমিউনিকেশনের সমস্যা হয়েছে। আমরা বিচারব্যবস্থার দুর্দিন দেখে খুবই শঙ্কিত হয়েছি। আইনমন্ত্রী যদি এমন আচরণ করেন তাহলে তো বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হবে। সুস্থ বিবেকের অবসান হলে চলবে না।

আরেক জামিন নিয়েও কথা উঠেছে। সেই জামিন যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত জিকে শামীমের জামিন। শামীমের একমাস আগেই জামিন হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে শামীমকে কারামুক্ত করার কোনও উদ্যোগ কেউ নেয়নি। দেখলাম জামিন আবেদনে বহু কায়দা করে শামীমের নাম উল্লেখ করে জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জামিনের শুনানির সময় সরকারি আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কোথায় ছিলেন?

এগুলোতো আইনমন্ত্রীর দেখা উচিত। নয়তো বিচারব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ার দিকে এগিয়ে যাবে। আমি প্রধানমন্ত্রীকেও এই ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে বলবো। প্রধানমন্ত্রী যদি আশু ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে সমাজব্যবস্থার ধস নামবে। বিচারব্যবস্থায় আইন যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে মানুষ আইন হাতে তুলে নেবে। তখন সমাজে অরাজকতা দেখা দেবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ