X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা কি একবারও ডাক্তারদের কথা ভাবছি?

রুমিন ফারহানা
২০ মার্চ ২০২০, ১৬:০৫আপডেট : ২১ মার্চ ২০২০, ১৫:১০

রুমিন ফারহানা অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। 
১. কিছুদিন আগে প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর আমাদের নজর কাড়ে। খবরটিতে বলা হয়, গ্যাস্ট্রোইন্টেসটাইনাল জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে এক তরুণী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরন করেন। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসায় তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করেন এবং তার সমস্যাও কমে আসছিল। কিন্তু সর্বনাশ হয় যখন মেয়েটির বাবা একপর্যায়ে বলে ফেলেন সে কিছুদিন আগেই কানাডা থেকে ফিরেছে। মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে কর্তব্যরত নার্স চিৎকার করে বলতে থাকেন, সে কানাডা থেকে এসেছে, জ্বর আছে এবং ডাক্তারকে জানায় মেয়েটি করোনায় আক্রান্ত। আর যায় কোথায়? মেয়েটির পরিবারের ভাষ্যমতে, এরপর পুরো ওয়ার্ডে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসক, নার্স সবাই তাকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং একপর্যায়ে মেয়েটি মারা যায়।  
২. অন্যদিকে প্রাণঘাতী করোনা সন্দেহে ওই একই হাসপাতালের চার চিকিৎসককে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিউমোনিয়া, জ্বর, ঠান্ডা, কাশি নিয়ে প্রচুর রোগী প্রতিদিন আসছে। এদের মধ্যে তিন-চার জন রোগীর বক্তব্য শোনার পর তাদের ঢামেকের বাইরে সরকারের বরাদ্দ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলে পরে দেখা যায়  তাদের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। আর এই কারণেই যেসব ডাক্তার তাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।  

৩. করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিজেদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে গেছেন। তাদের অভিযোগ, ডাক্তারদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি।  তারা বলেন, নৈতিক কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতির সময় তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। তখনও একই অবস্থা ছিল। 

বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে জিনিসটি আমাদের ক্ষেত্রে প্রকটভাবে নজরে এসেছে তা হলো  তীব্র সমন্বয়হীনতা। প্রথমত শুরু থেকেই এর ভয়াবহতার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা আমাদের শুধু বিস্মিতই করেনি, বরং আমাদের ভীত করেছে এই কারণে যে যেখানে বিশ্বের শক্তিশালী সব দেশের সরকারগুলো করোনা পরিস্থিতিকে যুদ্ধাবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে মহামারী বলে অনেকদিন আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরেই থাকুক, দীর্ঘ সময় সরকার ব্যস্ত ছিল উৎসব পালনে। 

গণমাধ্যমের কল্যাণে যা দেখেছি তাতে আইইডিসিআর এর পরিচালক আর তার এক সঙ্গী ছাড়া এই বিষয়টি নিয়ে আর কেউ জানেন বা কাজ করছেন তেমনটি মনে হয়নি। প্রথম থেকেই সরকারের মধ্যে এক ধরনের ধামা চাপা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। ধামাচাপা বলছি এ কারণেই যে শুরু থেকেই আইইডিসিআর ছাড়া আর কোনও হাসপাতালে বা ল্যাবে এই রোগের পরীক্ষা অনুমোদিত না। এখন যখন আরও কয়েকটি জায়গায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তখনও সেটার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে আইইডিসিআর এর হাতে। এতে সরকারের এক সুবিধা হলো আইইডিসিআর যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান তাই সরকার যে চিত্র দেখাতে চাইবে ঠিক সেই চিত্রটিই ফুটে উঠবে।

সরকারের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, ন্যূনতম সেবা নিশ্চিতের জন্য অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রের চরম অভাব, প্রকৃত চিত্র লুকোছাপা, করোনা নিয়েও রাজনৈতিক বক্তব্য ইত্যাদি যদি সরিয়েও রাখি তারপরও যে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করা এবং সচেতন হওয়া উচিত ছিল তা হলো যারা এই সীমিত অবস্থাতেও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে আমাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চাইছেন সেই সব ডাক্তার আর নার্সদের নিরাপদ রাখতে আমরা আদৌ কি ভাবছি? অথচ তারাই আছেন সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে।  

করোনা আসার আগ পর্যন্ত হাঁচি, কাশি, পেট ফাঁপা সবকিছু নিয়ে যারা ব্যাংকক সিঙ্গাপুর দৌড়াতেন আর কথায় কথায় বলতেন আমাদের ডাক্তাররা কিছুই বোঝেন না, তারা এবার পড়েছেন বেকায়দায়।  তাদের জন্য এবার ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর দূরেই থাকুক ঘরের দ্বারে থাকা ভারতের দরজাও বন্ধ। আমি বা আমার বাবা-মা কোনোদিন কোনও অসুখে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার কথা চিন্তাও করিনি, সামর্থ্যও নেই। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় বাবাকে নিয়ে আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে, থাকতে হয়েছে মাকে নিয়েও। আমি দেখেছি কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন আমাদের ডাক্তাররা। সীমিত রিসোর্স, কিন্তু সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা। সবার আছে ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ, ছুটি নেই কেবল ডাক্তারদের। পরিবারের কোনও অনুষ্ঠানে সবচেয়ে দেরিতে, সবচেয়ে ক্লান্ত শরীরে যিনি উপস্থিত হন তিনি আর কেউ না, আমাদের ডাক্তার।  গভীর রাতে কিংবা কাক ডাকা ভোরে ফোনের কর্কশ শব্দে যিনি চমকে জাগেন তিনি হলেন ডাক্তার।  আমার অসুস্থ-বৃদ্ধ মা বাবা’কে নিয়ে আমার একদম একলা চলার পথকে যারা কিছুটা হলেও সহজ করেছেন তারা আমাদের এই ডাক্তার।  না, আমার অতি সভ্য, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ, সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং ভদ্রতার আতিশয্যে খ্যাত তথাকথিত নিকট আত্মীয়-স্বজন ২/১ বার যে উঁকি দিয়ে দেখে যাননি এ কথা বললে তাদের প্রতি অবিচার হবে। তবে ২০০৪ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যাদের ওপর আমি সত্যিকার অর্থে নির্ভর করেছি, যারা পরম আত্মীয়ের মমতা নিয়ে আমার পাশে ছিলেন এবং আছেন তাদের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই আমার উদ্বেগ অনেক বেশি।  

পত্রিকা কিংবা ফেসবুকে যখন দেখি নিজেরা কী ভীষণ প্রটেকশন নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে উন্নত বিশ্বের ডাক্তাররা তখন সত্যি খুব দুঃখিত না হয়ে পারি না আমাদের ডাক্তারদের কথা ভেবে।  ৫ টাকার একটা মাস্ক আর ৫ টাকার গ্লোভস তাদের আত্মরক্ষার একমাত্র সম্বল।  অনেক হাসপাতালে তাও নেই। অনেক হাসপাতালেই  নেই পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা ক্যাপ।  আর পিপিই (personal protection equipment) এর কথাতো ছেড়েই দিলাম।  ডাক্তাররা নিজেরাই যেটুকু পারেন আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন।  অথচ তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবা উচিত ছিল সবার আগে।   

মানুষ স্বভাবজাত ভাবেই আত্মকেন্দ্রিক, নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তাই তার প্রথম এবং প্রধান চিন্তা। করোনা ভাইরাস এই সত্য আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের।  এই মহামারি আসার পর বিশ্বব্যাপী  নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুদামজাত করার যে প্রবণতা আমরা দেখলাম তা আর একবার আমাদের মনে করিয়ে দিল ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, সভ্যতা আলাদা হতে পারে, কিন্তু মানুষের যে আদি রূপ তা আসলে একই।  মানুষের এই আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাকে মেনে নিয়েই বলছি, নিজের এবং পরিবারের সুস্থতা নিশ্চিতের জন্য হলেও আমাদের উচিত ছিল ডাক্তারদের সুস্থতা আর নিরাপত্তার প্রতি আরও অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া। কারণ তারা যদি সুস্থ না থাকেন আপনার সেবা নিশ্চিত করবে কে? 

অপরপক্ষে একজন ডাক্তার প্রতিদিন যত রোগীর সংস্পর্শে আসেন তাতে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে তার মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হওয়ার কথা। তাই নিজের সুস্থতা চিন্তা করে হলেও আমাদের সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে ভালনারেবল অথচ অপরিহার্য এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। 

রাজনীতিবিদরা চিরকালই বাগাড়ম্বরের জন্য খ্যাত।  আর আমাদের রাজনীতিবিদরা তো এটিকে প্রায় শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন। কেউ বলছেন করোনা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা-ইতালির চেয়েও বেশি সফল বাংলাদেশ, কেউ বলছেন করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মতো ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতেও নেই আবার কারও মতে শেখ হাসিনার মতো নেত্রী পেয়েছি বলেই করোনা প্রতিরোধ করতে পারছি, করোনা নিয়ে বিএনপি জনগণকে আতঙ্কিত করছে। অর্থাৎ যে যা মনে আসছে বলছে। জবাবদিহিতা না থাকলে অনেক কিছুই বলা যায়, বলে পারও পাওয়া যায়। 

বাগাড়ম্বর দিয়ে যদি করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যেত তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা হতাম দ্রুততম বিজয়ী। কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি রূঢ়। পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অনেক অর্থবল এবং লোকবল  থাকার পরও করোনার হাতে ধরাশায়ী হয়েছে একের পর এক। তাই সরকারি দলের ‘হোমরা-চোমরাদের’ বলছি, যথেষ্টের বেশি হয়েছে, এবার অন্তত বাগাড়ম্বর বন্ধ করুন।

দেশের জনগণ কেমন আছে, জনগণের স্বাস্থ্যের খবরই বা কী, জনগণ বাঁচলো, নাকি মরলো সেটা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা যে নেই সেটা কিছুদিন আগেই দেখা গিয়েছিল ডেঙ্গুর আক্রমণের সময়। হাঁচি-কাশি-পেট ফাঁপায় তারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর নিজেই চলে যেতে পারেন, আবার বড় কোনও সমস্যায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স তো আছেই - এসে নিয়ে যাবে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর।  কিন্তু এই প্রথম ক্ষমতার সর্বোচ্চ থাকা মানুষদের সেই কমফোর্ট জোন শেষ হলো। মরুন বা বাঁচুন, এই প্রথম সেই মানুষগুলোকে এই দেশের ডাক্তারদের হাতে চিকিৎসা নিতে হবে। 

জনগণের কথা ভাবার দরকার নেই, ভাবার দরকার নেই ডাক্তারদের আর তাদের পরিবারের কথাও, সরকারের সর্বোচ্চে থাকা মানুষরা ভাবুন অন্তত নিজের জীবনের কথা, নিজের জীবনের কথা ভেবে হলেও ডাক্তারদের রক্ষা করুন, তাদের সুরক্ষার সব ব্যবস্থা নিন এই মুহূর্তেই।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিমকোর্ট।  জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ