X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফিলানথ্রপিস্ট’, সে কোথায় পাবো?

মাহমুদ মেনন
২৯ মার্চ ২০২০, ১৩:৫১আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২০, ১৭:২৩

মাহমুদ মেনন জনহিতৈষণা শব্দটা বেশ খটোমটো। এই শব্দটির অন্যতম প্রতিশব্দ জনসেবা।  সেটির দখল আমাদের রাজনীতিবিদরা অনেক আগেই এমনভাবে নিয়ে নিয়েছেন যে, এখন জনসেবা শুনলে আপনার কাছে একটা অর্থহীন ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। পলিটিক্যাল রেটরিক-আরকি! বাংলা একাডেমির অভিধান আরেকটি শব্দ লিখেছে, মানবপ্রেম। এটা শুনতে কেমন আধ্যাত্মিক মনে হয়, তাই না? মহাজ্ঞানী, মহাজনের যা ছিল।  একটা জুতসই বাংলা নেই বলেই কি লোকহিতকর কাজগুলো বাংলার মাটি থেকে একদম উবে গেলো! অথচ এই করোনা ক্রাইসিসে আমাদের অনেক বেশি দরকার এমন জনহিতৈষী মানুষ। লোকহিতকর কাজ।
একটা সময় ছিল যখন এমন কিছু জনহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন বলেই বাংলা নামের ভূখণ্ডটি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়েছে। অপেক্ষাকৃত যারা বেশি জমি-জোতের মালিক ছিলেন, যাদের হাতে কিছু বেশি অর্থ ছিল, যাদের ফসল বেশি ফলতো, তারাই এগিয়ে নিয়েছেন অন্যদের। তাদেরই সহায়তায় তৈরি হয়েছিল স্কুল কলেজ মাদ্রাসা। অপেক্ষাকৃত ধনীর বাড়িতে জায়গির থেকে লেখাপড়া শিখেছেন অপেক্ষাকৃত গরিবের ছেলেরা। এই মানুষগুলোর কেউ কেউ ধনাঢ্য বলে পরিচিত ছিলেন। তাদের সহায়তায় কিংবা অনুদানে গড়ে উঠতো দাতব্য চিকিৎসালয়। তাতেই চিকিৎসা হতো সাধারণ মানুষের।

কথাগুলো এজন্য উঠছে, এখন দেশে এমন জনহিতৈষী মানুষের দরকার। যে দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে সে বছরের জুন অবধি কোটিপতি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার জন। আর গত ১০ বছরের প্রবণতা বলছে প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার করে ব্যক্তি স্রেফ ব্যাংকের আমানতকারী হিসেবেই কোটিপতির তালিকায় যোগ হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে এমন কোটিপতি আমানতকারীদের অর্থের পরিমাণ বেড়ে হয় ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে গড়ে প্রতি কোটিপতি রয়েছে দুই কোটি টাকারও বেশি ব্যাংক আমানত। সেই দেশে জনহিতৈষী মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শুধুই কি আমানতকারী। এর বাইরে কারও কারও বালিশের মধ্যে কোটি কোটি টাকা, কারও ড্রয়ারে, কারও তোষকের নিচে, কারও বাসায় বস্তাভরা টাকাও থাকে।  কেউ ক্ষুদ্রঋণের নামে বড় সুদের কারবারি, সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট।  তবে এরা কেউ ফিলানথ্রপিস্ট হবেন, তা অবশ্য কারও কাম্য নয়। এরা তো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ক্যাসিনোবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, পাচারকারী বলেই পরিচিত। তাদের কথা বাদ থাক। কিন্তু যারা বড় বড় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, যাদের ব্যবসায় অনেক পসার, খুব তো শুনি এদের দেওয়া টাকায়ই নাকি রাজনৈতিক দলগুলোও চলে। তা শুধু রাজনীতিতে তেলবাজি করলেই চলবে, নাকি দেশ ও সমাজের জন্যও কিছু করা যাবে?

বলতে পারেন, এই আধুনিক সময়ে পুরনো যুগের ফিলানথ্রপিস্ট কেউ খোঁজে? এটা করপোরেটদের যুগ। এখন করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির সময়।  বাংলায় বলা হয় ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা।  সেটাই বা কতটুকু হচ্ছে? পহেলা বৈশাখের মেলায় পণ্যের বিজ্ঞাপন করা কাগজের পাখা বানিয়ে মানুষের হাতে দিয়েও কেউ কেউ সেরে নিচ্ছেন এই সামাজিক দায়বদ্ধতা।

সে নিয়ে কথা নয়। এখন করোনা ক্রাইসিস মোকাবিলায় তারা কী করতে পারেন সেই প্রসঙ্গ। ভাইরাস যখন দেশজুড়ে চরম আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র যেখানে হিমশিম খাচ্ছে।  চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত পিপিই দেওয়া যাচ্ছে না। মানুষের মুখে মাস্ক তুলে দেওয়া যাচ্ছে না, পর্যাপ্ত নেই বলে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, লিকুইড সাবান দিয়ে সবাইকে বারবার হাত ধোয়ার কথা বলা হচ্ছে, যা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই এত বেশি বেশি কেনা সম্ভব নয়। তখনই তো ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতার সঠিক সুযোগটা তৈরি হয়েছে।

ওষুধ শিল্পে দেশের নাম বিদেশেও ছড়িয়েছে। এই খাতে আমাদের রফতানি আয়ও রয়েছে। দেশের ওষুধের বাজার তো অনেক বড়। ২০-২২ হাজার কোটি টাকার একটি বাজার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কি পারে না সাধারণ মানুষকে এমন সঙ্কটকালে বিনামূল্যে সাবান-স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে? সেটা যদি করা হয়, তাতে কোম্পানির পক্ষ থেকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি পালন করা হয়ে যায়।  আর আমরা হয়তো প্রমাণ পাই নব্য যুগের ফিলানথ্রপির।

এমনি করে যারা খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা করছেন, তারাও তো দেশের বৃহৎ কনজুমার মার্কেটের সুবাদে বিপুল মুনাফা করেন সারাটি বছর। তারাও তো কিছু খাদ্য সহায়তা ঘোষণা করতে পারেন। সাধারণের মাঝে, খেটে খাওয়া মানুষগুলো, যারা দিন আনে দিন খায়, অথচ এই করোনার আঘাতে কাজ করতে পারছেন না, তাদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন কিছু খাবার। এই মানুষগুলো কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় এমন সাহায্য চান না। তখন নিজের গায়ে খাটা মজুরি দিয়ে আপনাদের আকাশছোঁয়া দামের পণ্য কিনেই ক্ষুধা নিবৃত করেন। কিন্তু এখন এমনই পরিস্থিতি, গায়ের শক্তি নিয়েও তারা অসহায়। তারা কাজে যেতে পারছেন না।  এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোই ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা।   

তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা তো প্রতিবছর রফতানি আয়ের বড় অঙ্কের হিসাব দিয়ে আসছেন। তারাও তো এগিয়ে আসতে পারেন এই সাধারণ মানুষের সহায়তায়। বিশেষ করে মেডিক্যাল অ্যাটায়ার যারা তৈরি ও আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করেন, তারা এখন আমাদের চিকিৎসকদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই বানিয়ে দিতে পারেন। স্বাস্থ্যসম্মত মাস্ক সরবরাহ করতে পারেন সাধারণের মাঝে।

অথচ সবকিছুর জন্যই আমরা তাকিয়ে রয়েছি সরকারের দিকে।  বড় বড় করপোরেটের বড় বড় আয়ের কারণেই কিন্তু মোটের ওপর যে গড় হিসাব দাঁড়ায়, তার ভিত্তিতে মানুষের গড় আয় নির্ধারিত হয়। সে হিসাব থেকেই আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশের দিকে ধাবিত। সাধারণের আয় কিন্তু কমই বেড়েছে।  আর তাদের যে ক্রয়ক্ষমতা, তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাধ্য হয়ে কেনা ছাড়া কিছুই নয়।  তাছাড়া মধ্য আয়ের তকমা সরকারকেও দিয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। দৈব-দুর্বিপাকে চাইলেই বিদেশি সাহায্য চাওয়া যায় না। অতীতে আমরা বলতাম হাতপাতা। ব্যঙ্গ করে বলা হতো ভিক্ষার ঝুলি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নে এই হাতপাতা যাতে না লাগে সেটাই ছিল। আর তার সেই স্বপ্নপূরণের পথে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  সফলও হচ্ছেন। তাকে যেন এই দৈব-দুর্বিপাকে ফের বিদেশের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সেটা দেখাও আপনাদেরই দায়িত্ব।

সরকার ভীষণরকম ব্যবসাবান্ধব। আপনাদের সম্মানকে উচ্চে তুলে ধরতে সিআইপি’র মর্যাদা দিয়ে আসছেন, রাষ্ট্রকে কর দেওয়া আপনাদের দায়িত্বের অংশ।  সেই কর দেন বলে সরকারপ্রধান নিজ হাতে আপনাদের পুরস্কৃত করেন, সম্মানিত করেন।

তাই বলছি, রাষ্ট্রীয় এই সংকটকালে আপনাদেরই দাঁড়ানো উচিত সরকারের পাশে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু যখনই সুযোগ পান কথাগুলো বলেন। অতীতের বাংলায় ধনী মানুষের জনহিতৈষী কাজের কথা তুলে ধরে, স্কুল কলেজ নির্মাণ ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে এই সময়ের ধনীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

অতীতের ধনীরা, ফিলানথ্রপিস্টরা কেউ অবশ্য ধনকুবের ছিলেন না।  তাদের সিঙ্গাপুরে সেকেন্ড হোম, কানাডায় থার্ড হোম ছিল না।  সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ছিল না।  সুতরাং দেশের মধ্যে যতটুকু ভালো থাকা যায়, সেটুকু থেকেই বাকিটুকু তারা দেশের সেবায়, জনগণের সেবায় ব্যয় করেছেন।  আপনাদের সেকেন্ড হোম থার্ড হোম থাকুক, তাতে আপত্তি নেই।  তারপরেও তো থাকে কিছু বাকি! সেটুকু এই জনহিতৈষণায় ব্যয় করুন।  আমরা যেন আজও উচ্চারণ করতে পারি—দেশে এখনও রয়েছে অনেক ফিলানথ্রপিস্ট।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।  

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ