মানুষের মিছিল দেখছি। দৃশ্যমাধ্যমগুলোতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রাম থেকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর দিকে ছুটছে মানুষ। কেন ছুটছে? জীবিকার প্রয়োজনে। পুলিশ, সেনাবাহিনীর সাধ্য নেই তাদের আটকানোর। গণপরিবহন বন্ধ। তারপরও হেঁটে রওনা হয়েছেন তারা। তারা ফিরছেন উদ্বিগ্ন হয়ে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার কথা তারা ভাবছেন না। হোম কোয়ারেন্টিন কী? এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। স্যানিটাইজার ব্যবহারও তারা আশ্বস্ত করতে পারেনি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা শারীরিক দূরত্ব নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই তাদের। এখন তারা ভাবছেন মাসের বেতন পাওয়া যাবে কিনা, কাজ থেকে নাম বাদ পড়লো কিনা? এই ছুটে আসা মানুষদের সিংহভাগই পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিক। পোশাক শ্রমিকদের প্রসঙ্গ এলেই সাধারণভাবেই আমাদের কাছে এক শোষণ প্রক্রিয়ার দৃশ্য ভেসে আসে। এই দৃশ্য শুধু পোশাক কারখানার মধ্যেই সীমিত নেই। শ্রমিকদের বাসস্থান, খাবার ও কাজে আসার বাহন বা পথের মাঝেও রয়েছে সেই শোষণের প্রভাব।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। বিজিএমইএ সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সময় নিলো। সরকার ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ালো। বিজিএমইএ তার সদস্যদের ছুটি বাড়ানোর কোনও প্রস্তাব রাখলো না। বরং বলা হলো কারখানায় শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করলে সদস্যরা কারখানা খুলতে পারবেন। কারখানায় না হয় মালিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন, কিন্তু শ্রমিকরা গ্রাম থেকে যে প্রক্রিয়ায় ফিরছেন, সেখানে কি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই? কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার কোনও শঙ্কা নেই, এমন বাহন ও জনসমাগম ছাড়াই কি তারা ফিরছেন? কাজের পর তারা যে বাসস্থানটিতে ফিরবেন, সেখানকার ঝুঁকি মুক্ত করবেন কী করে? পোশাক শ্রমিকরা শহরের বস্তি এলাকা বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকেন। মেস বা বাড়িতে দশজনেরও বেশি একসঙ্গে থাকেন। সেখানে টয়লেট, খাবার তৈরির জায়গাও একটি। কে বা কারা সেখানে কোথা থেকে আসছেন, তা নিয়ন্ত্রণেরও উপায় নেই। শ্রমিকরা কারখানায় যাওয়া আসা করতে হয়তো গণপরিবহন ব্যবহার করবেন বা হেঁটে যাবেন। সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারবেন কতটা? এই বিষয়গুলো বিজিএমইএ’র ভাববার প্রয়োজন ছিল।
সরকার যখন সরকারি ছুটি দিলো, তারপর থেকে এ পর্যন্ত বিজিএমইএ-কে স্পষ্ট ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। তারা নিয়মিতভাবে অর্ডার স্থগিত বা লোকসানের অঙ্ক জানিয়ে আসছে। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন কবে দেওয়া হবে। বেতন দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে দেওয়া। শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা নিয়েও কোনও কথা বলেনি বিজিএমইএ। অর্ডার বাতিল হওয়ার খবরগুলো গণমাধ্যমে চলে আসায় গ্রামে বসে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। ভয় তৈরি হয়েছে চাকরি হারানোর। সেই সঙ্গে পোশাক কারখানার বেতন যেমন দশ তারিখের মধ্যে সাধারণভাবে দেওয়া হয়, সেই তাড়াও কাজ করছে শ্রমিকদের মধ্যে। ৫ এপ্রিলের মধ্যে কারখানায় হাজিরা না দিলে চাকরি চলে যেতে পারে, বেতনও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের ছুটে আসার মূল রহস্য এটাই। তাদের ছুটে আসা দেখে তাদের নিয়ে হয়তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি আমরা। কিন্তু যে কভিড-১৯, হোম কোয়ারেন্টিন বা স্যানিটাইজারের অনুবাদ জানে না, তাদের এই আচরণের জন্য মালিক বা মালিক সংগঠন দায়ী। তবে সবাইকে গড়ে গালমন্দ করা অনুচিত হবে। বেশ কয়েকজন মালিকের কথা জানি, যারা তাদের শ্রমিকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছেন নিয়মিত। তাদের শ্রমিকদের বেতন, চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না। কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন, তাদের সংগঠনকে বলা হয়েছিল কমপক্ষে দশ লাখ টাকা করে মালিকদের কাছ থেকে নিয়ে শ্রমিকদের জন্য একটা তহবিল করা হোক। কিন্তু মালিক সংগঠন সাড়া দেয়নি। সরকার রফতানিমুখী শিল্পকে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেবে। ৮৬ শতাংশ অংশীদার হিসেবে পোশাক মালিকরা এর সিংহভাগ পাবেন। কিন্তু সেই প্রণোদনার কতটুকু পৌঁছবে শ্রমিকের হাতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না মিললে কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই বিপজ্জনক সময়ে কারখানামুখী মানুষের ঢল আটকানো যাবে না। শুধু বিজিএমইএ নয়, বিকেএমইএসহ সকল সংগঠনকে এই মুহূর্তে শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ এই শ্রমিকরাই ব্যক্তিগত হিসেবে তার, তাদের এবং রাষ্ট্রের সচ্ছলতার হাতিয়ার।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি