X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনা মহাসংকট পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির গতিপথ

এস এম মারুফ
১৩ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৪০আপডেট : ০৫ জুন ২০২০, ১২:৩৫

এস এম মারুফ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে যখন করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়, তখন হয়তো অনেকের ধারণার বাইরে ছিল যে, এই ভাইরাস এত ভয়ংকরভাবে পুরো বিশ্বকে আক্রমণ করতে পারে এবং বিশ্বরাজনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ৭ মার্চ ২০২০ তারিখে। আক্রমণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মার্চ মাসের ১১ তারিখে কোভিড-১৯-কে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। যে রাষ্ট্রগুলো বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল এবং উন্নত বিশ্বের ধারক-বাহক, সে রাষ্ট্রগুলোই আজ বেশি বিপর্যস্ত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও ক্ষমতা সবই আজ করোনাভাইরাসের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ একসময় থেমে যাবে। কিন্তু কী রেখে যাবে তা এখনই অনুমান করা বেশ কঠিন। তবে এটি বলা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তনগুলো ভালো এবং খারাপ-দু’রকমই হতে পারে। পরিবর্তন আসতে পারে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারে। হ্যান্ডশেক কিংবা কোলাকুলি করার চিরাচরিত দৃশ্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসতে পারে। মানুষ হয়তো করোনাপরবর্তী সময়ে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা মানুষের নিত্যদিনের চিন্তাজগতে জায়গা করে নিচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসেবে মানুষের মাঝে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে উঠবে। ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলো তাদের স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে বরাবরই বেশ গর্ব করতো।

করোনাভাইরাস তাদের সেই অহমিকা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি দেশ তাদের স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। মানবজাতির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রথাগত নিরাপত্তা যে সবসময় যথেষ্ট নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। তাই প্রথাগত নিরাপত্তা ধারণার বাইরে অ-প্রথাগত নিরাপত্তা হিসেবে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিটি দেশের জাতীয় নীতিতে পূর্বের চেয়ে অধিক গুরুত্ব পাবে। জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রগুলোর স্বাস্থ্য নীতিতে ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। 

কোনও সন্দেহ নেই এই মরণব্যাধি বিশ্ব অর্থনীতিকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনিশ্চিত এবং দোদুল্যমান অর্থনীতির প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিসহ একটি দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর পড়বে। করোনা পরবর্তী বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাইবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি ইতোমধ্যে মন্দার কবলে পড়ে গেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের আশংকা, এই মন্দা ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। এই বিপর্যয় কাটাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কমপক্ষে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন বলে মনে করেন আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। ৮০টি উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যে আইএমএফের কাছে জরুরি ভিত্তিতে আপৎকালীন তহবিল চেয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহায়তা তহবিল সাময়িক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করলেও দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়াবে। স্থায়ীভাবে এই বিপর্যয় থেকে বের হতে হলে দেশগুলোকে আগ্রাসী এবং টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের উৎপাদনব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ডিসেম্বর, ২০১৯ পূর্ববর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা বেশ কঠিন কাজ হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া তদারকি করতে হবে।     

করোনা মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের প্রধান রফতানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পে ইতোমধ্যে বিপর্যয় শুরু হয়েছে। ২৮ মার্চ ২০২০ তারিখ পর্যন্ত ৩৯০০ পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়েছে এবং ৩৬৯ কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছেন বিদেশি ক্রেতারা। দেশের হোটেল ও পর্যটন ব্যবসা এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা—এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সারাদেশের স্থবিরতায় অর্থনৈতিকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত সরকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই। দেশের দৈনিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কাটা এসে পড়ছে। অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এর প্রভাব রাজনীতিসহ দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর পড়বে।  

করোনা মহাবিপর্যয়ের প্রভাবে বিশ্বরাজনীতির দ্বন্দ্বমূলক অবস্থার পরিবর্তন হবে এরকমটা আশা করা না গেলেও, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গতিপথ পরিবর্তন হবে এমনটা ধারণা করা যায়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রবাহ পাশ্চাত্য থেকে ক্রমান্বয়ে প্রাচ্যের দিকে ধাবিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন থেকে চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের যে পরিবর্তন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, তা আরও ত্বরান্বিত হবে। কারণ আমেরিকার জনগণ বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাদের বিশ্বাস হারিয়েছে। অন্যদিকে চীনের জনগণ এক্ষেত্রে তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রেখেছে। আবার এই মহাদুর্যোগকালে পাশ্চাত্যের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে চীনের আলিবাবা আফ্রিকার ৫৪টি দেশে বিপুল পরিমাণ মাস্ক ও করোনাভাইরাস পরীক্ষার সরঞ্জামাদি পাঠিয়ে আপাতত তার দেশকে বৈশ্বিক নেতৃত্বে এগিয়ে রাখল। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো এই মহাসংকটে তাদের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা দ্রুত ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ব ক্ষমতায় এককভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যে অপর্যাপ্ত কোভিড-১৯, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে, এমনকি আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পক্ষেও এককভাবে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। করোনাপরবর্তী বিশ্বে আমেরিকার শরীর থেকে পরাক্রমশীল রাষ্ট্রের তকমা ধীরে ধীরে খসে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বড় সংকট কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদ বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে আসবে। বিশ্বায়নের দাপুটে আচরণে জাতিরাষ্ট্র কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। করোনাভাইরাস আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে যতটুকু সচেতনতা দেখিয়েছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে, জাতিরাষ্ট্র থাকা না থাকা নিয়ে চলমান বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং জাতিরাষ্ট্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে।

এই মহাসংকটে ইউরোপীয় ইউনিয়নও জোটগতভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো বরং একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করা এবং নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বেশি ব্যস্ত ছিল। ইতালিও এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা পায়নি। করোনা মহাসংকট এটি দেখিয়েছে, বড় বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য নিজ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তিমত্তার ওপরই নির্ভর করতে হবে। একইসঙ্গে দুর্যোগকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদিসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সরবরাহের ক্ষেত্রে উন্নত রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভঙ্গুরতা এই সময়ে বের হয়ে এসেছে। এসব দিক বিবেচনায় বলা যায়, রাষ্ট্রনেতা এবং সরকারপ্রধানরা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের দিকে পূর্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ