X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কী শিক্ষা দিলো?

আজিজুল পারভেজ
২০ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৪৪আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২০, ১৩:৫৯

আজিজুল পারভেজ গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দুই জনই বিশিষ্ট। স্বাভাবিকভাবে দুই জনের জানাজায় হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সময়টা যে অস্বাভাবিক। করোনা প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে সবাইকে ঘরে থাকার আদেশ জারি হয়েছে। বলা হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে। বিশ্বে অনেক মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জামাতে ফরজ নামাজ পড়াও বন্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত এক বিশিষ্টজনের জানাজার তেমন কোনও আয়োজনই হয়নি। আর আরেকজনের জানাজা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে। অনেকেই গণমাধ্যমে এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত। দেশে করোনাভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
প্রয়াত দুই জনের একজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌঁসুলি, দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী সিরাজুল হকের স্ত্রী জাহানারা হক। তিনি শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) দিবাগত রাত পৌনে ৪টায় ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এ পরিচয় ছাড়াও জাহানারা হকের আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুল ও কলেজের সাবেক শিক্ষিকা। তার পৈতৃক পরিচয়ও গৌরবের। অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের প্রধান আবদুস সামাদের মেয়ে এবং বিবিসি-খ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদের বোন ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. আশফাকুস সামাদ বীর-উত্তমের ফুফু। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের পর পর দু’বারের আইনমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের এমপি আনিসুল হকের প্রাণপ্রিয় মা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে মরহুমার জানাজা পারিবারিকভাবে এবং সীমিত পরিসরে সম্পন্ন করা হবে বলে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে অনুসারে শনিবার বাদ জোহর বনানীর ১১ নম্বর রোড সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামে মসজিদে পারিবারিকভাবে ও সীমিত পরিসরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মারা যাওয়া অপর বিশিষ্টজন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির জোবায়ের আহমদ আনসারী। তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় (১৭ এপ্রিল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মার্কাসপাড়ায় নিজের বাসায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। শনিবার সকাল ১০টায় আনসারীর প্রতিষ্ঠিত সরাইলের জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসায় তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। মানুষের ভিড় মাদ্রাসার সীমানা ছাড়িয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গিয়ে ঠেকেছিল। আনসারী ওয়াজের মাধ্যমে সারা দেশে জনপ্রিয় ছিলেন। স্বাভাবিক সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে তার জানাজায় আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হতেন নিঃসন্দেহে। কোনও একজনের প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা থাকতে পারে। এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু সময়টা তো বুঝতে হবে।

করোনা সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশেও প্রায় চার সপ্তাহ থেকে সবকিছু বন্ধ। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। সভা, সমাবেশ, জমায়েত আইনত নিষিদ্ধ। এমনকি মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ও সীমিত করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে গত ১১ এপ্রিল। করোনা আক্রান্ত হয়ে বাঞ্ছারামপুরের এক ব্যক্তি এবং করোনার আলামত নিয়ে দুই নারীর মৃত্যুর পুরো জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে একটি জানাজার নামাজের আয়োজন হলো কোন যুক্তিতে? প্রশাসনই বা এই বেআইনি আয়োজন করার সুযোগ দিলো কীভাবে?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানাজার নামাজ আয়োজন থেকে বিরত রাখা কিংবা সংক্ষিপ্ত পরিসরে জানাজা সম্পন্ন করার ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে ওসি মো. শাহাদাৎ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা চিন্তাও করতে পারিনি  এত লোক হবে। লোকজন আসতে শুরু করার পর আমাদের আর কিছু করার ছিল না।’

মাওলানা আনসারীর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঠেকাতে ব্যর্থতার দায়ে রবিবার সরাইল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ও সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর। কমিটিকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। একই ঘটনায় ব্যর্থতার জন্য সরাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নুরুল হককেও পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

রোগ-বালাইয়ের ডর ভয় কারও মধ্যে না-ই থাকতে পারে। কিন্তু রোগাক্রান্ত হয়ে সেই রোগ অন্যকে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকলে ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশনা ইসলামেই আছে। আর জানাজার নামাজ তো সবার জন্য পড়া ফরজ না। কয়েকজন পড়লেই হয়। কিন্তু এই যে জমায়েত করে পড়া হলো, এর মাধ্যমে যদি কারও মধ্যে রোগ ছড়ায়; এবং তার মাধ্যমে যদি তার ঘরে থাকা পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানের মধ্যে রোগটা ছড়িয়ে পড়ে; তাহলে এই দায়িত্বটা কে নেবে?

আনিসুল হক তার মায়ের মরদেহ নিজের এলাকায় নিয়ে গেলে কি জানাজায় হাজার হাজার লোক হতো না? হতো। কিন্তু আনিসুল হক এটা করতে গেলেন না কেন? তিনি তার মায়ের জানাজায় সবাইকে শরিক হতে বললেন না কেন? বলেননি কারণ, তিনি যে শিক্ষা পেয়েছেন, সেই শিক্ষায় অন্যের ক্ষতি করা পাপ। আর একজন থেকে অন্যজনে রোগ ছড়ানোর যেখানে আশঙ্কা; এর মাধ্যমে সমাজের বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে যেখানে; সেখানে সমাজের সেই ক্ষতি আনিসুল হক সজ্ঞানে করতে দিতে পারেন না। এর নামই তো শিক্ষা। শুভ বোধ। কেবল আনিসুল হক কেন, যেকোনও শুভবোধসম্পন্ন, সুশিক্ষিত মানুষই এটা করতে দিতে পারেন না।

প্রশ্ন হলো সব জায়গা থেকে কি এই সুশিক্ষা, শুভবোধ জাগানোর শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে? জাতির প্রতিটি মানুষ কি সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে? কী শিখছি আমরা? আমাদের শিক্ষাবিদরা, আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষামন্ত্রীরা কী জবাব দেবেন?

আমরা জানি আমাদের দেশে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চালু হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থা বহু ধারায় বিভক্ত। মোটা দাগে তিনটি ধারা দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বাংলা মাধ্যম, বিদেশি ইংরেজি মাধ্যম আর মাদ্রাসা শিক্ষা। মাদ্রাসা শিক্ষায় আবার রয়েছে কয়েকটি ধারা। এরমধ্যে মোটা দাগে দুইটি ধারা বিদ্যমান। একটি এবতেদায়ি শিক্ষা, যেটি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে চলে। অন্যটি কওমি শিক্ষা। এটি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসরণে চলে। অঞ্চলভিত্তিক ৮টির অধিক বোর্ডের অধীনে এগুলো চলে। প্রয়াত জোবায়ের আহমদ আনসারীদের রাজনীতির ‘ঢাল-তলোয়ার’ ছিল এই কওমি মাদ্রাসা ও তাদের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় আছে। সব দল মিলেই গঠন করেছে হেফাজতে ইসলাম। এরা রাষ্ট্রের নারী নীতি পাল্টে ফেলে। এরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জড়ো হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের হুংকার দেয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় শক্তি এই ধর্মান্ধ অপশক্তিকে দমনের কোনও চেষ্টা করে না। বরং দুধকলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। যার পরিণামে আপস অনিবার্য হয়ে পড়ে। তার খেসারত জাতিকে দিতে হয়। এদের চাপেই বদলে যায় জাতীয় শিক্ষাক্রম। বাদ পড়ে ‘হিন্দু লেখকদের’ লেখা।

এই কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কি শিক্ষা দেওয়া হয়, তার খোঁজ কখনও কেউ নেয়নি। সেই সুযোগ কওমিপন্থীরা রাষ্ট্রকেও দেয়নি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ না হয় না-ই থাকলো, রাষ্ট্রের মনিটরিংও কি থাকবে না? মনিটরিংয়ের সুযোগও দেয়নি কওমি সংশ্লিষ্টরা। এত সব সত্ত্বেও তারা ঠিকই তাদের দাবি আদায় করে নিয়েছে। সরকার কওমি মাদ্রাসার মাস্টার্সের সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে বছর তিনেক আগে। অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষার একজন শিক্ষার্থী যেখানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, ৮ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা তথা জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স—এই এতগুলো পরীক্ষা দিয়ে তারপর যে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে সনদ অর্জন করে, সেই সনদের সমতুল্য মর্যাদা পেয়ে যাবে একজন কওমি শিক্ষার্থীও ওই মানের পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও।

কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এতদিন, রাষ্ট্র সেই খোঁজ খবর না নিলেও এখন খোঁজ নেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে করি। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে আর যা-ই শিক্ষা দেওয়া হোক না কেন, কোন বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা যে দেওয়া হচ্ছে না, সেটা করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো।

আমাদের রাষ্ট্র এই জরুরি কাজটি করবে কিনা জানি না। এ অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রার্থনা করতে পারি; হে আল্লাহ, মানুষকে রক্ষা করো। মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত করো। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করো। মানবিকতা জাগিয়ে তোলো।

 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ