X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

শুধু করোনা নয়, চুরির মহামারিও ঠেকাতে হবে

এরশাদুল আলম প্রিন্স
২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০৩আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০৮

এরশাদুল আলম প্রিন্স এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদের নাম করোনাভাইরাস। আণবিক শক্তি, পারমাণবিক অস্ত্র, তেল, ভূ-রাজনীতি সবই ভাইরাসের কাছে ম্লান। মহামারি বিশ্বে নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে মহামারি বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত হেনেছে। স্থানিক বা আঞ্চলিক মহামারির ফিরিস্তি দিলে অনেক দেওয়া যায়। সেসব আমাদের কমবেশি জানাও আছে। কিন্তু এবারের মতো কোনও মহামারি পুরো পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল কিনা জানা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে অভিহিত করেছে।
মহামারির মূল শিক্ষা অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলেই বিপদ। ইতালি গুরুত্ব দেয়নি, গুরুত্ব দেয়নি স্পেন, আমেরিকা। আমেরিকাতে মৃতের সংখ্যা প্রায় অর্ধ লক্ষ। ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স—এই তিন দেশে আরও ৬৫ হাজার। কাজেই অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে এখনও করোনা সেভাবে আঘাত হানেনি। আশা করি যাতে সেই কঠিন আঘাত আমাদের ওপর না আসে। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা, ফ্রান্স বা চীনের সাফল্য বা ব্যর্থতা থেকে কি আমরা শিক্ষা নেবো না?

বাংলাদেশ আজ মহামারির দ্বারপ্রান্তে। পাড়া-মহল্লায় আজ ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশে সংক্রমণের হার অন্যান্য বিপর্যস্ত দেশের চেয়ে কম নয়। বরং বেশি। পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। যদিও মোট মৃত্যু বা আক্রান্তের সংখ্যা এখনও কমই রয়েছে। কিন্তু তারপরও কোনও মৃত্যুই আকাঙ্ক্ষিত নয়।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মহামারির আরেকটি নিত্য অনুষঙ্গ চুরি ও লুটপাট। যেকোনও দুর্যোগের সময় দেশের সরকার ত্রাণ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু মুনাফাখোর ও ত্রাণ লুটপাটকারীরা এ সময়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। তারা সোৎসাহে ত্রাণ লুটপাট ও মজুতদারের খাতায় নাম লেখায়। বাংলাদেশে এটা দুর্যোগের সহগামী বিপদ। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।

করোনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে। আয়-রোজগার, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ। দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের জীবন দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, জরুরি ও তথ্য সেবার হটলাইনে শুধুই খাবারের অনুরোধ! সরকার জরুরি ও তথ্য সেবার জন্য দুটি হটলাইন চালু করেছে। সেখানে তথ্য ও জরুরি চিকিৎসা সেবার চেয়ে খাদ্যের জন্যই বেশি ফোন এসেছে। দিন যত যাবে এটাই হবে মহামারিকালের বাস্তবতা। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। মানুষ মহামারি অথবা মৃত্যু মেনে নিতে পারে, কিন্তু ক্ষুধা মেনে নিতে পারে না। সুতরাং, মানুষের এই কঠিনতম দিনে যারা ক্ষুধার্তের ত্রাণ তছরুপ করে, তেল নিয়ে তেলেসমাতি করে, চাল নিয়ে চালবাজি করে—ক্ষুধার্ত মানুষগুলো কি তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে?

সরকার সরকারের কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ সরবাহের ঘোষণা দিয়েছেন। সে ত্রাণ সরকারি গুদাম থেকে খালাসও হচ্ছে। কিন্তু এখন সে ত্রাণ যদি সরকারি গুদাম থেকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের চৌকির তলায় যায়, সে দায় কার? দেশজুড়ে ত্রাণ সরবরাহ শৃঙ্খলের জায়গায় জায়গায় ওঁত পেতে থাকা ফড়িয়া ও চোরদের ওপর চোখ রাখা কীভাবে সম্ভব? চোরের খনি যে এখনও খালি হয়ে যায়নি। একদিকে চাটার দল চাটে, আরেকদিকে চোরের দল চুরি করে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল। মহামারিকালে বঙ্গবন্ধুকন্যাকেও আগে থেকেই এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

একটি মহামারিতে সরকারকে তিন ধরনের কাজ করতে হয়। প্রথম কাজ মহামারি যাতে না ছড়ায় ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু মহামারি এখন দেশের সর্বত্রই কমবেশি ছড়িয়ে গেছে। কাজেই এখন কাজ হচ্ছে এটাকে সীমিত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। মহামারি যাতে আর না বাড়ে, সেজন্য যা করার করতে হবে। লকডাউনের সিদ্ধান্ত সেজন্যই নেওয়া হয়েছে। লকডাউন বা ঘরে থাকার এ সময়ে মানুষ যাতে ঘরেই থাকতে পারে, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। যারা পেরেছেন কয়েক দিনের খাদ্যপণ্য কিনে রেখেছেন। কিন্তু সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। সরকার সেজন্যই ত্রাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কম মূলে ভোগ্যপণের সরবরাহের ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে। কিন্তু সেখানেই হানা দিয়েছে ওই ত্রাণ চোররা। সরকার ত্রাণের ব্যবস্থা করে যেমন প্রশংসার কাজ করেছে, এবার এই ত্রাণ চোরদের শায়েস্তা করে বাকি কাজ সমাধা করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক দুই/চারটাকে ধরে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেই ওরা পিছপা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এদের বিরুদ্ধে তৎপর হতে হবে। এদের জন্য আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও ওদের চিরদিনের জন্য ত্যাজ্য করতে হবে। এই মহাদুর্দিনে যারা মানুষের তেল-নুন চুরি করে মজুত করে, লুটপাট করে, তারা শুধু মানুষেরই শত্রু নয়, দেশের শত্রু ও তারাই আসল সরকারবিরোধী। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য এরাই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী এদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এখন সংশ্লিষ্টদের এদের বিরুদ্ধে আইন ও বল প্রয়োগ করতে হবে।

যেকোনও দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় সরকারকে আরও দুইটি কাজ যুগপৎ করে যেতে হয়। এ দুটি কাজই কঠিন। প্রথমত, মহামারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, মহামারির চিকিৎসা, মহামারিকালীন ত্রাণ ও মহামারি পরবর্তী পুনর্বাসন, যা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশে মহামারির সময়ে দ্বিতীয় আরেক ধরনের মহামারির প্রকোপ দেখা দেয়। ভোগ্যপণ্যের বাজারে একটা ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী আগুন লাগিয়ে দেয়। দাম বাড়িয়ে সারা জীবনের মুনাফা মহামারির সময়েই উসুল করে। পণ্য মজুত করে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং পরে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। মহামারিকালীন দুর্ভিক্ষের শুরু এদের হাত ধরেই।

একদিকে ভোগ্যপণ্য সরবরাহে একটি চক্র বারোটা বাজায়, আরেকদিকে আরেকটি চক্র খাদ্য সংকট মোচনে সরকারের দেওয়া ত্রাণ সহায়তায় ভাগ বসায়। গণমাধ্যমে দেখি এই চক্র ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে। বক্সখাটের নিচে তেল, বৈঠকখানায় চাল এদের উপস্থিতি জানান দেয়। ফলে ত্রাণ যাদের উদ্দেশ্যে সরকারি গুদাম থেকে বের হয়েছে, সেই গরিব মানুষের হাতে পৌঁছায় না। যায় অন্যের পেটে। ফলে ইতিহাস বলে এই দুই কারণেই মূলত মহামারির সঙ্গে দুর্ভিক্ষ হানা দেয়। গরিব মানুষ তখন না খেয়ে মরে, এমনকি খাদ্য চলে যায় মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে। শুধু তাই নয়, এ সময়েই দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যায়, যার রেশ কাটাতে কোনও কোনও দেশের বহু বছরও লেগে যায়। একদিকে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ, আরেকদিকে ত্রাণ চোরদের ভোজবাজি—এ দুয়েরই অবশ্যম্ভাবী ফল দুর্ভিক্ষ। ফলে সরকারকেই ভাইরাসের মহামারি ঠেকানোর পাশাপাশি চুরি ও লুটপাটের মহামারিও ঠেকাতে হয়।

মহামারিকালের সরকারের তৃতীয় আরেকটি চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা। লুটপাট ও অস্ত্রবাজি ঠেকানোর কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হয়। অতি সম্প্রতি আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার হিড়িক পড়েছে। অস্ত্র কিনতে দোকানের সামনে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন পড়ছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনে রাখছে। তারা ভাবছে, করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ, ফলে লুটেরাদের উৎপাত বাড়বে। তাই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্র কিনে রাখছেন তারা। অস্ত্র কেনার জন্য যে ভিড় লেগেছে, সাধারণ সময়ে আইফোনের নতুন সিরিজ কেনার জন্যও এতো ভিড় হয় না। ইতালিতে তো লুটপাট আরও আগেই শুরু হয়েছে। নাইজেরিয়ায় মহামারির কারণে ত্রাণ ডাকাতির সময় দস্যুদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭ জন। বাংলাদেশেও ত্রাণ বিতরণের সময় হানাহানি হয়েছে। এসবই মহামারির অনুষঙ্গ। এ বড় কঠিন সময়। এসব বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই সজাগ থাকতে হবে। সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি থাকতে হবে। সরকার, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। দেশে সাংবিধানিক জরুরি অবস্থা নেই সত্য, কিন্তু এখন কার্যত জরুরি অবস্থাই (ডিফ্যাক্টো ইমারজেন্সি) চলছে। সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। দুর্যোগের সময় দেশের সব মানুষকেই মহাসতর্ক থাকতে যুগপৎ ভাইরাস ও চুরির মহামারির বিরুদ্ধে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ