X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য আগে না অর্থনীতি আগে?

ড. জহির আহমেদ
২৯ এপ্রিল ২০২০, ১৫:৩৯আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১৫:৪১

ড. জহির আহমেদ সামাজিক বিজ্ঞানে মহামারি কোভিড-১৯ নিয়ে বর্তমানে যে প্রধান বিতর্কটি রয়েছে তা হলো—এটি কি পুঁজিবাদের একটি দুর্যোগ? যদি দুর্যোগই বলি, তবে নৃবিজ্ঞানসহ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানে অপরাপর দুর্যোগ (যেমন: এইডস, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু রোগ) নিয়ে যে গবেষণাগুলো আমরা লক্ষ করি, তার সঙ্গে ভিন্নতা কোথায়? ২০০৬ সালে জর্জিয়া হয়ে এলাবামা যাচ্ছিলাম; সমুদ্র কোস্ট হয়ে যাওয়ার পথে দু’ধারে এবড়োখেবড়ো রাস্তা, বিধ্বস্ত গাছ-গাছালি আর সমুদ্রের ওপর দুমড়ে-মুচড়ে পড়া ক্যাসিনোগুলো চোখে পড়লো। পরে জানলাম, হ্যারিকেন ক্যাটরিনার তাণ্ডবে এই অবস্থা। শক্তিধর আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হয়নি জাতীয় দুর্যোগের এই ক্ষতিকে সহজে বিনির্মাণ করা। আমেরিকান বন্ধু ফোঁড়ন কেটে আমাকে বললো, ‘তোমরা দুর্যোগের বিশেষজ্ঞ; তোমার দেশে এটি পুনর্গঠন করতে এত সময় লাগত না।’ সে দুর্যোগ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
আজ আমেরিকা মোকাবিলা করছে স্বাস্থ্য দুর্যোগকে। সেই ত্রাহি অবস্থা। তবে হ্যারিকেন ক্যাটরিনাকে বন্যাজনিত দুর্যোগ বলা হয় না। এটি ছিল সামাজিক দুর্যোগ। সেখানেও আমরা নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রণোদনা (মুক্ত বাজার, মুক্ত চলাচল, অর্থনীতিই প্রধান চালিকাশক্তি ইত্যাদি) দেখি ওই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য। বিশেষ করে তখন মুক্ত বাজার মুনাফা কেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রয়োগ দেখি। কিন্তু গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার অবদমিতই থেকে যায়। আগেভাগে তৈরি হওয়া সামাজিক অসমতা বহুগুণে বেগবান হয়; দরিদ্র প্রান্তিক মানুষগুলো আরও দরিদ্রতর হয়; ব্যক্তিকীকরণ সুদৃঢ় হয়; মুষ্টিমেয় মুনাফাভোগী ঠিকাদাররা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। একটা বড়সড় পাবলিক গোষ্ঠী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।

একালের সমাজ চিন্তক এডামস এই প্রবণতাকে ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ বলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক একটি লেখায় তিনি প্রশ্ন তোলেন, কোভিড-১৯ কি মহামারিজনিত দুর্যোগ? অপর তাৎপর্যপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নটি তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তা হলো এই—কেন এশিয়া উদ্ভূত ফ্লু-কে আমরা দুর্যোগ বলি? কেন অধিক মৃত্যুহারজনিত রোগ যেমন—হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিসকে আমরা দুর্যোগ বলবো না? আর কেনইবা কোভিড-১৯-কে দুর্যোগ বলি? এটি কি শুধু ট্র্যান্সন্যাশনাল বর্ডার অতিক্রম করে বলে এবং সে সুবাদে এটি ট্র্যান্সভাইরাস? কোনও কোনও সমাজবিজ্ঞানী ভাইরাসজনিত দুই ধরনের দুর্যোগের কথা বলেন—১) শারীরিকভাবে ভাইরাস এবং ২) এই ভাইরাসের কারণে সমাজ অর্থনীতিতে ভাইরাস। ডেভিড কাটজ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন এভাবে—আমাদের সামাজিক কোয়ারেন্টিনে না গিয়ে ‘সার্জিক্যাল কোয়ারেন্টিনে’ যেতে হবে, যাতে ভাইরাসকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা যায়। কারণ ভাইরাসকে আটকাতে হবে শরীরের ভেতরেই।

এটি সত্যি, এই ভাইরাস প্রাণঘাতী। কিন্তু অন্যান্য দুর্যোগের মতো আগেভাগে আক্রান্ত শরীরে জেঁকে বসে এবং মৃত্যুঝুঁকিকে ত্বরান্বিত করে। গবেষণা বলছে, যাদের এজমা রয়েছে, ডায়াবেটিস রয়েছে, যারা হৃদরোগে আক্রান্ত—তাদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমরা দেখছি এই ভাইরাসের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ সব দেশে একই রকম—কী উন্নত দেশ, কী ধর্মীয় তীর্থস্থান, কী ধনী গরিব, রাজপরিবার না শ্রমজীবী—কেউই বাদ যায় না।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা চলছে। প্রতীকী নয়, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। বাংলাদেশসহ সরকারপ্রধানরা এই যুদ্ধে একেবারে সম্মুখ সমরে চিকিৎসক ও অপরাপর সেবাকর্মীদের উৎসাহ দিচ্ছেন; প্রণোদনাও দিচ্ছেন। আবার কর্মে ‘অবহেলার’ কারণে চাকরি নট-ও করছেন। দেখা যায়, বাংলাদেশসহ উন্নত সব দেশেই মানসম্মত পিপিই’র অভাবে চিকিৎসক ও সেবা প্রদানকারীরা রেইন কোর্ট, বিন ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে এই সমরের অগ্রভাগে জীবন দিচ্ছেন। অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি তার একটি লেখায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন এবং তা হচ্ছে—পারমাণবিক যুদ্ধসহ সকল যুদ্ধে সকল মারণাস্ত্র জোগাড় করতে আমেরিকার কোনও বেগ পেতে হয় না। আর পাবলিকের এই পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসের সময় সুরক্ষিত মাস্ক, গ্লাভসের অভাব লক্ষ করি। কেন? অরুন্ধতীর সূত্র ধরেই বলি ‘হাই সেলুকাস’! শতাধিক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবী—বাংলাদেশে আক্রান্ত হচ্ছেন অনবরত; জীবন উৎসর্গও করেছেন দেশের জন্য। কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? এটি কি একতরফা ‘যুদ্ধ’ নয়? পুরো বিশ্বব্যবস্থাসহ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন এক অপ্রস্তুত ‘সেবা খাত’ তৈরি করেছে, তা দস্তুরমতো একটা মাইন ফিল্ড। এই মাইন ফিল্ডে আমরা সবাই হাঁটছি আর বেওয়ারিশ লাশের মিছিলে ধাবিত হচ্ছি, যেমন হচ্ছে মুনাফাভোগী অপরাপর দেশগুলোতে। করোনা সংকট নিয়ে কিছু সমাজবিজ্ঞানীর (যেমন—হারভে, লাতুর, অরুন্ধতী রায় এবং মিশেল ফুকোর লেখাজোখার সমসাময়িক প্রয়োগ) সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। এই লেখাগুলোর বেশিরভাগই নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়, যখন কিনা আমেরিকায় বিশেষত নিউইয়র্কে কোভিড-১৯ তাণ্ডব চালাচ্ছে। এখানে আমি কিছু তাত্ত্বিকের সূত্র ধরে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করব।

করোনা সংকটে জেনেটিকের সঙ্গে সামাজিক-রাজনীতির যোগসূত্র বুঝতে আমাদের এ যুগের ক্রিটিক্যাল সমাজ চিন্তক ব্রনো লাতুরের কাছে যেতে হয়। তিনি বলছেন, কোভিড-১৯ কি একটি ‘ড্রেস রিহার্সাল’ কিনা? তার মতে, ‘ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি পুরো জাগতিক অবস্থাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে, আর এর জন্য কোনোভাবেই দায়ী ওই ভাইরাস না; দায়ী হচ্ছে মানবতা’। লাতুরের মতে, ঢালাওভাবে সবাই দায়ী না। তারাই দায়ী, যারা কিনা আমাদের ওপর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা না করেই যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এই যুদ্ধের জন্য জাতি রাষ্ট্রগুলো একেবারে অপ্রস্তুত; ভুলভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে পরিমাপ করেছে তারা এবং যত খারাপভাবে পারা যায় সেভাবেই হিসাব কষেছে। কিন্তু এই ভাইরাসের রূপ বিভিন্ন, পরিবর্তনশীল এবং তাই এই যুদ্ধ ক্ষেত্রটিও বহুবিধ’—লাতুর যোগ করেন।

লাতুরের এই তির্যক পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা কী হতে পারে? আমার মতে, পুঁজিবাদের প্রাণকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্কই আমরা বাংলাদেশে অনুসরণ করছি, আর তা হলো উদারনৈতিক কৌশল। এই ‘দুর্যোগকে’ মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্য ও মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি জড়িত। স্বাস্থ্য আগে না অর্থনীতি তথা মুনাফা আগে? বস্তুত, এই প্রায়োরিটি-টি পুঁজির সম্প্রসারণের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী নৃবিজ্ঞানী ডেভিড হারভে। হারভে হাল আমলের পুঁজিবাদের দুটো রূপের কথা বলেছেন। প্রথমটির ক্ষেত্রে তিনি দেখেন যে, পুঁজিবাদ তার নিজের সম্প্রসারণে অভ্যন্তরীণ দ্বান্দ্বিকতায় জড়িয়ে পড়ে, আর এটি করে যুগপৎভাবে পুঁজির সঞ্চয়নের জন্য এবং পুঁজির সঞ্চালনের জন্য। দুটোরই উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়, কার্ল মার্ক্স যেমন বলেছেন, উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন আর বিনিয়োগের মাধমে। এ ধারা মূলত পুঁজিবাদের ধ্রুপদি ধারা। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভোগোলিক-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় নীতি এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল শ্রমবিভাজন।

হারভে মার্ক্সের এই চিরায়ত ব্যাখ্যাকে আরও বৃহৎ পরিসরে দেখতে চান—সেটি হলো সামাজিক পুনঃউৎপাদন (যেমন, গৃহস্থালি/সম্প্রদায়), বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিবেশগত পরিসরে। পুঁজিবাদের এই দ্বিতীয় রূপ বা ক্ষণগুলোকে মানুষের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, প্রয়োজন থেকে উৎসারিত—যার মধ্যে থাকে পরাজয়, মতাদর্শ, ক্ষতি, হতাশা এবং বিভিন্নতা। সোজা কথায়, হারভে সামাজিক গঠনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এটি বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, যা চিরায়ত পুঁজিবাদ থেকে পৃথক—শুধু অভ্যন্তরীণ শ্রেণি দ্বান্দ্বিকতার কথা বলে। হারভে কোভিড-১৯-কে দিয়ে পুঁজির সঞ্চয়নের গতিশীলতাকে বুঝতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই ভাইরাস বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান আমদানিকারক ও রফতানিকারক দেশ চীনের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত চীনের অর্থনীতির প্রভাব আমাদের বিচার করতে হবে।

বলে রাখা ভালো, উহান বিপর্যয় এবং দ্রুতগতিতে তুলনামূলকভাবে স্বল্প মৃত্যুহারের বদলে চীন তার শক কাটিয়ে উঠছে। উহানের লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রথম শিকার চীনের সঙ্গে দেরিতে আক্রান্ত দেশগুলো কি অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে? একটু পরের আলোচনায় আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দার্শনিক যুক্তির আলোকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারবো। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু চীনের সঙ্গে যুক্ত (বিশেষত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল সংক্রান্ত), ক্রমবর্ধমান কোভিড-১৯-এর ছোবলের মাঝেও আমাদের পোশাক ফ্যাক্টরিগুলো খুলতে চায় কেন? প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে মালিকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন এবং দুই দিন আগেও গাজীপুরের প্রশাসনের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্সে কিছু গার্মেন্টসে উৎপাদন সচল করে রাখার অনুমতি দেন। এবং তা করা হচ্ছে এই লকডাউনের মাঝেই। বিকেএমইএ/বিজেএমইএ’র সঙ্গে সরকারের এই অদৃশ্য সম্মিলন চোখে পড়ার মতো।

শ্রমিকদের শত শত কিলোমিটার পথ হাঁটিয়ে, গাদাগাদি করে ট্রাকে বা ভ্যানে করে এনে আমরা বলছি—‘এই এক অদ্ভুত জাতি; এরা সচেতন না; এরা লকডাউন মানে না, মাস্ক পরে না, সামাজিক দূরত্ব ও মানে না।’ যত সব ‘অজ্ঞ’ আর ‘অসভ্যতায়’ ভরপুর। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, ‘এই শ্রমজীবীরা’ কেন কোভিড-১৯-এর অই আচারগুলো মানতে চায় না? কে না বাঁচতে চায়? চাকরি রক্ষার জন্য শ্রমিকরা ঢাকায় তার কর্মস্থলে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অরুন্ধতী রায় এবং লাতুর দুই সমাজ চিন্তকই যেমন বলেছেন, ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরকার প্রধানদের এটি ‘যুদ্ধ’ নাকি অন্য কিছু? বাংলাদেশের শ্রমজীবী দরিদ্র শ্রেণির কাছে এই যুদ্ধ ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। একজন শ্রমিক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘করোনা ছোবলের আগেই ক্ষুধায় আমার মৃত্যু হবে। বেঁচে থাকার জন্য আমি ঘরের বাইরে যাবই।’ তাহলে অর্থনীতি আর স্বাস্থ্যের এই দ্বৈরথকে আমরা কীভাবে দেখব, বিবেচনায় আনব? বিষয়টি বাংলাদেশের বিষয় নয় শুধু, এর সঙ্গে বৈশ্বিক মুক্ত বাজারের যোগ রয়েছে, যার কথা একটু আগে আমরা হারভের মাধমে জানতে পেরেছি।

দেখা যাক, এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য ইউরোপীয় সরকারের কৌশল কী? দেখা যায়, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এই ভাইরাসের আক্রমণে লণ্ডভণ্ড। এদেশগুলো প্রথম দিকে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা দেখিয়েছিল। তাদের শংকা ছিল অর্থনীতির গতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জিডিপি-তে ধস নামবে। পূর্বে লাতুরের মাধ্যমে আমরা যেমন জেনেছি, এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে জৈবরাজনীতিক (বাইওপলিটিকস) পথ অবলম্বনের কারণেই এটি ঘটছে। তবে লাতুর যুক্তি দেন, কোভিড-১৯ আসলে পুরনো যুগের ‘রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন’। এটি তার মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর পুনরাবৃত্তি এবং তা হচ্ছে ‘পরিসংখ্যান’। এই পরিসংখ্যানের কারবার হচ্ছে জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনা। আর তা প্রকাশের ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃত্ববাদী রোগতত্ত্ব নিরূপণ বিভাগ (যেমন—বাংলাদেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআর)। লাতুর আরও বলেন, আমরা সমষ্টিগতভাবে জৈবরাজনীতির একটি ‘ক্যারিকেচার’ নিয়ে খেলা করছি।

এই জৈবরাজনীতি বিষয়টি নিয়ে ফরাসি সমাজ দার্শনিক মিশেল ফুকো অনেক আগেই বলে গিয়েছেন। জৈবরাজনীতি (বায়োপলিটিকস) নিয়ে ফুকোর ধারণাটি হলো—জনগণের শারীরিক ও রাজনৈতিক দেহ উভয়ের ওপরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খবরদারি করে। ফুকো জৈবরাজনীতিকে ‘ক্ষমতার একটি নতুন প্রযুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন (ফুকো, ১৯৭৮)। তিনি মধ্যযুগের রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতিকে তুলনায় আনেন। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে টিকা এবং ওষুধের বিকাশের ফলে কোনও নির্দিষ্ট জনসংখ্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলো, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার অসুখে মৃত্যু হবে নাকি হবে না তা নির্ণয় করা সম্ভব হলো। এটিই অপরিমেয় ক্ষমতা এনে দেয় রাষ্ট্রকে। এটি সম্ভব ছিল সিরিজ আকারের হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণকারী মেকানিজমের মাধ্যমে। জৈবরাজনীতি হস্তক্ষেপকে জনস্বাস্থ্য সমৃদ্ধির মাধ্যমে জায়েজ করে। কিন্তু ফুকো কখনও এটা বলেননি, জৈবপ্রযুক্তি স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেয় কিংবা এটি বলে যে, স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে সম্পদ বা অর্থনীতিরও সমৃদ্ধি হবে। অথচ করোনাকালে আমরা স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেবো কিনা তা মানব জাতির জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফুকোলডিয়ান জৈবরাজনীতিক ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা নিরসনে লাতুর সম্প্রতি একটা প্রস্তাব করেছেন। তার প্রস্তাব হলো জৈবরাজনীতিকে আমরা দুই অর্থে ব্যবহার করতে পারি—মডারেট অর্থে এবং রেডিক্যাল অর্থে।

সম্পদের উন্নতির জন্য স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হবে—এটি ফুকোর ব্যাখ্যা। কিন্তু কোভিড -১৯ কে মোকাবিলা করতে গেলে আমাদের আরও বেশি চরমপন্থা নিতে হবে, যা লাতুর বলেছেন। যদি আমরা জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেই এবং অর্থনৈতিক সম্পদকে অধস্তন হিসেবে ভাবি—তখনই জৈবরাজনীতির রেডিক্যাল রূপান্তর হবে। লাতুরের মতো করে বলা যায়, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে আমরা যা দেখছি তা হলো জৈবরাজনীতি। তবে লাতুরের ‘রিটার্ন অফ বায়োপলিটিকস’ (মধ্য যুগে ফেরত যাওয়া) অর্থে নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসে স্তেফেন (২০২০) নামক সমাজবিজ্ঞানী দাবি করেন আমরা বর্তমানে কোভিড -১৯-এ জৈবরাজনীতির রেডিক্যাল রূপ লক্ষ করি এবং তা ২০২০ সালেই জন্মলাভ করেছে। মরণব্যাধি ভাইরাসের উন্মত্ততা লক্ষ করে পশ্চিমা দেশগুলো পিছুটান দিয়েছে। তাই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টা একেবারে সামনে চলে আসে এবং রেডিক্যাল জৈবরাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

যেমন, আমেরিকা ও ব্রিটেনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দু’দেশই ডানপন্থী; সরকার প্রধানরা জানি দোস্ত। শুরু থেকেই দু’দেশের কাছে কোভিড -১৯ মামুলি ব্যাপার ছিল—একেবারে অন্যান্য ভাইরাসের মতো জ্বর-সর্দির মতো হাল্কা উপসর্গ ছিল। (পাঠক, সম্ভবত এই দুই শক্তিধর দেশের অনুসারী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক মন্ত্রক ও দলীয় নেতারাও একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। মন্ত্রকদের ছবিসহ মন্তব্যগুলো ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছে)। মার্চের প্রথম দিকে যখন করোনা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল, সংক্রমণ ও মৃত্যুহার জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকল, তখনই তাদের হুঁশ হলো। একটি ইউটার্ন আমরা লক্ষ করি, যাকে লাতুর ‘রেডিক্যাল টার্ন’ বলেছেন। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দু’দেশেই ব্যবসা সচল করে দেওয়ার পলিসিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা জোরেশোরে বলছিল। অথচ এখন দু’দেশেই নাগরিককে হতাশ হতে বারণ করছে। আশ্বস্ত করছে চলমান জীবনের অংশ হিসেবে করোনাকে দেখতে। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি করোনা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটসহ বাকিংহাম প্যালেসে ঝুঁকে পড়েছে। বাদ যায় না হোয়াইট হাউসও। কিছু সময়ের জন্য হলেও তাই আমরা ইউটার্ন লক্ষ করি।

তা সত্ত্বেও ট্রাম্প এবং জনসন দু’জনেই ব্যবসা সফল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। উদারনৈতিক মডেল দু’দেশেই কার্যকর। কেউই পাবলিকের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে অর্থনীতিকে জলাঞ্জলি দিতে চান না, চান না মুক্ত বাজারকে স্থগিত করতে। বরিস জনসনের অর্থনীতিক উপদেষ্টা ডমিনিক কানিগের খেদোক্তি হচ্ছে, ‘অর্থনীতিকে সুরক্ষা করো, এবং এতে করে যদি কিছু পেনশন ভোগীর মৃত্যু ঘটে, খুবই খারাপ’। উদারনীতিক ধরনে মানবতার স্থান নেই। আসলে পেনশন ভোগীরা তো বয়স্ক, নানান রোগশোকে জর্জরিত। জনমিতিক বিচারে এরা ‘বোঝা’; রাষ্ট্রের অনুগ্রহ পেয়ে বেঁচে থাকে। ইতালিতে আমরা দেখি, মহামারি করোনার কারণে লাশের স্তূপ জমা হচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে রোগীর স্থান নেই। যেখানে ডাক্তার আর নার্স অপ্রতুল তখন বৃদ্ধদের সেবা দান বন্ধ করার পলিসি নেওয়া হয়। যুবা ও শিশুদের বাঁচানোর তাগিদ দেওয়া হয়। এর প্রমাণ মেলে আমেরিকার ক্ষেত্রেও। হোয়াইট হাউস প্রশাসনের যুক্তি হচ্ছে, ভাইরাসকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দাও। উদারনৈতিক রেসপন্স হচ্ছে আগে অর্থনীতি বাঁচাও। অন্য অর্থে এই মডারেট জৈবরাজনীতি সম্পদের জন্য হুমকি নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো করোনা আক্রান্তের যে পর্যায়ে আছে তার সঙ্গে মিল রেখে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করবো কিনা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন চলছে এবং তা দ্রুতগতিতে। সর্বশেষ প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আক্রান্ত এবং ১৪০ জনের মতো অফিশিয়াল মৃত্যু’র তথ্য আমরা জানি। প্রতিদিন পত্রিকার খবরে এই হিসাবেরও অনেক বেশি তথ্য আমরা পাচ্ছি। দরিদ্র মানুষ কতকাল লকডাউন মানবে? আতঙ্ক আর মৃত্যুহার বেড়েই চলছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কে ক্রান্তিকাল বলেছেন এবং আমাদের ঘরে থাকতে বলছেন।

কিন্তু মানুষ কি আশ্বস্ত হচ্ছে? জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, না দল এই সংকটে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে—এ নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা রয়েছে। সমন্বয়হীনতা একমাত্র কারণ নয়। পলিসি কী হবে, প্রায়োরিটি কী হবে, তা দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। একেবারে গ্রাম পর্যায়ে সামাজিক দল ও গণ্যমান্য মানুষের মাধ্যমে ত্রাণ কাজ চালাতে হবে— তৈরি করতে হবে এলাকাগত ব্রিগেড—যেখানে দলের ঊর্ধ্বে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। এদেশে প্লেগ, মহামারিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট নজির রয়েছে। এই করোনাকালেও ঢাকা শহরসহ গ্রাম বাংলায় এলাকাবাসী সামাজিকভাবে লকডাউন পালন করছে। একটা আপৎকালীন (তিন মাস) আর্থিক সহযোগিতা গরিব আর খেটে খাওয়া মানুষকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই; ওই স্থানীয় ব্রিগেড এর দায়িত্ব নেবে। আমাদের পরিপূর্ণ লকডাউনে যেতেই হবে, যার অনেকটাই সরকার করছেও। শুধু প্রথমেই প্রয়োজন মানুষ বাঁচানো। স্বল্প সময়ের জন্যই এটা করা জরুরি।

দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমাদের আবার সচল হবে, কারণ নিকট ভবিষ্যৎ তো আছেই (ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ইতোমধ্যে কিছু প্রণোদনা ঘোষণা দেওয়ার জন্য)। আমাদের রয়েছে গৌরবময় কঠোর পরিশ্রমী প্রবাসী, যারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে; খেটে খাওয়া দিনমজুর আর পোশাক শ্রমিক। পাবলিক মনে করে, মানুষ বেঁচে থাকলে অর্থনীতিতে আপনা আপনি প্রণোদনা তৈরি হবেই। করোনা মোকাবিলায় সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের সুরক্ষা করতেই হবে; প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে অধিগ্রহণ করতে হবে। আমাদের হাতে এখনও কিছু সময় আছে। উদারনীতিবাদের অসম পরিকল্পনা এদেশের অগণিত অসহায় মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে—যেমন করে মূল্য দিতে হচ্ছে ইতোমধ্যে মৃত্যুপুরিতে পরিণত আমেরিকা ও ইউরোপকে। আশা করি সরকার ওই দেশগুলোর পথ অনুসরণ করবে না। তা না হলে নিকট ভবিষ্যতে একটি রাজনৈতিক সুইসাইডের ক্ষণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা বাংলাদেশি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে বেঁচে থাকতে চাই; কারণ ’৭১ আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে—এদেশ তোমার আমার-সকলের।   

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এবং মানবাধিকার ও বর্ডার বিষয়ক টাস্কফোর্স সদস্য, আমেরিকান অ্যানথ্রপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ