X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আনন্দমূলক শিক্ষাই শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পাথেয়

লীনা শারমীন হক
০৫ মে ২০২০, ১৪:৩৯আপডেট : ০৫ মে ২০২০, ১৪:৪১

লীনা শারমীন হক ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো বলেছেন, শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। শিশুদের সামর্থ্য ও শক্তিগুলোর স্বাভাবিক ও সুষম বিকাশই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিশুদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার এবং তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ করতে শিক্ষাপদ্ধতির বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনিভাবে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ শিশুর বাহ্যিক আচরণ, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী পরিবর্তনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। কখনও কখনও প্রচলিত ধারার শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর অনুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষা জীবনকে বিপন্ন করতে পারে। তাই শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক, আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি, যা কিনা তাকে কৌতূহলী ও আজীবন শিক্ষানবিশ হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে।

একুশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায় যে, শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু বেড়ে ওঠার সময় তার পারিপার্শ্বিকতাকে সে কীভাবে দেখছে অর্থাৎ তার দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখার ও বোঝার বিষয়টি অভিভাবকদের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে এবং শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজকাল অধিকাংশ অভিভাবকই তাদের সন্তানদের জন্য সুস্থ পরিবেশে একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ করেন। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত বয়সী শিশুদের জন্য সঠিক শিক্ষাপাঠ্যক্রম বেছে নেওয়া বেশ জরুরি।  বিশেষ করে, ঢাকায়, যেখানে আজকাল জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম অনুসারী বিকল্পধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, বেড়ে ওঠার বয়সে যেসব শিশু খেলার ছলে শিক্ষা লাভ করে তারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় সব বিষয়েই ভালো দক্ষতা প্রদর্শন করে। খেলার মাধ্যমে শিক্ষা বা শিক্ষার মাধ্যমে খেলা একটি শিশুকে কৌতূহলী, সৃজনশীল এবং তার বুদ্ধিমত্তার সঠিক বিকাশ ঘটাতে অনুপ্রেরণা জোগায়, তাই প্রতিটি অভিভাবকের প্রয়োজন তার শিশুর জন্য সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি নির্বাচন করা।

বাংলাদেশের প্রচুর অভিভাবক তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে চান। এই লক্ষ্য পূরণের আশায় সন্তানদের তারা সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করেন, যারা বৈশ্বিক শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে ও শিক্ষা প্রদানে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ চাহিদা সৃষ্টি করছে এবং একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এর নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক স্নাতকোত্তর (আইবি) শিক্ষার পাঠ্যক্রম, যা কিনা অন্যান্য পাঠ্যক্রম থেকে ভিন্ন। আইবি শিক্ষার কার্যক্রম তরুণদের অনুসন্ধানশীল, জ্ঞানী এবং যত্নশীল শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যেন তারা সহজেই তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়। তারা সচেষ্ট থাকে যেন শিক্ষার্থীরা আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া এবং শ্রদ্ধার মাধ্যমে একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তুলতে পারে, যা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের একজন বৈশ্বিক/গ্লোবাল নাগরিক হিসেবে রূপান্তরিত করবে।

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কাণ্ডারি। এই শিশুদের সঠিক পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করলে ও তাদের সামনে নতুন নতুন বিষয়ের দ্বার উন্মোচন করলে তাদের মন যেমন প্রস্ফুটিত হবে, তেমনি তারা বাসোপযোগী একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবে। আইবি (International Baccalaureate) শিক্ষার পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সুপরিচিত একটি শিক্ষাদান পদ্ধতি। আইবি শিক্ষার কার্যক্রমটি প্রচলিত শিক্ষার পাঠ্যক্রম থেকে ভিন্ন। এই পাঠ্যক্রমটি বিষয়ভিত্তিক নয় বরং ধারণাভিত্তিক, তাই অহেতুক শিক্ষার্থীদের কাঁধে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা এই পদ্ধতিতে আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান লাভ করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণরূপে তাদের শৈশবটাকে উপভোগ করে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ও স্বেচ্ছায় বিদ্যালয়ে আসার তাগিদ অনুভব করে। আইবি পাঠ্যক্রম অনুসারে লেখাপড়া পুরোটাই ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাঠাগারে গিয়ে যে বিষয় সম্পর্কে তারা অনুসন্ধান করছে সেই সম্পর্কিত বই সংগ্রহ করে বা টেকনোলজির মাধ্যমে নানারকম তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকে। এরপর তা যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করে, যেখানে শিক্ষক হচ্ছেন এই পাঠ প্রদানের মূল নিদর্শক। তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন যা কিনা শিক্ষার্থীকে চিন্তাশীল, অনুসন্ধানকারী, জ্ঞানী, নীতিবান, উদারমনা, দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জোগান যা কিনা  শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রেরণা বৃদ্ধি করে এবং তাদের আজীবন শিক্ষানবিশ হওয়ার প্রেরণা জোগায়।

শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য ও সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে আইবি শিক্ষাপদ্ধতির কার্যক্রমের শিক্ষা ব্যবস্থায় চারটি বিশেষ ধাপ অনুসরণ করা হয়। সেগুলো হলো: প্রাইমারি ইয়ার্স প্রোগ্রাম (PYP), মিডল ইয়ার্স প্রোগ্রাম (MYP), ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম (DP) এবং ক্যারিয়ার সংক্রান্ত প্রোগ্রাম (CP)।

আইবি শিক্ষার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রাইমারি ইয়ার্স প্রোগ্রামটি (PYP) ৩ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ MYP-পাঠ্যক্রমে প্রবেশের পূর্বে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার লক্ষ্যে PYP প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাদের শিক্ষাদান করা হয়। এই ধাপে ভাষা, গণিত, সমাজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও শারীরিক বিষয়ক নানাবিধ  বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান লাভ করে। শিক্ষকরা শিক্ষার এই পর্যায়ে আইবি প্রণীত কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন এবং এই প্রোগ্রাম থেকে তারা কী শিখেছে আইবি’র নীতিমালা অনুযায়ী তাও বিবেচনা করা হয়। PYP-র  শিক্ষার্থীদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করা হয় যেন তারা  তাদের অর্জিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, তাই আয়োজন করা হয় ‘ইউনিট সেলিব্রেশন’ বা ‘পিওয়াইপি’ এক্সিবিশনের মতো উৎসবের।    

আইবি পাঠ্যক্রমে  মিডল ইয়ার্স প্রোগ্রামটি (MYP) ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। এই স্তরে তারা দুই বছরব্যাপী ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের জন্য তৈরি করা হয় এবং  শিক্ষার্থীরা ৮টি ভিন্ন ধরনের বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এগুলো হলো: ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, ইনডিভিজ্যুয়ালস অ্যান্ড সোসাইটিজ, বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প, শরীর ও স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা এবং ডিজাইন ও টেকনোলজি। আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রম  হিসেবে আইবি শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নিজের ও বিশ্বের জনগণের প্রতি সমানুভূতিশীল এবং সংবেদনশীল হতে উৎসাহ দেয়। শিক্ষার্থীরা যেন নিজ সংস্কৃতি ও আন্তঃসংস্কৃতির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল উন্নত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, আইবি’র প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে।

১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের জন্য আইবি পাঠ্যক্রমের দুই বছরের শিক্ষা কার্যক্রম হচ্ছে DP প্রোগ্রাম। এই ধাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর শেষ করে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই এই আইবি-র পাঠ্যক্রমকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

আইবি প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অগ্রগতিতে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন ধাপে অর্জিত সাফল্যই পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভীতকে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী করে তোলে। আইবি-র প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের বিভিন্ন ধাপে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে, যা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত মেধার বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। কবিগুরুর এই অমর বাণী আইবি পরিচালিত শিক্ষার কার্যক্রমের মধ্যে পরিস্ফুটিত হয়। পরিশেষে বলা যায়, আইবি শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র জ্ঞানার্জনই করে না, তারা জীবনের অর্থ ও ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতায় বিভিন্ন কৌশলও রপ্ত করে।

লেখক: প্রাইমারি বাংলা শিক্ষিকা, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা

 

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আপনি কি টক্সিক প্যারেন্ট? বুঝে নিন এই ৫ লক্ষণে
আপনি কি টক্সিক প্যারেন্ট? বুঝে নিন এই ৫ লক্ষণে
সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিলেন আরও ১২ বিজিপি সদস্য
সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিলেন আরও ১২ বিজিপি সদস্য
রবিনিয়ো-সোহেল-এমফনের নৈপুণ্যে কিংস সেমিফাইনালে
রবিনিয়ো-সোহেল-এমফনের নৈপুণ্যে কিংস সেমিফাইনালে
রেমিট্যান্স বিতরণ নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও নগদের চুক্তি
রেমিট্যান্স বিতরণ নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও নগদের চুক্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ