X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরের ফোন এবং কয়েকটি ভয়ের গল্প

রেজানুর রহমান
১০ মে ২০২০, ১৫:২৪আপডেট : ১০ মে ২০২০, ১৫:২৭

রেজানুর রহমান বায়তুল মোকাররম এলাকায় একটি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাংকের সামনে ফুটপাতে লম্বা লাইন। কাঠফাটা রোদে মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরা প্রায় ৩০ জন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলবে। কেউ টাকা জমা দেবে। অন্য সময় হলে হয়তো লাইন ভাঙার প্রতিযোগিতা হতো। ব্যাংকের গ্রাহককে রাস্তার ওপর কেন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এই নিয়ে তুমুল হৈ চৈ হতো। এখন এসবের কিছুই হচ্ছে না। বরং সবাই শান্ত চেহারা নিয়ে ব্যাংকে ঢোকার অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটি দেখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক আনমনে বললেন, হায়রে মানুষ! ভয় না দেখালে এরা সোজা হয় না!
লোকটি একজন ড্রাইভার। বয়স ৪৫-এর মতো। তার গাড়ির মালিক ব্যাংকের ভিতরে গেছে। সে বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার দিকে তাকাতেই বলল, স্যার কী আমার কথায় মাইন্ড করলেন?

কোন কথা?

ওই যে বললাম, হায়রে মানুষ। ভয় না দেখালে এরা সোজা হয় না।

আপনিও তো একজন মানুষ। আপনার ভয় করছে না।

হ্যাঁ, ভয় একটু একটু করতেছে...।

কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না ভয় পেয়েছেন। রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়েছেন কেন? আমার কথা শুনে ড্রাইভার লোকটি তার তরমুজের বিচির মতো দাঁত বের করে অযথাই হাসতে হাসতে বলল, রাস্তায় তো স্যার তেমন গাড়িঘোড়া নেই। তাই...।

কিন্তু এটা তো নিয়ম না। ব্যাংকের পার্কিং এরিয়া আছে। সেখানে গাড়ি রাখেন...।

ড্রাইভার আবারও হাসতে হাসতেই বললো, পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি রাখলে ৫০ টাকা দিতে হবে। খামোখা কেন ৫০ টাকা দিতে যাবো।

তার মানে ৫০ টাকা দিতে হবে বলে আপনি আইন ভাঙছেন? ড্রাইভার এবার যেন একটু বিব্রত হলো। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, এইটাকে আইন ভাঙা বলে না স্যার। রাস্তা তো খালি পড়েই আছে। তাই গাড়ি পার্ক করছি।

তার কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ রাস্তায় একসঙ্গে কয়েকটি গাড়ি দেখা গেল। গাড়িগুলো থেকে একসঙ্গে হর্ন বাজছে। তার মানে সামনের গাড়িটা সরাতে বলছে। কিন্তু নীতিবান ড্রাইভার গাড়ি সরাবে না। বেধে গেল তর্কযুদ্ধ। এক পর্যায়ে হাতাহাতি লেগে যায় আর কী! হঠাৎ একটি অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখে সবাই তটস্থ হয়ে উঠলো। অ্যাম্বুলেন্সে কী করোনা রোগী আছে? এই নিয়ে শুরু হলো ফিসফাস। মুহূর্তে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। বিকট শব্দে সাইরেন বাজিয়ে সামনের দিকে চলে গেল অ্যাম্বুলেন্সটি। অনেক ভয়ার্ত মুখ তাকিয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্সটির দিকে। তাদেরই একজন বললো, হায়রে মানুষ... ভয় না দেখালে এরা সোজা হয় না।

দুই.

স্থান জাতীয় প্রেসক্লাব। বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে হাঁটতে হাঁটতে প্রেসক্লাবের সামনে এসে পড়ি। পথে ফুটপাতজুড়ে দু-একটি দোকান খুলেছে। অধিকাংশই মাস্ক বিক্রি করছে। মাস্কের ব্যবসা এখন জমজমাট। সাংবাদিকদের দ্বিতীয় বাড়ি জাতীয় প্রেসক্লাব বন্ধ। অন্যান্য সময়ে হলে এই এলাকায় হরেক রকমের বক্তৃতার শব্দে টেকাই দায় হয়ে দাঁড়াতো। এখন কোনও সাড়াশব্দ নাই। সুনসান নীরবতা চারপাশে। প্রেসক্লাবের প্রধান ফটকে একজন চিৎকার দিয়ে পাহারা রক্ষীকে ডাকছে। বিরক্ত মুখে একজন পাহারা রক্ষী দূর থেকে বললো, প্রেসক্লাব বন্ধ।

লোকটি চিৎকার করে জানতে চাইলো কবে খুলবে?

পাহারা রক্ষী জবাব দিলো, দেশ যেদিন  খুলবে সেইদিন।

পাহারা রক্ষীর কথা শুনে লোকটি বললো, কথার ছিরি দেখছেন? কোন কথার কী উত্তর!

তাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, প্রেসক্লাব কবে খুলবে এটা জেনে আপনি কী করবেন?

লোকটি অস্থিরতা প্রকাশ করে বললো, করোনার বিরুদ্ধে একটা সেমিনার করবো।

কার বিরুদ্ধে সেমিনার করবেন?

করোনার বিরুদ্ধে। করোনাকে ভয় দেখাইতে হবে। শালা অনেক বাইড়্যা গেছে....

বলতে বলতে হঠাৎ চলে গেল লোকটি। সে কী পাগল? হবে হয়তো! কিন্তু তার ‘ভয়’ কথার সঙ্গে বায়তুল মোকাররমের সামনের ‘ভয়’ কথাটার কেমন যেন মিল খুঁজে পেলাম। লোকটি সামনে হেঁটে যাচ্ছ আর ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করছে, করোনারে ভয় দেখাইতে হবে। ভয়...।

তিন.

স্থান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউটিউশন এলাকা! রমনা পার্কের পাশেই এই এলাকায় ওভার ব্রিজের নিচে ফুটপাতের ওপর কয়েকজন ছিন্নমূল মানুষ শুয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একজন মহিলা অন্য একজন পুরুষকে জড়িয়ে ধরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মহিলার শরীরের কাপড়ের বেহাল অবস্থা। পাশেই বসে তাস খেলছে কয়েকজন। আরেকজন মহিলার হাতে দামি মোবাইল ফোন। মোবাইলে একটি ভিডিও দেখছে। ফুটপাতের ছিন্নমূল মহিলার হাতে দামি মোবাইল ফোন দেখে কৌতূহল দমন করতে না পেরে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

এই ফোন কি আপনার?

মহিলা যেন একটু চমকালো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, হ আমার...

অনেক দামি ফোন!

হ, একজনে উপহার দিসে।

কে সে?

রাইতের নাগর, বলেই খিলখিল শব্দ করে হেসে ফললো সে! অবাক হলাম তাকে দেখে। ‘নাগর’ কথাটা কত সহজভাবে উচ্চারণ করলো। তার মানে শরীর বেঁচে সে এই ফোন উপহার পেয়েছে। করোনার আতঙ্কজনক সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা এরা কি জানে না? জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো, কীসের করোনা মরোনা... আমগোরে ধরবো না। তয় করোনা আমগোর ব্যবসায় বাগড়া দিছে। রাইতের নাগর পাই না! বড়ই কষ্টে আছি, বলেই আবারও খিলখিল করে হেসে ফেললো মেয়েটি। কষ্টের কথা কেউ এতটা হাসতে হাসতে বলে তা আগে দেখেনি। তার মোবাইলে একটা হিন্দি ছবি চলছে। ভয়ের ছবি। কিন্তু মেয়েটি ভয় পাচ্ছে না! হেসেই চলছে। হা...হা...হা, হি...হি...হি...।

চার.

শাহবাগ মোড়। জনশূন্য এলাকা। ফুলের বাজার খ্যাত এই এলাকায় রাত দিন ২৪ ঘণ্টা ভিড় লেগে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কিন্তু গোটা এলাকা নীরব। দু-একটি ফুলের দোকান খুলেছে। কিন্তু একটিও তাজা ফুল নেই। সব বাসি ফুল। একটি দোকানের ঝাঁপ খুলে দু’জন কর্মচারী নিজেরা কথা বলছিল। সুখ-দুঃখের কথা।

-একজন বললো, কেমন জানি ভয় করতেছে রে...।

-অন্যজন  জিজ্ঞেস করলো, কীসের ভয়?

-করোনার ভয়।

-হ, আমারও ভয় করতেছে। দিন কি পাল্টাইবো না?

-কি জানি... সবাই তো বলাবলি করতেছে এই আজাব নাকি দুনিয়া থাইক্যা আর যাইবো না! আমেরিকার অবস্থা তো আমগোর চাইতেও খারাপ।

-হ। ওই হালারা বহুত পাপ করছে...।

-আর আমরা পাপ করি নাই? এই নাজুক সময়েও আমরা গরিবের ত্রাণের চাল গায়েব কইর‌্যা দিতেছি... এইটা পাপ না!

-হ, এইটা তো অনেক বড় পাপ! আচ্ছা দোস্ত, ধর একদিন না একদিন তো আমগো দেশে করোনা থাকবো না। সবকিছু পরিষ্কার হয়া যাবে। তখনও কি এই দেশে মানুষ মানুষকে ঠকাবে? দুর্নীতি করবে? খাবারে ভেজাল দিবে। চালে পাথর মেশাবে?

-কি জানি... আমার তো ভয় কমতেছে না, বলেই দু’জনে হঠাৎ আমার দিকে চোখ ফেললো, স্যার ফুল লাগবে?

না। চলেই দ্রুত পায়ে সামনে দিকে হাঁটা দিলাম। হঠাৎ মনে হলো ভয় তাড়া করছে আমাকে। হাঁটছি তো হাঁটছি...।

পাঁচ.

কাওরান বাজার এলাকা। টেলিভিশনের খবরে সীমাহীন ভিড়ের ছবি দেখেছি। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় চলছে। তবু এতটুকু ভিড় কমেনি এই এলাকায়। রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, প্রাইভেট কার-সহ শত শত মানুষের ভিড়ে গম গম করছে গোটা এলাকা। মাছের বাজারে ভিড়, সবজির বাজারে ভিড়, মাংসের বাজারে ভিড়। দেখে বোঝার উপায় নাই এই দেশে করোনাভীতি চলছে। কথা হলো একজনের সঙ্গে। মগবাজার থেকে বাজার করতে এসেছেন। মধ্যবিত্ত চাকুরে। দুই মাস ধরে বেতন পান না। সংসারে টালমাটাল অবস্থা। দুঃখ করে বললেন, এই দেশে সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হলো মধ্যবিত্তরা। উচ্চবিত্তরা সাহায্য দেয়। নিম্নবিত্তরা, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের সেই সাহায্য গ্রহণ করতে লজ্জা পায় না। কিন্তু মধ্যবিত্তরা তা পারে না। হাত পাততে গেলেই লজ্জা ভর করে। পাছে না কেউ দেখে ফেলে!

কারওয়ান বাজারের আড়তে অপেক্ষাকৃত কম দামে তরিতরকারি পাওয়া যায়। তাই এসেছেন তিনি। হঠাৎ এলাকার ধর ধর বলে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। চোখের সামনেই একটি বেঁটেখাটো চেহারার লোক রুদ্ধশ্বাসে পালানোর চেষ্টা করছে। ইচ্ছে করলেই তাকে ধরে ফেলা যায়। কিন্তু কেউ ধরার জন্য উদ্যোগী হচ্ছে না। শুধু ধর ধর বলে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। একটু আগে আমার সঙ্গে কথা বলছিল যে লোকটি সে ছিনতাইকারীকে ধরার জন্য এগিয়ে যেতেই তার (ছিনতাইকারীর) ঘুষিতে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ছিনতাইকারীকে বাদ দিয়ে সবাই ঘিরে ধরলো মধ্যবিত্ত অসহায় লোকটিকে। কেউ একজন মন্তব্য করলো, কী দরকার ছিল এত সাহস দেখানোর। এই বাজারে দিনে এরকম অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অনেকে দেখেও না দেখার ভান করে। ধরলেই বিপদ। ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কারণ, ছিনতাইকারী সহজেই থানা থেকে ছাড়া পেয়ে আসে। তারপর বদলা নেওয়ার চেষ্টা করে। তার কথা শুনে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুত হাঁটা দিলাম সামনের দিকে।

ছয়.

বাসায় বসে টিভিতে খবর দেখছি। পরিচিত একজনের ফোন এলো। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।

-ভাই কী করেন?

-টিভিতে খবর দেখি।

-খবরে কী দেখেন?

-এই আর কী! করোনার খবর...।

-ভাই একটা কথা বললো?

-বলো...।

ওপাশে হঠাৎ নিস্তব্ধতা। কোনও সাড়াশব্দ নেই। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করি, হ্যালো... কথা বলো... হ্যালো... ওপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ।

ভাই, কী করি বলেন তো?

কেন, কী হয়েছে?

আবারও নিঃস্তব্ধতা। প্রশ্ন করি, ভাই কথা বলো, হ্যালো...

এবার শব্দ করে কান্নার শব্দ।

ভাই, ছোট্ট বাচ্চার দুধের টাকাও জোগাড় করতে পারছি না। বলতে গেলে পানি খেয়ে আছি দুদিন হলো। বাচ্চাকে তো ম্যানেজ করতে পারতেছি না। এদিকে বাড়িওয়ালা যন্ত্রণা দিতেছে। দুই-একদিনের মধ্যে বকেয়া ভাড়া পরিশোধ না করলে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে...। আমি তো মধ্যবিত্তও না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মাসের আয়ে মাস বলে। কিন্তু দুই মাস ধরে কোনও আয় নেই। করোনার চেয়ে অভাব বেশি ভয় দেখাচ্ছে। অথচ অভাবের কথা বলতে সংকোচ হয়। পাছে কে কী ভাবে... বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো সে!

তার কথা শুনে আমার যেন কেন যে আরও বেশি ভয় পেতে শুরু করলো। অজানা ভয়। সেটা বোধকরি করোনার চেয়েও শক্তিশালী।

প্রিয় পাঠক, আপনারা কি তা অনুভব করতে পারছেন?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ