X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেন প্রশ্ন করি?

হারুন উর রশীদ
১৩ মে ২০২০, ১৬:১০আপডেট : ১৩ মে ২০২০, ১৭:০৪

হারুন উর রশীদ আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় ‘আপনি কেন এত প্রশ্ন করেন?’ এই প্রশ্ন যেমন আমার লেখার মধ্যে থাকে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমি প্রশ্ন একটু বেশিই করি। আমার বন্ধুরা প্রায়ই হেসে বলেন, ‘তোমার জ্ঞান কম, তাই তুমি এত প্রশ্ন করো।’  আবার কেউ বলেন, ‘তোমার প্রশ্ন শেষ হবে কবে? কবে তুমি বড় হবে?’ আমার ধারণা আরও অনেক সাংবাদিককেও 'কেন এত প্রশ্ন করেন' এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
এক.
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কিন্তু আমার বেশ পছন্দ! তিনি রেগে যান, সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্ক করেন। সাংবাদিকরাও তার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের বাঁকা জবাব দেন তিনি। তির্যক মন্তব্য করেন। কখনও কখনও প্রেসরুম থেকে হন হন করে বেরিয়ে যান।
আমি বিষয়টি বেশ উপভোগ করি। আমার অনেক ভালো লাগে। তাকে আর তখন কোনও প্রেসিডেন্ট মনে হয় না। মনে হয় তিনি একজন সাধারণ মানুষ। আর সেখানকার সাংবাদিকরাও তাকে যে প্রশ্ন করা দরকার তা-ই করেন। ভয় পান না এই ভেবে যে আমি কাকে প্রশ্ন করছি! এসব ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এখনও যেকোনও প্রশ্ন করা যায়।

দুই.
আমরা যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, তারপরই শিক্ষকদের কাছে শুনেছি প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন না করলে কিছু জানা যাবে না। কোনও একটা পাঠ শেষে শিক্ষকরা আমাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন। আবার খুব জরুরি হলে মাঝখানেও প্রশ্ন করা যেত। এখনও নিশ্চয়ই শিক্ষার এই মৌল শর্তটি বাদ হয়ে যায়নি।

তিন.
আরও একটু আগে যদি যাই। শিশুরা বেড়ে ওঠে আর নানা প্রশ্ন করে। তাদের মন নাকি সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী হয়। তাই শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, শিশুদের প্রশ্ন কখনও থামিয়ে দিতে নেই। আর তাদের প্রশ্নের সদুত্তর দিতে হয়। তা না হলে তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে না। তবে এখন এই মনস্তত্ত্ব আরও এগিয়েছে। শিশুদের সব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাদের নিজেদেরই উত্তর খুঁজতে বলা হয়। প্রয়োজনে উত্তর খুঁজতে তাদের সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে। এটাও শিশুকে জানতে দেওয়ার আধুনিক একটি কৌশল।

চার.
আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু প্রাচীনতম দৈনিক ‘সংবাদ’ থেকে। এরপর যুগান্তর, সমকাল, একুশে টেলিভিশন হয়ে বাংলা ট্রিবিউন। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও যাচ্ছি আমি। সব জায়গায়ই একটি বিষয় শিখেছি, প্রশ্ন না করলে ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না।  ঠিক জায়গায় ঠিক প্রশ্ন না করতে পারলে সাংবাদিকতার মূল কাজটিই আর হয় না। প্রশ্নহীন সাংবাদিকতা আসলে কোনও সাংবাদিকতা নয়।

পাঁচ.
এতক্ষণ যা বললাম তা থেকে কেন আমি প্রশ্ন করি তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন প্রশ্ন করা হয় তার সব জবাব এরমধ্যে নেই। প্রশ্নের আরও নানা কারণ আছে। সাধারণভাবে যত কারণ আমার জানা আছে সেগুলো  বলছি। গবেষকরা হয়তো আরও ভালো বলতে পারবেন।

১. তথ্য জানার জন্য।
২. কারোর অবস্থান যাচাই করার জন্য।
৩. দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য।
৪.  থামিয়ে বা বসিয়ে দেওয়ার জন্য।
৫.  একমত অথবা একমত নয় তা প্রকাশ করার জন্য।
৬.  কারোর বোঝাপড়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে।
৭. কোনও বিষয়ে কারোর মন্তব্য জানতে।
৮. সমর্থন আদায়ের জন্য।

ছয়.
প্রশ্ন নিয়ে আরও একটু ধারণা পেতে আমরা যদি উল্টো দিকটি দেখি তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। আর তা হলো মানুষ কেন প্রশ্ন করে না।
১. কোনও অপরাধ বা অপরাধীকে আড়াল করতে।
২. বিব্রতকর বা লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করতে।
৩. ভয়ের কারণে।
৪. ভয় সৃষ্টি করতে।
৫. ব্যবহার করতে।
৬. অপরাধ বা ঘটনার শিকার কারোর সঙ্গে সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে।
আমরা মনে হয় আমি এ পর্যন্ত কিছুটা হলেও স্পষ্ট করতে পেরেছি যে কেন প্রশ্ন করা প্রয়োজন। আর প্রশ্ন না করার কী ক্ষতি হতে পারে।

সাত.
আমরা এখন যে প্রশ্নবোধক চিহ্নটির (?) লিখিত রূপ দেখি এটা কিন্তু সব সময় ছিল না। প্রশ্নের বাক্যটিও তখন বিন্দু বা ডট (.) দিয়ে শেষ করা হতো। কিন্তু পরে এই ডটের ওপরে একটি ফ্লাশ লাইট বা বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর প্রতীক ব্যবহার করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি হয়। এই চিহ্নটি কোনও প্রশ্ন করার সময় যখন কণ্ঠ উঁচু বা উচ্চকিত হয় তার প্রতীক। সপ্তদশ শতকের পরে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। এই চিহ্নের মধ্যেই  প্রশ্নের শক্তি এবং প্রয়োজন স্পষ্ট।

আট.
আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে তাই প্রশ্ন করি। প্রশ্ন করি জানতে, জানাতে। প্রশ্ন করি অসম্মতি প্রকাশ করতে, সম্মতি জানাতে। প্রশ্ন করি ঘটনা গোপন না করে প্রকাশ করতে। প্রশ্ন করি আমার পাঠক এবং সাধারণ মানুষের মতামত জানতে। এটা আমার একটি কৌশল।
আমি অনেক সময় জানলেও তা সরাসরি না বলে প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করি। কোনও না কোনও কৌশলে আমি মানুষকে জানাতে চেষ্টা করি। এটাই আমার আসল কাজ। মানুষ যদি আমার কাছ থেকে তথ্য না-ই জানলো, তাহলে আমি কীসের সাংবাদিক! আমি যদি তথ্য গোপন করি তাহলে তো আমার পেশার প্রতি নিজেই সম্মান রাখলাম না।

নয়.
সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হলো মানুষের প্রশ্নগুলো তুলে আনা। আবার একই সঙ্গে সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে দেওয়া। মানুষ যাতে প্রশ্ন করতে পারে তার পথ তৈরি করা। সংবাদমাধ্যম নিজে প্রশ্ন করবে গণমানুষের কণ্ঠ হিসেবে। আর এই প্রশ্ন করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে থাকতে হবে ভয়ভীতি, অনুরাগ বা বিরাগের ঊর্ধ্বে। প্রশ্নের নামে স্তুতি করা সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। কাউকে হেয় করাও নয়।

মানুষের প্রশ্ন এবং মানুষের কল্যাণের প্রশ্ন করে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে চেষ্টা করবে। আমার বিবেচনায় এ কারণেই সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের ‘ফোর্থ স্টেট’।

তবে এই কাজটি সহজ নয়। কারণ, যারা তথ্য গোপন করতে চান তারা প্রশ্ন পছন্দ করেন না। যারা সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখতে চান তারাও প্রশ্ন পছন্দ করেন না। আর তাদের ক্ষমতা থাকলে যিনি প্রশ্ন করবেন তাকে বসিয়ে দেবেন। আর এটা তো মানুষের একটা প্রচলিত বৈশিষ্ট্য যে ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে কিন্তু নিজের জন্য গাধাকেই পছন্দ করে।’ তাই সাহস ছাড়া প্রশ্ন করা কঠিন। তবে সাংবাদিক দক্ষ হলে, সংবাদমাধ্যম পেশাদার হলে প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি কৌশলে গুড হিউমারে রেখেও করা যায়। সাংবাদিকতা একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কৌশল তো জানতেই হবে।

দশ.
তাই বাংলা ট্রিবিউন-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বাংলা ট্রিবিউন-এর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ‘প্রশ্নের’ এই সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তাকে আরও বেশি করে আমরা উপলব্ধি করবো । মানুষের জন্য বিরামহীনভাবে প্রশ্ন করবো। দেশ ও দেশের মানুষের ভালোর জন্য বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্ন কখনোই শেষ হবে না।

লেখক: সাংবাদিক


ই-মেইল:[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ