X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

এমপির মান, সাংবাদিকের হানি

আমীন আল রশীদ
২২ মে ২০২০, ১৫:৫৫আপডেট : ২২ মে ২০২০, ১৫:৫৮

আমীন আল রশীদ ঘটনাটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরের ‘অনিয়মের’ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আমার হবিগঞ্জ’-এ। তাতে মানহানি হয় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জহিরের। ফলে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক সুশান্ত দাসগুপ্তর বিরুদ্ধে। সেই মামলায় পুলিশ সুশান্তকে গ্রেফতারও করেছে।
ধরা যাক, প্রকাশিত সংবাদটি সঠিক নয় এবং তাতে এমপি মহোদয়ের মানহানি হয়েছে। যার মানহানি হলো, মামলা তো তিনি করবেন। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের মানহানি কেন হলো? এর উত্তর, ওই এমপি হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। ফলে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায় ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক যে মামলাটি করেছেন, সেটি ক্লাবের বাকি সদস্যদের সম্মতিতেই যে হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ এমপির মানকে তারা নিজেদের মান বলে গণ্য করেছেন।

যিনি মামলা ক‌রে‌ছেন, তি‌নি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি। এখন প্রশ্ন হলো, এই আইন নি‌য়ে ওই টেলিভিশনের নীতিগত অবস্থান কী বা তাদের একজন প্রতিনিধি যে এমপির পক্ষে এরকম একটি বিতর্কিত আইনে মামলা করলেন, তাতে ওই প্রতিষ্ঠানের সায় আছে কিনা বা তিনি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে মামলাটি করেছেন কিনা?

স্থানীয় এমপির সঙ্গে সাংবাদিকদের এই সখ্য সারা দেশেই কমবেশি আছে। গত ১৫ মে গাইবান্ধার পলাশবাড়ি প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি। কমিটি অনুমোদনের কাগজে তার স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি এই ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা। স্থানীয় এমপিরা সাধারণত তাদের নির্বাচনি এলাকার প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা বা পৃষ্ঠপোষক হন। কিন্তু কমিটির অনুমোদনও যে তারা দেন, সেটি এর আগে কানে আসেনি। প্রশ্ন হলো, যে সংগঠনের পরিচালনা কমিটির অনুমোদন দেন এমপি, সেই এমপির অনিয়ম-দুর্নীতির খবর কী করে এই সাংবাদিকরা প্রকাশ করবেন? প্রকাশ ও প্রচার তো দূরে থাক, তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাওয়া গেলেও তো সাংবাদিকরা চেপে যাবেন।

স্থানীয় পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন, হাতেগোনা কিছু লোক বাদ দিলে তাদের প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোক বলে নিজেদের পরিচয় দিতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করেন। আবার অনেক সময় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যেও একাধিক গ্রুপ থাকে। অনেকে কোনও দলের সমর্থক হলেও নৈতিকতায় অটল থাকেন। পেশাদার মনোভাব নিয়ে থাকেন। ফলে তার ওই দলীয় সমর্থন আখেরে তাকে সুরক্ষা দেয় না। সুরক্ষা পেতে তাকে স্থানীয় এমপির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়।

সাংবাদিক সুশান্ত নিজেও আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ তাকে ‘আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্ট’ বলেও মন্তব্য করেছেন। অথচ স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরেই তার বিরুদ্ধে মামলা হলো এবং তিনি গ্রেফতার হলেন। ফলে এখানে শুধুই সংবাদ প্রকাশ, নাকি এর নেপথ্যে আরও কোনও ঘটনা আছে, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

সাংবাদিকরা নিজেদের কমিউনিটির লোকের বিরুদ্ধে যে এই প্রথম এরকম মামলা করলেন তা নয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে মুন্সীগঞ্জের এক সাংবাদিকও তার ৭ জন সহকর্মীর বিরুদ্ধে বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় অনেকে জেল খেটেছেন। পরে তাদের জামিন হয়। দুজন অব্যাহতি পান। তবে মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও একজন সাংবাদিক তার চাকরিটা হারান। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধি ছিলেন।

প্রসঙ্গত, খসড়া পর্যায়ে থাকা অবস্থা থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি কালো আইন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। নাগরিকদের নানা ফোরাম থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দেশের সিনিয়র সাংবাদিকরা সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। সাংবাদিকরা এই আইনটির ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বেশ কয়েকটি জায়গায় আপত্তি দিয়ে সেগুলো সংশোধনের তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো গ্রহণ করা হয়নি। বরং ওই সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, এ আইনের অপব্যবহার হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।

এটা ঠিক, ইন্টারনেট দুনিয়ায় নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সমাজে যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা বা ধর্মীয় উন্মাদনার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পরে এ পর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ফেনীর নিহত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত ইস্যুতে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের মামলাটি ছাড়া অন্য ঘটনাগুলোয় আইনের প্রয়োগ হয়েছে নাকি অপপ্রয়োগ; আবার এই মামলায় যেসব ঘটনাকে অপপ্রয়োগ বলা হচ্ছে, সেটিই আসলে প্রয়োগ কিনা, সে প্রশ্নও আছে। যেসব অভিযোগে এই আইনে মামলা করা হয়েছে, তার কতগুলো সঠিক এবং কতগুলো মামলা ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

ফেসবুকে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা হয়। অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে হাস্যরসও হয়। কিন্তু সব ঘটনায় মামলা হয় না বা নাগরিকদের গ্রেফতার করা হয় না। বাস্তবতা হলো, কোনও স্ট্যাটাস বা সংবাদ অথবা তথ্য যদি সরকারের কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা অংশ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তখনই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি টার্গেটে পরিণত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনাগুলো ঘটে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং তার প্রতিশোধ হিসেবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কেউ সরকারের কোনও নীতি বা কাজের সমালোচনা করার চেয়ে যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাতে তিনি হতে পারেন এমপি বা এরকম কেউ, তখন ঝুঁকিটা বেশি থাকে।

স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু জটিল। তাদের মধ্যে নানা গ্রুপ থাকে। ফলে কেউ যখন সরকারের বা স্থানীয় এমপি অথবা জনপ্রতিনিধির কোনও কাজের সমালোচনা করেন, তখন প্রতিপক্ষ সাংবাদিকরাই তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট নিয়ে বা প্রকাশিত সংবাদের ক্লিপিং সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মামলা দায়েরে প্ররোচিত করেন। এতে ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধির সঙ্গে একটি পক্ষের সখ্য গড়ে ওঠে। এই সখ্যের সঙ্গে বৈধ-অবৈধ নানারকম লেনদেনেরও সম্পর্ক থাকে।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, হঠাৎ করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং তাতে গ্রেফতারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে দেশে করোনা নিয়ে উদ্বেগ শুরুর পরে। এই বিষয়ে শুরুতে আইইডিসিআর যে ব্রিফিং করে, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম সমালোচনা শুরু হয়। এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়েও রসিকতা শুরু হয়। একপর্যায়ে আইইডিসিআরের বদলে স্বাস্থ্য অধিদফতর ব্রিফিং ‍শুরু করে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম অব্যবস্থাপনার সমালোচনাও হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এসব ঘটনার পরই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন নির্দেশনাও জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কোনও সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লেখা যাবে না। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন শিল্পীও রয়েছেন, যিনি করোনা ইস্যুতে ফেসবুকে একটি ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা এবং এরপরে ওই আইনের আলোকে তৈরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার যে সাংবাদিকরা, সেই সাংবাদিকদের একটি অংশই যখন তাদের সহকর্মীর বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করেন, তখন বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নগুলো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো মনে হয় কিনা, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অতএব, হবিগঞ্জে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজন সাংবাদিকের গ্রেফতারের নেপথ্যে আরও কিছু আছে কিনা, তা হয়তো অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং গণবিরোধী আইনে নাগরিকদের হয়রানির ইতিহাসে হবিগঞ্জের এই ঘটনাটি একটি বড় কেসস্টাডি হয়ে থাকবে। এমপি এবং স্থানীয় প্রেসক্লাবের এই যূথবদ্ধতাও সাংবাদিকতার অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ