X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কিছুটা গরিব হতে হবে করোনাকালে, বেঁচে থাকতে চাইলে

সফিকুল আলম সেলিম
২৭ মে ২০২০, ১৬:৫০আপডেট : ২৭ মে ২০২০, ১৮:৩৯

সফিকুল আলম সেলিম বিশ্বের কোভিড-বিপর্যয়ের বয়স পাঁচ মাস ছাড়ালো। কত কিছু ঘটে গেলো এ সময়ে। কী কী ঘটেছে? মানুষ নামের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রাণীটির সব ধরনের তৎপরতা থেমে গেছে এই গ্রহের ওপর- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক। এখন যুদ্ধ চলছে। যার একদিকে বিশ্বের মানব সম্প্রদায়, অন্যদিকে প্রাণঘাতী অদৃশ্য জীবাণুশত্রু- নভেল করোনাভাইরাস। সবকিছু অচল, একমাত্র সচল দেহ-মন-প্রাণ। এক প্রকার অচল হয়ে আছি আমিও, কেননা আমিও তো এই বিশ্বের একজন। খুব করে ভাবছি কী করতে হবে? কোথায় মুক্তি? ভাবছি খুবই। অনেক ধরনের ভাবনা।
এখন শুধু টিকে থাকার সময়। কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও। এখনকার কাজ জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখা। ঘরে আটকা থেকে হয়তো ভাইরাসের খপ্পর থেকে জীবনটা বাঁচলো, কিন্তু সেই ফাঁকে জীবিকাটা চলে গেলে জীবনটা চলবে কীভাবে? এজন্য জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেকোনও প্রকারে। সামগ্রিক অর্থে, জীবন ও জীবিকা অবিচ্ছেদ্য। এর মানে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কিছুটা গরিব হলেও সচল রাখতে হবে তার চাকা।
উৎপাদনই মূল কথা। উৎপাদন চালিয়ে যেতেই হবে। উৎপাদনযন্ত্র সচল রাখতে হবে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন, বছরের ৩৬৫ দিনই। এটি খুবই সম্ভব। জরুরি উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রমগুলো যেভাবে চালু থাকে ঘড়ির কাঁটা ধরে- যেমন, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, পণ্য-পরিবহন, বিদ্যুৎ স্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি।
তবে কর্মক্ষেত্রে লোকবল কমাতে হবে। সংক্রমণ রোধে এটাই এ বিশ্বে চিরকাল সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণিত। এজন্য রোস্টার-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা চলবে সব ধরনের অফিস। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় জমায়েত বন্ধ থাকবে। কাজ চলবে ব্যবসাপাতি, ব্যাংক-বীমা, কৃষি-শিল্প সব ক্ষেত্রেই। তবে উৎপাদন ও বাণিজ্যে উপার্জনের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনতে হবে অর্ধেকে। আগের তুলনায় অর্ধেক মুনাফা হলে কর্মীর মজুরিও হবে আগের তুলনায় অর্ধেক। এতে কর্মী প্রাণে বেঁচে যাবে। কিছুটা সমস্যা হলেও মেনে নিতে হবে, এই ভেবে যে নাই মামার চেয়ে অন্তত ‘কানা মামা’ তো ভালো। কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমাতে সামাজিক দূরত্ব কার্যকর ফল দেবে। রোস্টার করা হলে সবক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে, মহাবিপর্যয়ের কাল চলছে। আমরা একটি জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছি, একটি লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছি আমরা সবাই। সংকটকাল কেটে যাবেই, আগে বা পরে, একদিন না হয় একদিন। কিন্তু এই সময়টুকু টিকে থাকার তো কোনও বিকল্প নেই।

মন্দার বিষয়ে সরকারি ঘোষণা দিতে হবে, অর্থনীতির ভুবনে। নাগরিক জীবনযাপনে শৃঙ্খলা নিশ্চিতে ১৪৪ ধারার জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে দেশে। দু’জনের বেশি একত্রে চলতে পারবে না। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটতে পারবে না। বাজারে সব পণ্যের দাম অর্ধেক করা হবে। বাড়িভাড়া অর্ধেক হবে। টাউন সার্ভিসের বাস চলবে। ট্রেন চলবে। তবে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করতে হবে। মালিকের আয় অর্ধেক হবে, কর্মীদের বেতনও অর্ধেক হবে। তাতে অসুবিধা হবে না, কারণ, বাজারে চাল-ডাল-তেল-নুনের দাম, তথা, জীবনযাপনের ব্যয়ভার অর্ধেক হবে।
তবে অর্থনীতি বন্ধ রাখা যাবে না। মানুষকে বেকার বানানো যাবে না। ২০০৮ সালেও ঐতিহাসিক মন্দায় পড়েছিল বিশ্ব। কিন্তু তখনও বিশ্বের সব কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই করেনি। স্বল্প সুবিধা নিয়ে হলেও তারা অর্থনীতি বাঁচিয়ে রেখেছে। মন্দার সময়টুকু টিকে গেছে এর ফলে। মন্দাকাল পেরিয়ে আসার পর আবার স্বাভাবিক করেছে সবকিছু। রাষ্ট্র, কতিপয় ধনবান আর বেকার হয়ে বাস প্রতিষ্ঠানের অনুদান-প্রণোদনা আর ভর্তুকি দিয়ে বিশ্ব চলতে পারবে না খুব বেশি দিন। উপলব্ধি করতেই হবে এই নির্জলা সত্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার সাধ্যমতো করছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে অক্ষম। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বকে তারা চীনা ফরমুলা অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু চীন এমনিতেই বাদবাকি বিশ্বের তুলনায় একটি ভিন্ন চরিত্রের দেশ। তাদের বিশাল জনসংখ্যা, বিশাল সেনাবাহিনী-পুলিশ, বিশাল অবকাঠামো। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে সেখানে। বিশ্বের অন্যত্র তা নেই। ফলে চীনের ফরমুলা ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়, ইতালি, ফ্রান্সে, বেলজিয়ামে, ব্রিটেনে, ইরানে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। সংক্রমণ ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থার খেসারতে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে তাদের। চীন সরকার মাসখানেকের মধ্যে তার দেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে, অন্যেরা তা তিন/চার মাসেও পারেনি। বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। আমাদের চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই নিজ নিজ হাতে তুলে নিতে হবে।   
চীন সংক্রমণ শুরুর পরপরই কিন্তু বুঝতে পারছিল, অনতিবিলম্বে ভাইরাসটি বিশ্বেও ছড়াবে। ওই দিনগুলোয় তারা বাইরের লোকের সেদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আনলেও দেশের বাইরে চীনাদের যাওয়াটা বহাল রেখেছে। চীনারা বাইরে গেছে, তাদের সঙ্গে গেছে কোভিড-১৯। চীনাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি বিশ্বে ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। অন্যরা ঘটনাটি বুঝে ওঠা কিংবা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই পড়ে গেছে প্রলয়ের মুখে। সামলে ওঠার আগেই এসব দেশের লাখ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলেছে ভাইরাস। প্রতিদিন হাজারে হাজারে মরতেও শুরু করেছে মানুষ। সব ধরনের বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কার্যক্রম লকডাউন করলেও, সব মানুষকে রাতারাতি ঘরে ঢুকিয়ে দিলেও সুবিধা হয়নি খুব একটা। এই ফাঁকে পুঁজিবাজার থেকে উধাও হয়েছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে বিশ্বে। এখন তারা সবাই অবরুদ্ধ ঘরে বসে আছে, ভয়াবহ অনিশ্চিত এক আগামীর দুঃস্বপ্ন সঙ্গী বানিয়ে।
ট্রাম্প অনেকবার অভিযোগের আঙুল তুলেছেন চীনের দিকে। তেমনটি করতেই পারেন তিনি। বিশ্বকে আরও আগেই সতর্ক করতে পারত চীন, তারা করেনি। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুরোধ করেছে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য। বিশ্ব কি আদৌ প্রস্তুত ছিল হোম কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, টেস্ট কিটস, কুইক টেস্ট, মাস্ক, এন-নাইনটিফাইভ, পিপিই আর পিসিআর টেস্ট- এসব নতুন নাম, আর জীবন রক্ষাকারী উপকরণের জন্য। চীনের কাছে এর সমাধান সহজ। চীনের মানুফ্যাকচারিং শিল্পের পরিধি বিশাল, বাদবাকি বিশ্বের তা নয়। বিশ্বকে এসব জিনিস শেষমেশ চীনকেই সরবরাহ করতে হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ লোকের জীবনযাপন পদ্ধতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরামর্শমূলক বিধিব্যবস্থার বাইরে। এই বিধিবিধান মেনে দীর্ঘদিন টিকে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই সাধারণ কর্মচারী, সেনা-সদস্য, পুলিশ-সদস্য, কর্মী-শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অনেক লোকের মধ্যে, থাকতে হয় স্বল্প পরিসরের আবাসনে, অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার সুযোগ নেই তাদের। মাত্র ১০ শতাংশ লোকের সামর্থ্য রয়েছে হয়তো, নিজের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখার। সঞ্চিত ধনসম্পদের ওপর নির্ভর করে আরও কয়েক মাস টিকে থাকার। এই ১০ শতাংশ মানুষের হয়তো কোভিড প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরামর্শ অনুসরণের সামর্থ্য আছে। ৯০ শতাংশেরই নেই। অথচ এই ৯০ শতাংশ লোকের শ্রমের ওপরই নির্ভরশীল ১০ শতাংশ মানুষ। ফলে আজ এবং আগামীতেও সংক্রমণ ছড়াবেই। একে প্রতিরোধের চলমান লকডাউন পদ্ধতি ও অনুরূপ প্রয়াস নিষ্ফল হতে বাধ্য। নিউইয়র্কে যখন লকডাউন করা হলো, প্রথম সাত দিন লোকজন কেউ ঘর থেকে বের হননি। কিন্তু খেতে তো হবেই। সাত দিন পর সবাই মিলে একসাথে ফের বাজার করতে বেরিয়েছেন তারা। এবং সবাই সবাইকে সংক্রমিত করেছেন। সাত দিনের লকডাউনের সব সুবিধা খোয়া গেছে একদিনেই।
আমাদের করোনার সঙ্গেই সমঝোতা করে থাকতে হবে, হয়তো আরও বহুদিন। বিজ্ঞান এর প্রতিষেধক আনবেই। ততদিন অভিযোজিত হতে হবে আমাদের। করোনাভাইরাসের সাথে মানিয়ে নিতে হবে নিজেদের, যোগ্য হয়ে উঠতে হবে করোনাকালেও বাঁচার। গবেষণা চলছে, ভ্যাকসিন যখন আসবে, তখন সব ঠিক হবে ফের, সব মানুষ হবে কোভিড-প্রুফ। শুধু মাঝের এ সময়টুকু টিকে থাকার স্বার্থেই কিছুটা ছাড় দিতে হবে সবার। কিছুটা গরিব হতে হবে আমাদের, বেঁচে থাকার জন্যই।

লেখক: কারুপণ্য রংপুরের প্রতিষ্ঠাতা, শিল্পোদ্যোক্তা।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
রানা প্লাজার ভুক্তভোগীর আক্ষেপ‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ