X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

কারফিউ ‘স্টাইলে’র কঠোর লকডাউন প্রয়োজন

আশিকুর রহমান
২৭ মে ২০২০, ১৯:১৫আপডেট : ২৭ মে ২০২০, ১৯:৫২

আশিকুর রহমান ঈদের পর বাংলাদেশে দুই সপ্তাহের জন্য কারফিউ স্টাইলের কঠোর লকডাউন আরোপ করা দরকার।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিন জনের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। প্রথম শনাক্তের দশ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ কোভিড-১৯-এ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
তারপর থেকেই ধীরে ধীরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ। এর কারণ মূলত মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে পরীক্ষার সক্ষমতা ছিল সীমিত।
তবে আমাদের পরীক্ষার সক্ষমতা বেড়েছে। দুই মাস আগে যেখানে প্রতিদিন একশ’ পরীক্ষা হতো এখন সেখানে প্রতিদিন ১০ হাজার পরীক্ষা হচ্ছে। আর এতেই আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত শনাক্ত হচ্ছে।

২৩ মে পর্যন্ত ৩২ হাজারের বেশি মানুষের কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৫২ জনেরও বেশি।

এটাও মনে রাখা দরকার, কোভিড-১৯-এ মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, প্রায় এক হাজার দুইশ’ মানুষ কোভিড-১৯ লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়ার কথা জানা যাচ্ছে।
এসবের মধ্যে একটি ছোট আশার কথা হলো, ছয় হাজার চারশ’র বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

আমরা যদি অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি তাহলে এটা বলাই ন্যায়সঙ্গত হবে যে ভাইরাসটি ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে আঘাত হেনেছে তা আমাদের এখানে হয়নি। এখনও আমাদের হাসপাতালগুলো খালি পড়ে রয়েছে আর এখনও কোনও গণকবর খোঁড়ার প্রয়োজন পড়েনি-যেমনটি নিউ ইয়র্ক বা অন্যান্য জায়গায় করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ, ভারত বা এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে তুলনামূলক এখন পর্যন্ত কম রোগী কেন?

এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত নেই, কিন্তু এটি ভাইরাসের কোনও অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নয়। আর এগুলো বিভিন্ন উপমহাদেশে বিভিন্নভাবেই ছড়ায়। স্মলপক্সের মতো নানা ভাইরাস কীভাবে বিভিন্ন উপমহাদেশে বিভিন্ন মাত্রায় আক্রান্ত করে তার ঐতিহাসিক বহু উদাহরণ রয়েছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভিন্নতার জন্যই এসব ভাইরাস আক্রান্তের তীব্রতাও ভিন্ন হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে ভাইরাস পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে এমন চিন্তা করার কোনও সুযোগ নেই যে, প্রকৃতি আমাদের কোনও মৌলিক উপায়ে এ থেকে রক্ষা করে দেবে।

বর্তমানে আমাদের যে ২৫ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী রয়েছে (সুস্থ হয়ে ওঠা ও মৃতদের বাদ দিয়ে), খুব শিগগিরই তা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর এর মধ্যে যদি ১০-১৫ শতাংশকে হাসপাতালে নিতে হয় তাহলে আমরা আমাদের মেডিক্যাল অবকাঠামো ভেঙে পড়তে দেখবো।

সে কারণে সারা জীবনে একবারের জন্য পাওয়া এই সংকট মোকাবিলার সঠিক পথ কী হবে তা বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হালকাভাবে আরোপ রেখে লকডাউনের কোনও বাস্তব স্বাস্থ্য সুবিধা পায়নি বাংলাদেশ। এর কারণ এমন নয় যে কৌশল হিসেবে লকডাউন ভুলভাবে ব্যবহার হয়েছে; বরং কারণ হলো এটা প্রয়োগ হয়েছে ‘বাংলাদেশ স্টাইলে’- যেটি আক্ষরিক অর্থেই একটা ‘ট্র্যাজিক কমেডি’।

লকডাউনের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে খোলা রাখা হয়েছে প্রার্থনার স্থানগুলো আর পুলিশ শারীরিক দূরত্ব কার্যকরের চেষ্টা করলে মানুষকে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে কাগজে কলমে বাংলাদেশে কোনও সময়েই ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়নি। যেটি কার্যকর আছে সেটাকে বলা হচ্ছে ‘সাধারণ ছুটি’, যা গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামে যখন কঠোর লকডাউনের ফলাফল দেখা যাচ্ছিল তখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এই পথে কেন হাঁটলেন তা হয়তো কখনও জানা যাবে না।

একমাত্র যে কৌশলটি কার্যকর হতে পারতো তা হলো গত ২৫ মার্চ থেকে তিন সপ্তাহের জন্য ‘কারফিউ স্টাইলের কঠোর লকডাউন’। তাতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যেত।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যারা 'কারফিউ-স্টাইলে'র লকডাউনের কথা বলেছিলেন (এমনকি সরকারের মধ্যকার ব্যক্তিরাও) জোরালো অর্থনৈতিক স্বার্থে তাদের অবজ্ঞা করা হয়েছিল। কারণ, দুঃখজনকভাবে সমসাময়িক দুনিয়াতে এটিই নীতিনির্ধারকের জায়গা দখল করেছে।

আর এটা বলা খুবই যৌক্তিক যে, ভাইরাস মোকাবিলা সঠিক পথে আনতে বাংলাদেশ আরও দুই মাস কঠোর লকডাউনের ধাক্কা সামাল দিতে পারবে না। কারণ, এতে আমাদের অর্থনৈতিক স্তম্ভগুলো ‘ভেঙে পড়ার’ দশায় উপনীত হবে।

ফলে কার্যত এসবের অর্থ হলো আমাদের যেকোনোভাবেই হোক দুনিয়ার এই উভয় সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

লোক দেখানো ‘সাধারণ ছুটি’ কার্যকরের ফলে আমাদের বার্ষিক জিডিপি’র প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ ক্ষতি হবে- আর এতে স্বাস্থ্য খাতের কোনও বাস্তবিক অর্জনও হবে না। তবে আমার মনে হয় এখনও আমাদের হাতে বিষয়গুলো সঠিক পথে নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দুই সপ্তাহ সময় আছে।

ঈদের ছুটি আর এর পরের দশ দিন স্বাভাবিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনিতে সীমিত থাকে। আর ঈদ ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম ইতোমধ্যে হয়েই গেছে। ফলে আমরা যদি ঈদের পর থেকেই পরবর্তী দুই সপ্তাহ কারফিউ-স্টাইলের কঠোর লকডাউন আরোপ করি তাহলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর এই পদক্ষেপ ঘিরে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে তার পরিমাণও কম হবে।

কম পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির বিনিময়ে ভাইরাস মোকাবিলার উপায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার এটাই হয়তো আমাদের শেষ সুযোগ। তারপর আমাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক – হার্ড ইমিউনিটি (herd immunity) থাকবে আমাদের একমাত্র সম্ভাব্য উপায়। কিন্তু সরকারের অভ্যন্তরে যারা অর্থনৈতিক মূল্যের বিনিময়ে হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে কথা বলছেন তাদের একটি মূল পয়েন্ট মনে রাখা দরকার। সেটি হলো যদি ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ার বড় অংশ কোভিড-১৯-মুক্ত হয়ে যায় আর বাংলাদেশ কোভিড-১৯-এর হটস্পট থেকে যায়, তাহলে তারা কি বাণিজ্য সহযোগী হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের বাণিজ্যের সুযোগ রাখবে?

তারা যদি চীনের জন্যও সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের জন্য, বিশেষ করে আমরা যদি রোগটি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ থেকে যাই সেক্ষেত্রে সীমান্ত বন্ধ করা ঠেকানো হবে কী দিয়ে? তাতে অর্থনীতির ক্ষতি হবে না?

অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াই ভাইরাস মোকাবিলার সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা একটি ভ্রান্ত ধারণা।

সে কারণে পরবর্তী এক মাসের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের খুবই সতর্ক হতে হবে। আর আমরা যদি এই মারাত্মক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ছোটখাটো পার্থক্যগুলোর দিকে নজর না রাখি তাহলে ভবিষ্যতের ইতিহাস এই সন্ধিক্ষণের দিকে ফিরে তাকাবে আর দেখতে পাবে একটি নীতিনির্ধারণী ভুল কীভাবে একটি মারাত্মক সমস্যাকে বিপর্যয়ে পরিণত হতে দিয়েছে।

চলুন বিপর্যয় এড়াই, যতটা পারা যায়।

লেখক: সিনিয়র ইকোনমিস্ট, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ

 

 

/জেজে/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ