X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংকটে সম্ভাবনা

এস এম মারুফ
০৫ জুন ২০২০, ১২:২৪আপডেট : ০৫ জুন ২০২০, ১২:৩৫

এস এম মারুফ উত্থান-পতনের সমাজে ঘুরে দাঁড়ানোটাই মানুষের স্বভাব। টিকে থাকতে হলে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। বিপর্যয় কাটিয়ে মানুষ নব সম্ভাবনা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগ, মহামারি বা মহামন্দা যেমন চলমান সমাজ এবং রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে-চুরে দিয়ে যায়, তেমনি প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করে দিয়ে যায়। পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের মধ্যে সম্ভাবনার বীজ নিহিত থাকে। সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর ওপরই নির্ভর করে বিপর্যয় পরবর্তী সফলতা।
কোভিড-১৯ মহামারি কল্পনাতীতভাবে পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করেছে এবং অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে শঙ্কা ও সম্ভাবনা দুটোই এনে দাঁড় করিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব এবং হোম কোয়ারেন্টিনে থেকেও প্রতিনিয়ত নিজেদের জিজ্ঞাস করছি, আমাদের কি চাকরি হবে বা থাকবে? খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত থাকবে? আমরা কি অসুস্থ হয়ে যাবো? অসুস্থ হলে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাবো কি? আরও অনেক প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা। তবু আশা আছে, সম্ভাবনা আছে মনের গহিনে। আছে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়।

প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার করোনাপূর্ববর্তী সময় থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, ই-গভর্নেন্স, ই-কমার্স, ই-লার্নিং এগুলোর ব্যবহার পূর্বের চেয়ে বাড়ছে। একই সঙ্গে এটি ধারণা করা যায়, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটবে। প্রযুক্তি মানুষের নিত্যদিনের কাজকর্মে বড় জায়গা দখল করে নেবে এবং ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপকতা আমাদের জন্য বড় সম্ভাবনা। এটি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ ও গতিশীল করবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রথমেই ই-কমিউনিকেশনের কথা বলতে পারি। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োগ পূর্বের যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। করোনা সংকটের জন্যই ই-কমিউনিকেশনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটি সত্য, তবে ভবিষ্যতে এর ব্যবহার কমবে না বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। আমরা লক্ষ্য করে থাকব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সারাদেশব্যাপী সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে জরুরিভিত্তিতে পালনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে অল্প সময়ে অনেক বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে। ফলে সময় ও অর্থ উভয়ই সাশ্রয় হচ্ছে।

বিভিন্ন করপোরেট অফিসের কর্মকর্তারা ঘরে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ দাফতরিক কাজগুলো সম্পন্ন করছেন। দাফতরিক কাজে প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার আমাদের জন্য নব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে।      

সীমিত পরিসরে হলেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভার্চুয়াল পাঠদান শুরু করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান শুরু করে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সব উপায় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে তাদের সম্ভাব্যতা ও সক্ষমতা পরীক্ষা করেছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অধিগম্যতা ও সহজলভ্যতা না থাকার কারণে তারা এই মুহূর্তে অনলাইন কার্যক্রমে যেতে পারছেন না। সম্ভাব্যতা ও সক্ষমতা যাচাই করতে গিয়ে এই যে সীমাবদ্ধতা বের হয়ে এসেছে, এটিই আমাদের জন্য সম্ভাবনা। এর ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীতি প্রণয়ন করতে পারবে, কীভাবে শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সবার জন্য প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায় এবং তাদের প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়। ভবিষ্যতে যেকোনও সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য এটি সর্বোত্তম বিকল্প মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণকে করোনামুক্ত রেখে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে স্বল্প পরিসরে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য সন্দেহাতীতভাবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন ভার্চুয়াল কোর্টের সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে ভবিষ্যতে এটি বড় পরিসরে শুরু করা যাবে কিনা।  

করোনা মহাসংকটের সময় আমরা দেখেছি উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত সব শ্রেণির দেশই জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কত অসহায়। এক্ষেত্রে সম্ভাবনার জায়গাটি হচ্ছে, প্রতিটি দেশ তাদের স্বাস্থ্যখাতে পূর্বের চেয়ে অধিক বরাদ্দ রাখবে এবং বিনিয়োগ করবে। অধিকসংখ্যক চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে এবং জনসংখ্যার আনুপাতিকহারে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে জরুরিভিত্তিতে দুই হাজার নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় টেলিমেডিসিন নতুন সংযোজন হবে। খুব জরুরি এবং মুমূর্ষু অবস্থা না হলে ডাক্তারের চেম্বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরিবর্তে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করা একটি স্মার্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে।

সামাজিক দূরত্বে থেকেও প্রযুক্তির কল্যাণে কিছু ক্ষেত্রে আমরা অনেক কাছাকাছি আছি। বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ভিডিও কলের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করছি। কোভিড-১৯ পারিবারিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনে দিয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং সম্ভাবনাময়। কর্মসূত্রে যারা বিভিন্ন শহরে থাকেন কিন্তু শেকড় গ্রামে, তাদের পক্ষে বছরে দু-তিনবারের বেশি গ্রামে গিয়ে মা-বাবা, দাদা-দাদিসহ আত্মীয়-স্বজনদের দেখে আসা সম্ভব হয়ে উঠে না। কোভিড-১৯ আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ মা-বাবা, বৃদ্ধ দাদা-দাদি এবং নানা-নানিকে প্রযুক্তিবান্ধব করে তুলেছে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তারা সন্তানদের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। পূর্বে তারা প্রযুক্তির এই মাধ্যমের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না কিংবা আমরা হয়তো অনেকে চেষ্টা করেও দেখিনি।    

কোভিড-১৯ বিপরীতমুখী দুটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে—কেউ কারও জন্য নয়, আবার সবাই সবার জন্য। এটি বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং পরস্পর নির্ভরশীলতা দুটি বিষয়ই অনেক দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে নিজের দেশ ও জনগণকে রক্ষা করার পূর্ণ সক্ষমতা থাকতে হবে এবং একইসঙ্গে সংকটকে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার জন্য অন্য দেশকেও সহযোগিতা করতে হবে। এই বাস্তবতায় প্রতিটি দেশ নিজস্ব উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থায় অধিক গুরুত্ব দেবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষিখাতে বিনিয়োগ করা হবে। কৃষিবান্ধব অর্থনীতি গুরুত্ব পেলে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সহজ হবে। অসচ্ছল এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের অর্থনৈতিক ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি এবং এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে। কারণ, এই সংকট দেখিয়েছে সমাজে একজন মানুষকেও অরক্ষিত রেখে, ঝুঁকিতে রেখে, বাকিদের নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকা অসম্ভব। এই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিলে আমরা খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবো এবং অবশ্যই সফল হবো।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ