X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

একঘরে থাকার ভয় দূর করুন

রেজানুর রহমান
১০ জুন ২০২০, ১৬:৪৩আপডেট : ১০ জুন ২০২০, ১৬:৪৪

রেজানুর রহমান ভয়টা যেন দূর হচ্ছে না। বরং দিনে দিনে ভয় আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। করোনার ভয়। আক্রান্ত হলেই জীবননাশ, এমনই ভয় সবার মাঝে। সে কারণে করোনার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ পরিচিতজনকেও বিশ্বাস করতে সাহস পাচ্ছে না। পাছে না তারও করোনা হয়ে যায়। অথচ বাস্তবতা হলো করোনায় আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যু নয়। যদিও এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে ঘরে বসে স্বাস্থ্যবিধি মানলেই করোনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। বাস্তবে ঘটছেও তাই। আক্রান্তদের প্রায় সকলেই শেষমেশ সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার এই পজিটিভ দিকটা খুব একটা আলোচিত হচ্ছে না। বরং করোনা সম্পর্কে আতংক ছড়াতেই আমরা অনেকে ব্যস্ত সময় পার করছি। ফলে করোনা হওয়া মানেই শুধু একক একজন ব্যক্তির সংকট শুরু হচ্ছে না। তার গোটা পরিবারজুড়ে সীমাহীন সংকট শুরু হচ্ছে। পরিবারটির পাশে সহমর্মিতা প্রদর্শনের চেয়ে তাকে একঘরে করে রাখার যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তা খুবই ভয়াবহ ও বিব্রতকর। ফলে করোনায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেকে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। পাছে না ‘একঘরে’ হওয়ার নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, এই ভয়ে অনেকেই করোনা সম্পর্কিত আসল তথ্য প্রকাশ করছেন না। ফলে অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে এই ভাইরাস একজনের থেকে আরেকজনের দেহে বাসা বাঁধছে। অনেকেই তা টের পাচ্ছি। কিন্তু কার্যত দেখেও না দেখার ভান করছি এই জন্য যে, পাছে না নিজে কোনও বিপদে পড়ে যাই।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দিতে চাই। কয়েকদিন আগে সৈয়দপুরে গিয়েছিলাম। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর। রেলের শহর। সবর্দাই শান্ত, নিরিবিলি থাকে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ছিলাম সৈয়দপুরে। বাড়ি থেকে বের হইনি। প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই আশেপাশের মসজিদের মাইকে মৃত্যুর একাধিক খবর শুনতে পেয়েছি। সব মৃত্যুকেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল বলে ফিসফাস, কানাঘুষা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু বিষয়টাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে এই জন্য যে, পাছে না করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার ‘একঘরে’ হয়ে যায়। একঘরে হওয়া মানে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া। অথচ করোনা একটি রোগ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চললেই এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সামাজিকভাবে এই পজিটিভ ক্যাম্পেইনটা যতটা হওয়া দরকার, ততটা হচ্ছে না মোটেই। বরং করোনা ভয়াবহ আতংকের বিষয়। করোনায় আক্রান্ত হলে বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নাই নেগেটিভ এই ক্যাম্পেইনটাই যেন বাতাসের বেগে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ফলে ‘একঘরে’ হওয়ার ভয়ে করোনার উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই সঠিক তথ্য প্রকাশ করছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে করোনা আক্রান্ত একজন রোগী বললেন, আমার পরিবার ‘একঘরে’ হয়ে যাবে ভেবে কাউকে কিছু জানাইনি। বাড়িওয়ালাকে ঘটনাটা জানানোর পর তিনিই সবকিছু গোপন রাখার পরামর্শ দেন! তার ধারণা ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ আর কিছু না পারুক গোটা বাড়ি লকডাউন করে দিয়ে যাবে। যা হবে বড়ই অস্বস্তিকর। অন্যরা বাড়িটিকে ঘিরে ভীতি ছড়াবে। ওই যে ওই বাড়িতে করোনা রোগী আছে। খবরদার ওই দিকে যাবে না... এমনই অশোভন পরিবেশ ও অশান্তির ভয়ে করোনা নিয়ে অনেকেই মুখ খুলছেন না!

করোনা মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই রোগ থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব, এই পজিটিভি ধারণাটি দেশের মানুষের মাঝে সেইভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি এখনও। শুরুর দিকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন করার ব্যাপারে যে ভীতি ছড়ানো হয়েছিল মূলত এই ভীতিই করোনাকে যমদূত হিসেবে সামনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ এখন বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন কার্য সম্পন্ন করা যাবে। শুরুর দিকে এই তথ্য প্রচার করা হলে জনমনে আতংক ছড়াতো না!

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান হলো প্রতিদিন দুপুরে করোনার আপডেট সম্পর্কিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত ব্রিফিং। এই অনুষ্ঠানটিতে করোনায় কতজন আক্রান্ত হয়েছে এবং কতজন মারা গেছে এই তথ্য বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে কিছু প্রত্যাশার কথাও থাকা দরকার। মারা যাওয়া তথ্যের চেয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কতজন সুস্থ হয়েছে এই তথ্যটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা উচিত। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্যও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত প্রচার করা উচিত। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি যিনি পরবর্তী সময়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এমন একাধিক ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত অনুভূতিও এই অনুষ্ঠানে প্রচার করা যেতে পারে। এর ফলে করোনার ব্যাপারে জনমনে ভীতি কমে যাবে।

প্রসঙ্গক্রমে একটি জরুরি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই করোনা সংক্রান্ত অসংখ্য বিশেষজ্ঞের দেখা মিলবে। কত যে পরামর্শ! অনেকেই পরামর্শ শুরু করেন ভীতিকর তথ্য দিয়ে। যেমন করোনা মরণঘাতী ভাইরাস। এখনও এর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। কবে আবিষ্কার হবে তাও বলা যাচ্ছে না...

প্রশ্ন হলো এভাবে ভীতি ছড়ানোর অর্থ কী। করোনা কতটা ভয়াবহ ভাইরাস পৃথিবীর মানুষ ইতিমধ্যেই তা বুঝে ফেলেছে। কাজেই এ ব্যাপারে বাড়তি ভীতি ছড়ানোর কোনও মানে হয় না। বরং সবার উচিত প্রত্যাশার কথা ছড়ানো। যাতে করে সাধারণ মানুষ বুকে বল পায়।

বুকে বল পাওয়ার কথা যখন উঠলো তখন আরও একটি জরুরি প্রসঙ্গ তুলতে চাই। করোনা এই মরণঘাতী রোগটি আমাদের মাঝে কিছু চরম সত্য তুলে ধরেছে। যার মধ্যে একটি হলো, একটি দেশের অগ্রগতির জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার আধুনিকতম পরিবেশ জরুরি। স্বাস্থ্যই যদি ভালো না থাকে তাহলে প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ আসবে কীভাবে? কাজেই করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা জরুরি। অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, আমেরিকার মতো আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশে তো করোনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কাজেই করোনার ক্ষেত্রে কি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা খাটে? এ ব্যাপারে হয়তো তর্ক হতে পারে। তবে একথা তো সত্য, করোনা বারবার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। করোনাকালীন এই সময়ে দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মারা গেছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো তাদের অনেককেই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতো! গত আড়াই তিন মাসে কাউকেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো যায়নি। তার মানে করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে দেশেই উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা জরুরি। জানি না করোনার এই দুর্যোগ আমাদের শেষ পর্যন্ত কী শিক্ষা দেবে। তবে যে যাই বলুক। সব কথার শেষ কথা, করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে, বাঁচতে হলে সর্বক্ষেত্রেই দেশের উন্নয়নটা জরুরি। যাতে করে বিপদে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়। অর্থাৎ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পথ খোঁজাটাই এখন সময়ের দাবি। তার জন্য আদৌ কি আমরা প্রস্তুত?

চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুইজন উচ্চপর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নামকরা হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য জেলার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি খোদ কর্মকর্তারাই আস্থা পাচ্ছেন না। তাহলে সাধারণ মানুষ ভরসা পাবে কীভাবে? সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনার ভয় দূর করতে হলে বিষয়গুলো ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে নড়াইলের সাংসদ মাশরাফি বিন মুর্ত্তজার উদাহরণ তুলে ধরা যায়। মাশরাফি তার এলাকায় স্বাস্থ্যসেবায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দেশের অন্যান্য সাংসদও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে করি।

প্রসঙ্গক্রমে আবারও সৈয়দপুরের কথা তুলে ধরতে চাই। সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতাল এক সময়ে ওই শহরের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। অযত্ন অবহেলায় কার্যত বন্ধ থাকা হাসপাতালটিকে করোনা রোগীদের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেরিতে হলেও এই উদ্যোগের প্রশংসা করি। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করি দেশের সকল জায়গায় স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত হোক। যাতে করে কাউকে ঢাকায় ছুটতে না হয়। করোনার ভয়াবহতা দূর করতে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এই মুহূর্তে অনেক জরুরি। সবার জন্য রইলো শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ