X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ভারত সংঘাত কিছু রাষ্ট্রের জন্য আনন্দ সংবাদ

মো. জাকির হোসেন
২০ জুলাই ২০২০, ১৮:০০আপডেট : ২০ জুলাই ২০২০, ১৮:০৫

মো. জাকির হোসেন চীন-ভারতের সাম্প্রতিক সংঘাতে উদ্বিগ্ন হয়েছি, কিন্তু বিস্মিত হইনি। এটি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বিবদমান দুই পক্ষ আপাতত লাইন  অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এ দফায় আর সংঘাত না হলেও ভবিষ্যতে সংঘাতের শতভাগ আশঙ্কা ও ঝুঁকি রয়েই গেলো। আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন চীন-ভারতের এবারের সংঘাত ও ভবিষ্যতে সংঘাতের ঝুঁকি দুই রাষ্ট্রের মাঝে অমীমাংসিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নয়। সংঘাতের পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ এখনও পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসেনি বলে আমরা এটিকে দুই রাষ্ট্রের বিরোধ বলে মনে করছি। প্রকৃতপক্ষে এ বিরোধটি তখন থেকেই অনিবার্য হয়ে পড়েছিল যখন আলোচনা শুরু হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ইউরোপীয়দের, বিংশ শতাব্দী আমেরিকানদের আর একবিংশ শতাব্দী এশিয়ানদের।
‘নেক্সট এশিয়া’ কিংবা ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে বেশ অনেক বছর ধরে। করোনা অতিমারির বহু বছর আগে থেকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হতে থাকে, সাড়ে তিনশ’ বছর পর অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা হতে সরে এশিয়া অভিমুখী হচ্ছে। এর ফলে চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, আর ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া হবে ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্ব সভ্যতায় শুরু হবে এশিয়ান সেঞ্চুরি। New McKinsey Global Institute-এর গবেষণা দেখিয়েছে কীভাবে এশিয়ামুখী হয়েছে অর্থনীতির কেন্দ্র। দশ বছর আগেও বৈশ্বিক বাণিজ্যে এশিয়ার অবদান ছিল এক চতুর্থাংশ, যা এখন এক তৃতীয়াংশ। World Economic Forum এর গবেষণা অনুযায়ী এক প্রজন্মের মধ্যেই এশিয়া নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের অঞ্চলে উন্নীত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৪০ সালের মধ্যে এশিয়া মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের ৫০ শতাংশ উৎপাদন করবে।

অন্যদিকে, মোট বৈশ্বিক ভোগের/ব্যয়ের ৪০ শতাংশই হবে এশিয়ায়। এদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড এর হিসাবে ২০২০ সালের মধ্যে এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সম্মিলিত অর্থনীতির চেয়ে বড় হবে। এসব হিসাব-নিকাশ কিছু রাষ্ট্রের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কেননা অর্থনীতির চালিকাশক্তি যাদের কাছে থাকে তারাই সভ্যতার নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি, দর্শন ও এর মানদণ্ড তৈরি করে। বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেয়। অতীতে অবিভক্ত ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থনীতির শক্তিতে বলীয়ান ছিল। ভারতীয় পুঁজিতে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ফুলের সুবাসে মধু সংগ্রহ করতে যেমন মৌমাছিরা ছুটে আসে তেমনি পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা, শিক্ষা আর অর্থ-সম্পদের আকর্ষণে। কিন্তু পৌনঃপৌনিক ঔপনিবেশিক শক্তির আঘাত, নির্মমভাবে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের ফলে এ অঞ্চল গুরুত্ব হারিয়েছে। এশিয়ান সেঞ্চুরির সুবাদে আবার সুযোগ এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার সামনে পুনর্জাগরণের। এশিয়া অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্বকে শাসন করবে, সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে নেতৃত্ব দিবে এটা মেনে নিতে পারছে না পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ। এর পেছনে প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে তার কয়েকটি আমি তুলে ধরছি—

এক. প্রচলিত বৈশ্বিক বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও আইন ব্যবস্থা ভয়ংকর রকমভাবে অগণতান্ত্রিক, শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও নির্মম। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান তার গবেষণালব্ধ বই The Unheard Truth: Poverty and Human Rights-এ উল্লেখ করেছেন বিশ্বে ৯৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়, ১০০ কোটি মানুষ বস্তিতে বাস করে, ২৫০ কোটি মানুষের পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা বঞ্চিত, প্রতি মিনিটে একজন মা গর্ভধারণজনিত কিংবা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) এক প্রতিবেদন মতে বিশ্বে প্রতি ৮ জনে ১ জনের পর্যাপ্ত খাবার ব্যবস্থা নেই। সংস্থার মতে বিশ্বে যখন কোটি কোটি মানুষ মারাত্মক ক্ষুধা ও অনাহারে ভুগছে তখন পশ্চিমা বিশ্বের ভোক্তারা ২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবার অপচয় করে বা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। পরিসংখ্যান বলছে পশ্চিমা ভোক্তাগণ গড়ে এক তৃতীয়াংশ খাবার ফেলে দেয়। হু এর এক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেয় তার আনুমানিক মূল্য ৪৮.৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে হু প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে ৭৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ন্যূনতম সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। ২০০ কোটি মানুষ পান করার জন্য যে উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে তা মলমূত্র দ্বারা দূষিত। ৩০০ কোটি মানুষের গৃহে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। আতঙ্কজনক হলেও সত্য হলো, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ২০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধা নেই।

কোভিড মহামারির মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রকাশ দক্ষিণ আফ্রিকার বস্তিবাসীদের জন্য খুবই সীমিত সংখ্যক পানির ট্যাপ ও টয়লেট রয়েছে। ফলে তাদের পানি সংগ্রহ ও টয়লেট ব্যবহারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা জনাকীর্ণ স্থানে অপেক্ষা করতে হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কীভাবে বজায় রাখা সম্ভব? আমেরিকান Professor Easterly-র মতে পরিবার ১২ সেন্ট মূল্যের ওষুধ ক্রয় করতে সক্ষম হলে এবং ৪ ডলার ব্যয় করে মশারি কিনতে পারলে ম্যালেরিয়াজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেক কমানো যেতো। তিনি আরও মনে করেন, নতুন মায়ের পেছনে ৩ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করা গেলে শিশুমৃত্যু ৫০ লাখ কম হতো। বিশ্বে যখন এমন বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও নির্মম অবস্থা বিরাজ করছে তখন স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট সিপরি এর হিসাব মতে ২০১৯ সালে বিশ্বে সামরিক ব্যয় হয়েছে ১৯১৭ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র একাই মোট সামরিক ব্যয়ের ৩৮ শতাংশ ব্যয় করেছে। চলমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের মাফিয়াতন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সম্পদ শোষণ করে এনে তাদের রাষ্ট্রে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, আর এ প্রক্রিয়ায় কিছু রাষ্ট্র দরিদ্র থেকে নিঃস্ব হয়েছে। আফ্রিকায় যে ভয়ংকর দারিদ্র্য বিরাজ করছে তার জন্য আফ্রিকা দায়ী নয়। আফ্রিকা দরিদ্র নয়, তাকে দরিদ্র করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকায় বিশ্বের খনিজ সম্পদের ৩০ শতাংশের মজুত রয়েছে। এসব খনিজের মধ্যে আছে ডায়মন্ড, গোল্ড, কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, তেল ও গ্যাস। গত দশকগুলো খনিজ সম্পদের মূল্য প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আফ্রিকার ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ভয়ংকর দারিদ্র্যের সঙ্গে বাস করছে। কেন এমন হলো? কারণ আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের প্রত্যক্ষ মদতে ও সহযোগিতায় অনেক ওয়ার লর্ড ও মার্সেনারি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর ফলে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ, হিংসা-বিদ্বেষ, রক্তপাত আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে রেখেছে। আর এ সুযোগে ওই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দোসর বহুজাতিক কোম্পানি নানা কৌশলে আফ্রিকার সম্পদ পাচার করে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। হার্ভার্ড-এর অর্থনীতির অধ্যাপক Nathan Nunn তার The Long-Term Effects of Africa Slave Trade শিরোনামের গবেষণায় দেখিয়েছেন আফ্রিকার মানুষকে দাস বানিয়ে পৃথিবীর অন্যত্র চালান করার সঙ্গে আফ্রিকার অনুন্নয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তিনি গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন আফ্রিকার যেসব অঞ্চল থেকে বেশি পরিমাণে দাস চালান করা হয়েছে সেসব অঞ্চল যেসব এলাকা থেকে কম দাস চালান করা হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি দরিদ্র। অধ্যাপক Nathan তার The Historical Origins of Africa’s Underdevelopment শিরোনামের আরেক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, আফ্রিকার সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের আয়ের যে গড় ৭২ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে তা তো হতোই না বরং আফ্রিকা বর্তমানের চেয়ে উন্নত হতো, যদি দাস হিসেবে আফ্রিকানদের ধরে নিয়ে যাওয়া না হতো। কী পরিমাণ দাস কেবল আটলান্টিক পেরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার উল্লেখ করতে গিয়ে অধ্যাপক Nathan বলেছেন ১৫১৪ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৫৮৪টি সমুদ্র অভিযানে দাস পরিবহন করা হয়েছে। দাস ধরে নিয়ে যাওয়ার ফলে আফ্রিকার প্রতিষ্ঠান ও সমাজকাঠামোতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অধ্যাপক Nathan দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন দাস ব্যবসার ফলে আফ্রিকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্বল রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক ও জাতিগত বিভাজন হয়েছে ভয়ংকরভাবে এবং পরিণতিতে রাষ্ট্রীয় আইনগত প্রতিষ্ঠানগুলোর মারাত্মক অবনতি হয়েছে। দাস ব্যবসার পাশাপাশি শোষণমূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থার মদতদাতা এসব রাষ্ট্রের অনেকেই এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে নির্মমভাবে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। দাদাভাই নওরোজীর হিসাব মতে, ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কেবল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই প্রতিবছর ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সমপরিমাণ সম্পদ পাচার হয়েছে।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ উৎস পটনায়েক বলেছেন, ব্রিটিশরা দুই শতাব্দীতে ভারতীয়দের শোষণ করে ৪৪.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ লোপাট করেছিল। ক্লিংগস্মিথ ও উইলিয়ামসনের গবেষণা বলছে ১৭৫০ সালে বিশ্ববাজারের মোট শিল্পপণ্যের ২৫ শতাংশ সরবরাহ করতো শিল্পসমৃদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশ। আর ১৯০০ সালে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ২ শতাংশে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাংগাস ম্যাডিসন তার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৭০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ২৭ শতাংশ অবদান ছিল ভারতের আর ২৩ শতাংশ ছিল সমগ্র ইউরোপের। কিন্তু ঔপনিবেশিক নির্মম শোষণের ফলে ১৯৫০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবদান ৩ শতাংশে নেমে যায়।

উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর এসব রাষ্ট্র বৈশ্বিক শোষণ টিকিয়ে রাখতে নতু নতুন প্রতিষ্ঠান, কৌশল, তত্ত্ব আবিষ্কার করে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিওটিও), ব্যাপকহারে বহুজাতিক কোম্পানি, এনজিও, মুক্তবাণিজ্য, বাণিজ্য উদারীকরণ, ডিরেগুলেশন, প্রাইভেটাইজেশন, বিশ্বায়ন ইত্যাদি। শোষণকে আড়াল করতে প্রতারণামূলকভাবে জন্ম দেওয়া হয় দরিদ্র রাষ্ট্রকে এইড প্রদান, Structural Adjustment, Poverty Reduction and Growth Facilities (PRGF), Poverty Reduction Strategic Paper (PRSP), Millennium Development Goals (MDGs), Sustainable Development Goals (SDGs).

এত এত ‘গোল’ দিয়েও দারিদ্র্য নির্মূলের খেলায় ফলাফল অনুল্লেখযোগ্য। অথচ ২য় বিশ্বযুদ্ধে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া ইওরোপ পুনর্গঠনে এক ‘মার্শাল প্ল্যানে’ই বাজিমাত। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Share The World's Resources (STWR)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রাপ্তির বিপরীতে ২০০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে থাকে। এটি মূলত ঋণ পরিশোধ, শোষণমূলক বাণিজ্য, বাণিজ্য উদারীকরণ, ঋণদাতা রাষ্ট্রের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয়, ধনী রাষ্ট্রের পছন্দমতো বহুজাতিক কোম্পানিকে দরিদ্র রাষ্ট্রে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া ও তাদের ঠিকাদার কোম্পানিকে কাজ দেওয়া, ধনী রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে শিল্পের কাঁচামাল বিক্রিতে দরিদ্র রাষ্ট্রকে বাধ্য করা, শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ, উচ্চ কনসালটেন্সি ফি ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (UNCTAD) এর হিসাব মতে বৈশ্বিক অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক বাণিজ্য ব্যবস্থার কারণে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিদিন ১১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ এইড হিসেবে ধনী রাষ্ট্রদের কাছ থেকে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো যা পেয়ে থাকে তার ১৪ গুণ বেশি। UNCTAD-এর তথ্য মতে দরিদ্র ৪৯টি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ অথচ বৈষম্যমূলক বাণিজ্যের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ৪৯টি রাষ্ট্রের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। Jason Hickel গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখিত Aid in reverse: how poor countries develop rich countries শিরোনামের প্রবন্ধে অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন দরিদ্র রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যাপকহারে ধনী রাষ্ট্রে পাচার হচ্ছে। Jason Hickel বলেছেন, ধনী রাষ্ট্রগুলো উচ্চকিত কণ্ঠে বলে তারা ১২৫ বিলিয়ন ডলার এইড দিচ্ছে প্রতিবছর, অথচ এই ১২৫ বিলিয়ন ডলার পুরোটা এইড নয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা Global Financial Integrity (GFI) ও নরওয়ের স্কুল অব ইকোনমিকস এর Centre for Applied Research এর তথ্য মতে এইডের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, ঋণ বিলোপ, রেমিট্যান্স, পুঁজির পলায়ন সবকিছুকে এইড হিসাবে দেখিয়ে পরিমাণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। Jason Hickel স্পষ্ট করে বলেছেন ‘Rich countries aren’t developing poor countries; poor countries are developing rich ones.’

তিনি দেখিয়েছেন দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো যদি ১ ডলার সাহায্য পায় তার বিপরীতে ২৪ ডলার তাদের দেশ থেকে পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। তিনি রাখঢাক না করে সরাসরি বলেছেন, ‘In other words, some of the very countries that so love to tout their foreign aid contributions are the ones enabling mass theft from developing countries.’ ফিলিপিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এনজিও IBON International তাদের Primer on Development and Aid Effectiveness প্রবন্ধে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রকে ভয়ংকরভাবে শোষণ করছে তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ৬০টি দরিদ্র রাষ্ট্র তিন দশকে ৫৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে সুদ ও মূলধন মিলিয়ে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। কিন্তু এখনও এসব রাষ্ট্রের কাছে পাওনা রয়েছে ৫২৩ বিলিয়ন ডলার। এই ভয়ংকর শোষণমূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও একচেটিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখতে এসব পশ্চিমা দেশকে অনেক নিষ্ঠুর, অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধ তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করা, বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতাদের হত্যা করা, ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রাইকা’র বটিকা সেবন করিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে কয়েক টুকরো করা, দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, ব্যবসায়ীদের বশংবদ গোষ্ঠী তৈরি করা, রাষ্ট্রদূতদের ব্যবহার করে শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতিতে নাক গলানো, নোবেল পুরস্কারের মাল্যভূষিত করা আরও কত কী।

এশিয়ার উত্থান তাদের সৃষ্ট বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতি নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই হুমকি দূর করতে তাই এশিয়ার প্রধান দুই চালিকাশক্তি চীন ও ভারতের মধ্যে বিরোধ পশ্চিমা কতিপয় রাষ্ট্রের জন্য আনন্দ সংবাদ। আনন্দের বলেই তো ভারত-চীন সংঘাতে মার্কিন সেনা পাঠানোর ইঙ্গিত।
দুই. সংঘাত মানেই পশ্চিমা রাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির সুযোগ। ভারত কোভিড মহামারির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক দফা অস্ত্র কিনেছে। রাফায়েল, স্পাইস বোমাসহ আরেক দফায় আরও ৩০০ কোটির অস্ত্র কেনার নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সামরিক মৈত্রী গড়ে তোলায় চীন-ইরান দোস্তি এখন চূড়ান্ত। চীন এবং ইরানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতাসহ ২৫ বছরের ‘কৌশলগত সহযোগিতা’র যে চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে তা এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এমন প্রভাব ফেলতে পারে, পশ্চিমাদের অস্ত্র বিক্রির মচ্ছব শুরু হতে পারে এ অঞ্চলে।

তিন. এশিয়ার প্রতি তথা প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও সম্মানজনক নয়। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা ঔদ্ধত্যমূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের গরিলা ও নিগ্রোদের বংশধর বলে ডাকতো। Garret G.T. তার বই An Indian Commentary-তে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মনে করতো, ‘creature half-gorilla and half-negro’। অর্থাৎ ভারতীয়দের চেহারা গরিলার মতো আর গায়ের রং নিগ্রোদের মতো। ভারতীয়রা চাকরি খুঁজলে ব্রিটিশরা তাচ্ছিল্য করে বলতো তোমাদের জন্ম হয়েছে ভূমিদাস হিসেবে ক্ষেত-খামারে কাজ করা, কাঠুরিয়ার কাজ করা ও পানি বহনের জন্য, চাকরি করার জন্য নয়। Annie Besant ‘How India Wrought Freedom’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘The Indians were the helots of the land, the hewers of the wood and the drawers of water.’ ১৮৬৯ সালে সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী প্রতিযোগিতামূলক Indian Civil Service পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকরা তাকে চাকরিতে যোগদান করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। চাকরিতে যোগদান করতে ব্যানার্জী লন্ডনের Queen’s Bench অদালতে মামলা করেন। মামলায় জয়ী হয়ে আদালতের নির্দেশে তিনি চাকরিতে যোগ দিতে সমর্থ হন। Henry Cotton তার ‘Indian and Home Memories’ গ্রন্থে লিখেছেন ভারতীয়দের ঔপনিবেশিক শাসকরা কখনই সমান মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ বলে মনে করতো না। তার প্রমাণ, রানি ভিক্টোরিয়া ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বিলুপ্ত করে নিজ হাতে দায়িত্বগ্রহণের আগে যে ঘোষণা জারি করেন, তার একটি অনুচ্ছেদে লেখা ছিল এখন থেকে ভারতীয়দের সমমর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হবে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, সাধারণভাবে এশিয়ানদের প্রতি পশ্চিমাদের এমনকি গণমানুষের মধ্যেও নাকসিটকানো মনোভাব রয়েছে। যারা ইউরোপ-আমেরিকা বসবাস করছেন তারা বুঝেন। ‘Anti-Asian Racism and Xenophobia’, ‘Anti-Asian Hate’, ‘Reports of Anti-Asian Assaults, Harassment and Hate Crime’ সংবাদপত্রের এসব শব্দগুচ্ছ প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের মনোভাব প্রকাশ করে।

চার. বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর আওতায় চীনের প্রভাব যেভাবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে চীনা ড্রাগনকে ঠেকাতে ভারতকে মিত্র হিসেবে পাওয়া পশ্চিমাদের জন্য মহা আনন্দের সংবাদ।

কয়েক’শ বছর পর বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথা এ অঞ্চলের শতকোটি দরিদ্র মানুষের ভাগ্য বদলের যে সুযোগ এশিয়ার সামনে এসেছে চীন-ভারত সংঘাতে তা হাতছাড়া হোক এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রতিবেশীকে ধ্বংস করতে চায় এমন বহিঃশত্রুর সঙ্গে সামরিক জোট গঠন যেমন ভুল, তেমনি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা না করে প্রতিবেশীর ওপর আগ্রাসন চালানোও মস্ত ভুল। এশিয়ার সব রাষ্ট্রকেই বিশেষ করে চীন ও ভারতকে ভাবতে হবে ‘United We Stand Divided We Fall’.

চীন ও ভারতকে অনুধাবন করতে হবে তাদের মধ্যে যে সংঘাত অনেক রাষ্ট্রের জন্য তা আনন্দ সংবাদ। কিছু রাষ্ট্রের এই আনন্দ সংবাদ এশিয়ার ৪৬৫ কোটি মানুষের জন্য বড়ই দুঃসংবাদ।

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ