X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

গলিত-লবণের চুল্লি: বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ?

কাজী জাহিন হাসান
০৬ আগস্ট ২০২০, ১৫:৩৯আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২০, ১৩:১৩

কাজী জাহিন হাসান আমরা যেভাবে শিল্পায়ন করছি তাতে বাংলাদেশের আরও বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। যেহেতু আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছি, তাই আমাদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তি হচ্ছে সবিরাম যা আধুনিক শহরগুলোর চাহিদা অনুযায়ী অবিচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহ করতে পারে না। যেসব দেশে বায়ু ও সৌরশক্তিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ হয়েছে সেখানে ৭০ ভাগ সময়েই জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বলছে (ব্যাকআপ হিসেবে)।
জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিস্থাপনের জন্য পারমাণবিক শক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম বিকল্প। রূপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টটি প্রচলিত হালকা পানির চুল্লি (এলডব্লিউআর) নকশা ব্যবহার করবে। তবে, এখন অনেক বেশি নিরাপদ ও আর্থিকভাবে লাভজনক নকশা পাওয়া যায়। চীন গানসু প্রদেশের উউই-তে প্রথম গলিত লবণ চুল্লি (এমএসআর) তৈরি করছে। এমএসআর ডিজাইনটি প্রচলিত (এলডব্লিউআর) পারমাণবিক চুল্লির ডিজাইনের চেয়ে নিরাপদ; ফুকুশিমা এবং চেরনোবিলে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা কোনও এমএসআর-তে ঘটতে পারে না।

চেরনোবিল ও ফুকুশিমা উভয় দুর্ঘটনার মূল কারণ হলো শীতলকরণ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছিল, যার ফলে কোর অতিরিক্ত গরম করা হয়েছিল। এই উভয় পারমাণবিক কেন্দ্রই ছিল হালকা পানির চুল্লির (এলডব্লিউআর) প্ল্যান্ট। এলডব্লিউআর ডিজাইনে চুল্লির কোরকে অতিরিক্ত গরম থেকে সুরক্ষার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কুল্যান্ট সার্কুলেশন প্রয়োজন।

‘অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয়তার’ কারণে চুল্লি বন্ধ হওয়ার পরও কুল্যান্ট সার্কুলেশন বা শীতল সঞ্চালন প্রয়োজন। চেইন রিঅ্যাকশন বন্ধের পরও জ্বালানিগুলোতে বিভাজন পণ্যগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং তাপ উৎপাদন করতে থাকে।

ফুকুশিমায় ভূমিকম্পের ধাক্কায় চুল্লিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তবে অবশিষ্টাংশের তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে উৎপন্ন তাপ অপসারণের জন্য তখনও কুল্যান্ট সঞ্চালনের প্রয়োজন ছিল। ভূমিকম্পের ক্ষতির কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে কুল্যান্ট সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ব্যাকআপ জেনারেটরগুলো ব্যবহার করা যায়নি কারণ সুইচগুলো একটি বেজমেন্টে ছিল, যা সুনামিতে প্লাবিত হয়। কুল্যান্ট সঞ্চালন না থাকায় কোরটি অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে উচ্চ-তাপমাত্রার জিরকোনিয়াম (ফুয়েল ক্ল্যাডিং) এবং পানির (কুল্যান্ট) মধ্যে বিস্ফোরক হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হয়েছিল। হাইড্রোজেন গ্যাস বিস্ফোরণের মূল কারণটি ছিল কোরটির অতিরিক্ত উত্তাপ।

সুরক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষা চালানোর জন্য চেরনোবিলে কুল্যান্ট সার্কুলেটিং পাম্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কুল্যান্ট সার্কুলেশন ছাড়া কোর অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। কোরের পানি উচ্চ-চাপের বাষ্পে পরিণত হয়; যার ফলে বিস্ফোরণ ঘটে। এই বাষ্প বিস্ফোরণের মূল কারণটি ছিল কোরটির অতিরিক্ত উত্তাপ।

একটি এমএসআর-এ যদি কুল্যান্ট সার্কুলেশন বাধাগ্রস্ত হয় তবে মূল গলিত লবণ গরম হয়ে উঠতে শুরু করে এবং প্রসারিত হয়; প্রসারণ ইউরেনিয়াম পরমাণুর মধ্যে স্থান বৃদ্ধি করে, এটি নিউট্রনের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় (যা অন্যান্য ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিভাজন দ্বারা উৎপাদিত হয়); এটি চেইন রিঅ্যাকশন থামিয়ে দেয় এবং চুল্লিটিকে কোনও মানুষের বা স্বয়ংক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই শক্তি কমিয়ে দেয়।

যদি কোনও কারণে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকে (যা নিতান্তই অসম্ভব) তাহলে চুল্লিটির নিচে থাকা লবণের প্লাগ গলে যাবে এবং গলিত লবণ (জ্বালানিযুক্ত) কোরের নিচে অনেক ট্যাংকে নিকশিত হবে। যেহেতু ড্রেন ট্যাংকগুলোতে কোনও মডারেটর নেই (মডারেটর হচ্ছে এমন  পদার্থ (গ্রাফাইট) যা নিউট্রনকে ধীর করে দেয় যা ইউরেনিয়াম ফিশনকে ট্রিগার করে) ফলে চেইন রিঅ্যাকশন বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া ড্রেন ট্যাংকগুলোর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বেশি হওয়ায় নিউট্রনগুলোর জ্বালানির সাথে সংঘর্ষ সংখ্যা হ্রাস পায়; এটি চেইন রিঅ্যাকশন বন্ধ করে দেয়।

এমএসআর নকশায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোকে পারমাণবিক প্রকৌশলীরা ‘প্যাসিভ সেফটি’ হিসেবে উল্লেখ করেন (যে সুরক্ষা তার প্রত্যাশিত কাজের জন্য মানব অপারেটর বা স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করে না)।

এমএসআর-গুলো খুব লাভজনক হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এমএসআর চুল্লি প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লিগুলোর চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক জ্বালানি ব্যবহার করে। একটি প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লিতে সলিড ইউরেনিয়াম অক্সাইড ফুয়েল রডগুলো জিরকনিয়ামে আবৃত হয়। ইউরেনিয়াম ফিশন প্রডাক্টগুলো এই রডগুলোতে জমা হয় (যেহেতু তারা ক্ল্যাডিং এড়াতে পারে না)।

কিছু ইউরেনিয়াম ফিশন প্রডাক্ট হচ্ছে ‘নিউট্রন শোষণকারী’। নিউট্রন শোষণকারী যেমন জমা হয়, তারা নিউট্রন শোষণের জন্য ইউরেনিয়ামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে; চেইন রিঅ্যাকশন ধীর হয়ে যায় কারণ ইউরেনিয়াম নিউট্রন থেকে বঞ্চিত থাকে। এলডব্লিউআর-এ যখন জ্বালানি রডগুলো অপচয় হয় তখন কেবলমাত্র অল্প পরিমাণে (৫ শতাংশেরও কম) ইউরেনিয়াম বিভক্ত হয়।

একটি এমএসআর-এ ফিশন প্রডাক্টগুলো (যা গ্যাস হিসেবে উৎপাদিত হয়) কেবল রিয়েক্টর ভেসেলের উপরের দিকে জমা হয়, যেখানে সেগুলো সরিয়ে স্টোরেজ করার জন্য প্রক্রিয়াজাত করা যায়। একারণে একটি এমএসআর তার ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম জ্বালানি ব্যবহার করতে পারে এবং এর ফলে অনেক কম (অর্ধায়ু) তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপাদন হয়।

গলিত লবণের চুল্লিগুলো প্রচলিত পারমাণবিক চুল্লির তুলনায় সস্তা জ্বালানি ব্যবহার করতে পারে। প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যয়বহুল ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। এমএসআর-এ জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়ামের সঙ্গে খুব সস্তা থোরিয়াম মেশানো হয়।

রিঅ্যাক্টর কোরে নিউট্রনের সঙ্গে বিকিরণ হলে থোরিয়াম ইউরেনিয়াম-২৩৩-তে পরিণত হয়। অর্থাৎ, এমএসআর সস্তা থোরিয়ামকে মূল্যবান ইউরেনিয়াম-২৩৩ জ্বালানিতে রূপান্তর করে।

এলডব্লিউআর ইউরেনিয়াম জ্বালানি অবশ্যই জ্বালানি রড হিসেবে তৈরি করতে হয়। এমএসআর জ্বালানিতে এই ব্যয়বহুল ফেব্রিকেশনের প্রয়োজন পড়ে না। এমএসআর-এ জ্বালানি শুধু গলিত লবণেই দ্রবীভূত হয়।

গলিত লবণের চুল্লিগুলো প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লির তুলনায় অনেক কম অর্ধায়ু  সম্পন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপাদন করবে।

এলডব্লিউআর যে জ্বালানি বর্জ্য উৎপাদন করে তা ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বছর ধরে তীব্রভাবে তেজস্ক্রিয় থাকে। অন্যদিকে এমএসআর যে জ্বালানি বর্জ্য উৎপাদন করে তা ৩০০ বছর ধরে তীব্রভাবে তেজস্ক্রিয় থাকে; যা এলডব্লিউআর-এর চেয়ে ঢের কম।

গলিত লবণের চুল্লিগুলি এমনকি প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লির তুলনায় অনেক সস্তা। এলডব্লিউআর চুল্লিগুলোর কোর থেকে উচ্চ চাপের তেজস্ক্রিয় বাষ্পের যে কোনও দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষায় একটি বিশাল কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং প্রয়োজন। এমএসআর চুল্লির কোরে বাষ্প বা পানি নেই, ফলে এর জন্য ব্যয়বহুল কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং-এর দরকার নেই। এর ক্রিয়াশীল চাপ কম হওয়ায় উচ্চ চাপে পরিচালনা করতে কোনও ব্যয়বহুল রিয়েক্টর ভেসেল নির্মাণেরও প্রয়োজন নেই।

গলিত লবণের চুল্লির প্রবক্তারা আশা করছেন, এমএসআর পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় সস্তা হবে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রযুক্তিটি বাণিজ্যিক পর্যায়ে প্রমাণিত হয়ে গেলে (চীনা প্রকল্পের অধীনে) নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেয়ে এমএসআর পারমাণবিক প্ল্যান্ট তৈরি করা আরও লাভজনক হবে।

উপসংহারে এটা বলা যায়, এমএসআর চুল্লির ডিজাইন নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দিক থেকে প্রচলিত (এলডব্লিউআর) চুল্লির নকশার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। পারমাণবিক প্ল্যান্টের নকশা বাছাইয়ের সময় প্রাথমিক বিবেচনায় অবশ্যই সুরক্ষার বিষয়টি থাকতে হবে। বাংলাদেশ একটি ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং আমাদের অবশ্যই পারমাণবিক দুর্ঘটনা এড়ানো উচিত।

বাংলাদেশ এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। কারণ শিল্পায়নে সস্তা বিদ্যুতের প্রয়োজন। তবে এমএসআর প্রযুক্তি কয়লার চেয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে সক্ষম। যদি এমএসআর শক্তি সত্যিই কয়লা বিদ্যুতের তুলনায় সস্তা হিসেবে প্রমাণিত হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যতের যাবতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র এমএসআর পারমাণবিক প্ল্যান্ট হওয়া উচিত।

সূত্র:

০১. ‘মল্টেন সল্ট অ্যান্ড ট্রাভেলিং ওয়েভ নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরস’ (এশিয়া টাইমস, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

https://asiatimes.com/2020/02/molten-salt-and-traveling-wave-nuclear-reactors/

০২. ‘চেরনোবিল অ্যাকসিডেন্ট ১৯৮৬’ (ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশন)

https://www.world-nuclear.org/information-library/safety-and-security/safety-of-plants/chernobyl-accident.aspx

০৩. ‘ফুকুশিমা দাইচি অ্যাকসিডেন্ট’ (ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশন)

https://www.world-nuclear.org/information-library/safety-and-security/safety-of-plants/fukushima-daiichi-accident.aspx

০৪. ‘থোরিয়াম: এনার্জি চিপার দেন কোল’, বুক বাই রবার্ট হারগ্রেভস, ২০১২।

০৫. ‘দ্য রেসারেকশন অব দ্য মল্টেন সল্ট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর’ আ প্রেজেন্টেশন বাই নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ড. অ্যালান রাইস।

https://www.msr-rice.com/5d0a1faee238c/the-resurrection-of-the-molten-salt-nuclear-reactor

০৬. উইকিপিডিয়া পেজ অন মল্টেন সল্ট রিঅ্যাক্টরস:

https://en.wikipedia.org/wiki/Molten_salt_reactor

লেখক: চেয়ারম্যান, টু-এ মিডিয়া লিমিটেড

 

/এমপি/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ