X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বত্রিশ নম্বরের সেই রক্তাক্ত সিঁড়ি ও আজকের বাংলাদেশ

আবদুল মান্নান
১৪ আগস্ট ২০২০, ২৩:৫১আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২০, ২৩:৫৯

আবদুল মান্নান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের একশত বছর পালনের বছরে আমাদের সামনে তাঁকে হত্যার পঁয়তাল্লিশ বছর পালনের দিনটা এসে গেলো। বেঁচে থাকলে তিনি এই বছর একশত বছরে পা দিতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা ঘাতকরা শেষ করে দিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে তাঁরই কন্যা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, যা অনেকটা অভূতপূর্ব। পিতা তেইশ বছর বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছেন, কারাবরণ করেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু যাদের জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তাদের খেদমত করতে পেরেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরের মাথায় যে বাঙালির জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছিলেন তাদের একটি ভিন্ন ভাবধারার বিপদগামী অংশ তাকে সেই কালরাত্রিতে সপরিবারে হত্যা করে পরবর্তীকালে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিল।
পঁয়তাল্লিশ বছর দীর্ঘ সময়। পদ্মা মেঘনা যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। মাঝখানে দু’টি প্রজন্ম বন্ধু ছাড়া বঙ্গে বড় হয়েছে। অনেকের কাছে সেই বন্ধুর নাম অপরিচিত। কারণ, তাঁকে হত্যার পর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তারা বঙ্গের এই বন্ধুর নাম, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম নেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করেছিল। পিতার হত্যার পর দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসনে কাটিয়ে ১৯৮১ সনে তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আবার মানুষ পিতার নাম ও কীর্তি শোনা শুরু করেছে। স্বাভাবিক কারণেই বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সব সময় পিতা ও পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের প্রসঙ্গ এলে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে যান। একরাতে পরিবারের ১৮ জন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। সমসাময়িক ইতিহাসে সম্ভবত একমাত্র নজির ইরাকের। ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান যেখানে ইরাকের জেনারেল কারিম কাসিমের নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য ইরাকের সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান বাদশাহ দ্বিতীয় ফায়সালকে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর মরদেহকে বেঁধে রাস্তায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ফায়সালের পরিবারের একুশজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল সেই অভ্যুত্থানে।  বাদশাহ ফায়সালকে হত্যার পর কারিম কাসিম ইরাকের ক্ষমতা দখল করেছিল। বাদশাহ ফায়সালের হত্যার পর ঐতিহাসিকদের মতে ইরাকে অশান্তি শুরু। সে কারিম কাসিম ১৯৬৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আরেক অভ্যুত্থানে শুধু উৎখাতই হয়নি, তাকেও অভ্যুত্থানকারীরা হত্যা করেছিল। তখন তার বয়স মাত্র ৪৮ বছর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরম্পরায় তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ যেন ইরাকের সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
পিতার নিহত হওয়ার দিনটির পালনের সম্ভবত গত বছরের এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দলে নেতার অভাব হয় না; কিন্তু বাবার লাশটা যখন ধানমন্ডির বাড়ির সিঁড়িতে বত্রিশ ঘণ্টা পড়ে ছিল তখন কোথায় ছিল এত আওয়ামী লীগ নেতা?
এর চেয়ে নির্মম সত্যনির্ভর প্রশ্ন আর হতে পারে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নেতার অভাব হয় না, অভাব হয় কর্মীর। বঙ্গবন্ধু বলতেন, তিনি চোঙ্গা ফুঁকে নেতা হয়েছেন, সে কারণেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বুঝতে পারেন। আজকাল তো কেউ এই পথে নেতা হতে চায় না। ফাস্টফুডের মতো আজ সব রাতারাতি চটজলদি নেতা। কেউ বা পৈতৃক সূত্রে আর কেউ বা অর্থের বিনিময়ে। বর্তমান সময়ে সাহেদ আর পাপিয়ারাই নেতা হওয়ার যোগ্য। দলের কোনও এক সংকটকালে রাস্তায় পুলিশের লাঠিপেটা খাওয়ারা দলের সুদিনে নির্বাসনে থাকে। এখন রমরমা অবস্থা দলে অনুপ্রবেশকারীদের, যাদের হাইব্রিড বলা হয়। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় সে সময় দলে যেমন তাজউদ্দীন বা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন, ঠিক একইভাবে খোন্দকার মোশতাক আর তাহেরউদ্দিন ঠাকুরও ছিলেন, এই কথাটা অনেকে ভুলে যান।
এক এগারোর পর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে, মনেই হচ্ছিল না এ দেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দল আছে, আছে তার অসংখ্য নেতাকর্মী। এটি বিশেষভাবে দেখা গেলো বঙ্গবন্ধু কন্যাকে গ্রেফতার করার পর। সেদিন কেন একটি মিছিল বের হলো না?
১৯৬৮/১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কতদিন কারফিউ ভেঙে জনগণ রাস্তায় মিছিল করেছে। বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করে সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয় তখন আন্দোলন কাকে বলে তা সারা বিশ্ব দেখেছে। আর সে আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগ তো শেখ হাসিনার গ্রেফতারের সময় দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের ভাগ্য ভালো দলের সেই ক্রান্তিকালে দলের হাল ধরেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। যেদিন তিনি তাঁর ওকালতি জীবনের পুরনো কালো কোটটা গায়ে ঝুলিয়ে শেখ হাসিনার জামিনের জন্য শুনানিতে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন আবেগে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন ছিল। আর শেখ হাসিনাকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় একনজর দেখতে প্রায় সময় দেখা গেছে বেগম মতিয়া চৌধুরী আর ডা. দীপু মনিকে ফুটপাতে বসে থাকতে।
বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ২০১৩ সাল থেকে দেশে পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস শুরু হলো তখন আওয়ামী লীগের পক্ষে টিভিতে কথা বলার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। হাতেগোনা পাঁচ ছয়জনকে এক টিভি থেকে অন্য টিভিতে গিয়ে কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয় তা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরার জন্য ছোটাছুটি করতে হয়েছে। তারা কেউই আওয়ামী লীগের দুই টাকার সদস্যও না। বঙ্গবন্ধু আর তাঁর কন্যার টানে তাদের এই ঝুঁকি নেওয়া। কোনও  টিভি পেট্রোল বোমার ভয়ে তাদের নিজস্ব গাড়ি পাঠাচ্ছে না। যেতে হতো তিন চাকার গাড়িতে, সামনে লালসালুতে ‘সাংবাদিক’ লিখে। একদিন আমাকে তিনটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়েছিল। একজন আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে বলেছিলেন ‘আপনার ভয় নাই? এত রিস্ক নেওয়া ঠিক না। আপনি কি মন্ত্রী মিনিস্টার হবেন নাকি?’ তাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, ‘এটি আপনাদের কাজ। আপনারা যাচ্ছেন না বলে আমাদের যেতে হচ্ছে।’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর লাশ বত্রিশ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে রেখে যারা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিতে গিয়েছিলেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। তারা জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি। মনে রেখেছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান আর কর্নেল জামিলের নাম।
কেউ যদি জানতে চায় পঁচাত্তরের তুলনায় বর্তমান আওয়ামী লীগ বা দেশের অবস্থা কি ভালো হয়েছে? দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নির্দ্বিধায় ভালো হয়েছে, যার সিংহভাগ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। তবে দেশে মন্দ মানুষের সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ বছর আগের তুলনায় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সব কিছু অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়। দলের আনুগত্য হতে শুরু করে পদ, পদবি আর পদক কোনও কিছুই বাদ নাই। আর একজন বঙ্গবন্ধু পেতে হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য জাতীয় চার নেতার ক্ষেত্রে। সরকারের যে প্রশাসন আছে তার মধ্যে এখনও আওয়ামী লীগ-বিরোধী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। দেশের সব সংকট একজন শেখ হাসিনাকে মোকাবিলা করতে হয় তা তো কোনও গোপন বিষয় নয়। বঙ্গবন্ধুর চারপাশে যারা থাকতেন পঁচাত্তরে তারা কেউই তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। অথচ দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে তা তখন অনেকেই আঁচ করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগের বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি বিশ্লেষণ করলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। শেখ হাসিনা সব সময় বলেন, যারা তাঁর পিতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের কয়েকজন আগের দু’-একদিনে তাঁদের বাসায় খেয়েও গেছেন। বঙ্গবন্ধু বা তাঁর মতো আরও যারা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার তাদের পিঠে সব সময় কাছের মানুষরাই ছুরি চালিয়েছে, বাইরের লোক পরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা শুধু একজন ব্যক্তির হত্যা নয়, এটি একটি জাতিকে হত্যার শামিল। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ ঠিক কিন্তু সেই বিশ্বাস যদি কোনও বাচবিচার করে করা না হয় তাহলে ঘটে যেতে পারে পনেরই আগস্টের মতো বড় দুর্ঘটনা। মানুষ আর একটা পনেরই আগস্ট দেখতে চায় না। চায় না বাংলাদেশের গতি আবার বিপরীতমুখী হোক। বঙ্গবন্ধুসহ পনেরই আগস্টের শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
সড়ক আইনে শাস্তি ও জরিমানা কমানোয় টিআইবির উদ্বেগ
সড়ক আইনে শাস্তি ও জরিমানা কমানোয় টিআইবির উদ্বেগ
পিসিবি প্রধানের আস্থা হারালেও শ্বশুরকে পাশে পাচ্ছেন শাহীন
পিসিবি প্রধানের আস্থা হারালেও শ্বশুরকে পাশে পাচ্ছেন শাহীন
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিচার শুরু
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিচার শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ